বাংলার বুলবুল গায়ক, পল্লীগীতির অমর সম্রাট, ভাওয়াইয়া গানের জগতে ধ্রুবতারা, অভিনেতা, প্লেব্যাক সিংগারসহ এক ডজনেরও বেশি বিশেষনে ভূষিত করা যায় তাঁকে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান ‘ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটি প্রথম তিনিই গেয়েছিলেন। এই গানটি ছাড়া মনে হয় বাঙালি মুসলমান সমাজে পবিত্র রোজার ঈদকে যেন ঈদই মনে হয়না। এই ঐতিহ্যবাহী গানের সঙ্গীত শিল্পী তিনি। নাম আব্বাস উদ্দিন আহমদ। ভাওয়াইয়া ও পল্লীগীতি জগতের মুকুটহীন সম্রাট।
আব্বাস উদ্দিন এমন একজন শিল্পী যিনি একবার শুনেই যেকোনো গানকে নিজের আয়ত্বে নিয়ে আসতে পারতেন। এজন্যই অনেকে তাকে ‘গড গিফ্টেড গায়ক’ বলে থাকেন। সৃষ্টিকর্তা যেনো নিজ হাতে তাকে কণ্ঠ দান করেছেন। শুধু ভাওয়াইয়া ও পল্লীগীতি নয়,আধুনিক গান, স্বদেশী গান, ইসলামি গান, পল্লীগীতি, উর্দুগান সবই তিনি গেয়েছেন। তবে পল্লীগীতিতে তাঁর মৌলিকতা ও সাফল্য সবচেয়ে বেশি। 'ত্রিভূবনের প্রিয় মুহাম্মদ', 'তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে' অথবা 'ওকি গাড়িয়াল ভাই', 'আমার গহিন গাঙের নাইয়া'… ইত্যাদি গান গেয়ে তিনি সমগ্র বাংলা মাতোয়ারা করেছেন।
১৯০১ সালের আজকের এই দিনে (২৭ অক্টোবর) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারে জন্ম আব্বাস উদ্দিনের। ১৯২০ সালের শুরুর দিক। সময়টা ছিল বাংলার মুসলমান সমাজের নবজাগরণের। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লী কবি জসিম উদ্দিন, ইসলামী জাতীয়তাবাদী চেতনার কবি গোলাম মোস্তফাসহ অন্যান্য মুসলমান কবি-সাহিত্যিক লেখনির মাধ্যমে মুসলিম চেতনাকে জাগিয়ে তুলছেন। ওই সময় গানের জগতে ধুমকেতুর মতো আবির্ভাব আব্বাস উদ্দিনের। চল্লিশের দশকে আব্বাস উদ্দীনের গান পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে মুসলিম জনতার সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বলা চলে গানের তেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তিনি পাননি। গানের জগতে তার কোনো ওস্তাদের তালিম ছিল না। আপন প্রতিভাবলে নিজেকে সবার সামনে তুলে ধরেন। আব্বাস উদ্দিন প্রথমে ছিলেন পল্লীগাঁয়ের অখ্যাত এক গায়ক। যাত্রা, থিয়েটার ও স্কুল-কলেজের সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গাওয়া শিল্পীদের গান শুনে গানের প্রতি ভালবাসায় জড়িয়ে পড়েন। ওইসব শিল্পীদের গান নিজ চেষ্টায় গাইতে থাকেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।
বাংলাদেশের খ্যাতনামা সাহিত্যিক, বিশিষ্ট পরিসংখ্যানবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোতাহের হোসেন ও সেতার ও সানাই এবং রাগ সঙ্গীতে বিখ্যাত ঘরানার গুরু হিসেবে পরিচিত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গে আব্বাস উদ্দিন আহমদ।
বাংলাদেশের রংপুর ও ভারতের কুচবিহার অঞ্চলের ভাওয়াইয়া, ক্ষীরোল চটকা গেয়েই আব্বাস উদ্দিন সংগীত জগতে প্রবেশ করেন। তারপর গানের সব শাখায় গান গেয়ে সুনাম অর্জন করেন। জারি, সারি, ভাটিয়ালি , মারফতি-মুর্শিদি, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া (বেদনামিশ্রিত কাব্য), পালাগান-সবই গেয়েছেন তিনি। তাঁর দরদভরা সুরেলা কণ্ঠে গানের সুর যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা আজও বিস্ময়। তাইতো লোকসংগীতে এখনও তিনি অদ্বিতীয় জনপ্রিয় শিল্পী।
বয়সে মাত্র ২ বছরের বড় কবি নজরুল। তারপরও বিদ্রোহী কবি তাকে খুবই স্নেহ করতেন। সকলের কাছে কাছে আব্বাস উদ্দীনকে পরিচয় দিতেন ‘আমার ছোট ভাই’ বলে। প্রায় বিশ বছর তিনি প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুলের সাহচর্যে ছিলেন। নজরুলের অগোচরে তাঁর অনেকগুলো গান আব্বাস উদ্দিন রেকর্ড করে ফেলেন। ‘কোন বিরহীর নয়ন জলে বাদল মরে গো’ ও অপর পিঠে ‘স্মরণ পায়ের ওগো প্রিয়’ বাজারে বের হলেই সাড়া পড়ে যায়।
গানের রেকর্ডিং জগতে রাজকীয় প্রতিষ্ঠান এইচ এম ভি (হিজ মাস্টার্স ভয়েজ) থেকে রেকর্ড হওয়া আব্বাস উদ্দিন ছিলেন প্রথম মুসলমান গায়ক যিনি আসল নাম ব্যবহার করে এইচ এম ভি থেকে গানের রেকর্ড বের করতেন। রেকর্ডগুলো ছিল বাণিজ্যিকভাবে ভীষণ সফল।
কাজী নজরুলের ইসলামী গান রচনার ও তা জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে আব্বাসউদ্দিনের একটা ভূমিকা রয়েছে।নজরুল তখন গ্রামোফোন কোম্পানির গীতিকার ও সুরকার। আব্বাসি উদ্দিনের অনুরোধেই একদিন নজরুল লিখলেন `ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে` ও `ইসলামের ঐ সওদা লয়ে`। তারপরতো ইতিহাস। এই দুটি গান বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছে অমর হয়ে আছে।
গানের নানা ক্ষেত্রের মধ্যে আব্বাসউদ্দিনের প্রধান ক্ষেত্র ছিল লোকসঙ্গীত। কলকাতাতে পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের সঙ্গে তিনি লোকসঙ্গীত প্রচারে ব্রতী হন। তাদের প্রচেষ্টায় লোকসঙ্গীত সম্পর্কে কলকাতার মানুষের মনে গভীর উৎসাহ জাগে।এক্ষেত্রে অবশ্য লোকসঙ্গীতের সংগ্রাহক ও বিখ্যাত দোতারাবাদক কানাইলাল শীলের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না।
ছেলে মুস্তফা জামান আব্বাসির সঙ্গে আব্বাস উদ্দিন আহমদ।
গানের ভূবনে সুর নিয়ে খেলা করলেও রুপালি পর্দাও কাঁপিয়েছেন ভাওয়াইয়া ও পল্লীগীতির এই অমর শিল্পী। 'বিষ্ণুমায়া' (১৯৩২), 'মহানিশা' (১৯৩৬),' একটি কথা' ও 'ঠিকাদার' (১৯৪০) চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি দর্শকদের বিমুখ করেননি, দারুন প্রশংসা কুড়িয়েছেন।শু ধু তাই নয়, এসব ছবির গানেও তিনি কন্ঠ দিয়েছেন।
অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সময়কালে রেকর্ডিং এক্সপার্ট হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করা আব্বাস উদ্দিন ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানে চলে আসেন। ঢাকায় তিনি পাকিস্তান সরকারের প্রচার দপ্তরে এডিশনাল সং অর্গানাইজার হিসেবে চাকরি করেন। পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে আব্বাস উদ্দীন ১৯৫৫ সালে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সংগীত সম্মেলন, ১৯৫৬ সালে জার্মানিতে আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলন এবং ১৯৫৭ সালে মিয়ানমারের রেঙ্গুনে (বর্তমানে ইয়াংগুন নামে পরিচিত) প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে যোগদান করেন।
আব্বাস উদ্দিন সম্পর্কে লেখক ও গবেষক ফরহাদ মজহার বলেন, “আব্বাস উদ্দিন কেবল গায়ক ছিলেন না, এই প্রজন্মের গায়করা যদি ভাবেন আব্বাস উদ্দিন শুধু গান গেয়ে এদেশের মানুষের মন জয় করেছেন তাহলে তা মস্ত বড় ভুল হবে।আব্বাস তার সময়কালের আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রামকে ধারণ করেছিলেন,সঙ্গে ছিলেন কাজী নজরুল এবং আরো অনেকে।” সূত্র: মোরশেদ, হেদায়েত হোসেন (২০০১)। "চলচ্চিত্রে আব্বাস উদ্দিন এবং...”। সাপ্তাহিক ২০০০, ঈদ সংখ্যা শাহাদত চৌধুরী ৪ (২৮): ৩৫৯।)
আব্বাস উদ্দিনের লেখা ‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’ (১৯৬০) একটি মূল্যবান তথ্যসমৃদ্ধ একমাত্র গ্রন্থ। সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর প্রাইড অব পারফরমেন্স (১৯৬০), শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৯) এবং স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে (১৯৮১) ভূষিত হন।
বেশি গান হয়তো তিনি গেয়ে যেতে পারেননি। বিখ্যাত হতে বেশি গানের প্রয়োজনও হয়তো হয়না। প্রায় সাতশত গানে তিনি কন্ঠ দিয়েছেন। আরো অনেক গানে কন্ঠ দিতে পারতেন হয়তো। তবে যে গানগুলো তিনি গেয়েছেন সেগুলো আব্বাস উদ্দিনকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল।