স্বাধীন, সুন্দর ও মুক্ত সমাজের দ্রষ্টা, নারী মুক্তির অগ্রদূত, স্বাধীন ভারত আন্দোলনের সেনা, সাংবাদিক বিপিন চন্দ্র পাল। জন্মেছিলেন সিপাহী বিপ্লবের এক বছর পরে ১৮৫৮ সালের ৭ নভেম্বর। বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার সদর থানার পইল গ্রামে। তার পিতা রামচন্দ্র পাল ছিলেন পাইল গ্রামের এক মাঝারি জমিদার। বিপিন চন্দ্র পালের মাও ছিলেন উদার ও মানবিক গুণের অধিকারী। তাঁর বাসায় থেকে যেসব ছাত্ররা পড়াশোনা করতো তিনি তাদেরকে স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন। পারিবারিকভাবেই বিপিন চন্দ্র পালের মধ্যে সাম্য ও মানবতা বোধের দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠে।
সংসার জীবনের পূর্বেই বিপিনচন্দ্র পাল রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৭৭ সালে তিনি সেকালের উদারপন্থি সমাজ সংস্কারক দার্শনিক শিবনাথ শাস্ত্রী দ্বারা প্রভাবিত হন। আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রীর আদর্শে ও প্রেরণায় স্বাধীনতার সাধকদলের সদস্য হিসেবে বিপিনচন্দ্র পাল দীক্ষা গ্রহণ করেন। এসময় থেকে তিনি স্বদেশ-স্বজাতির মুক্তির লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার ব্রতে নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদন করেন। “প্রথমদিনে শরতচন্দ্র রায়, আনন্দচন্দ্র মিত্র, কালীশঙ্কর-সুকুল, তারাকিশোর চৌধুরী, সুন্দরীমোহন দাস আর আমি, আমরা ছয়জনে এই দীক্ষা গ্রহণ করি।”
তৎকালীন ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবোধ ও রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করার উদ্দেশ্য সিলেটে ন্যাশনাল ইন্সটিউট স্থাপন করেন। শ্রীহট্ট শহরের এই প্রতিষ্ঠানটি ১৮৭৯ সালে পরিচালনার অভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এই সংবাদে কলিকাতার শ্রীহট্ট সম্মেলনীর সদস্যগণ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে বিপিন চন্দ্র পাল ও রাজেন্দ্র চৌধুরীকে শ্রীহট্টে প্রেরণ করেন। বিপিন চন্দ্র পাল ১৮৮০ সালের ৫ জানুয়ারি এই স্কুলকে ‘শ্রীহট্ট জাতীয় বিদ্যালয়’ হিসেবে রূপান্তর করেন। বেশিদিন কোথাও স্থির হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। আত্মমর্যাদা বোধ, স্বাধীন চিন্তা যখন দেখেছেন একটু ব্যঘাত ঘটতে তখনই সে কাজ ছেড়ে দিয়েছেন।
১৮৮৫ সালে বোম্বে সম্মেলনের ভিতর দিয়ে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হয়। “ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে এক নুতন অধ্যায় সূচনা হইল। বালগঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায়, বিপিন চন্দ্র পাল ও অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ দেশবাসীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরতা গড়িয়া তুলিতে সাহায্য করেন এবং আত্মত্যাগের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হইয়া সংগ্রামে অবতীর্ণ হইতে আহ্বান জানান।”
কংগ্রেসের জন্মের পর থেকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালিত হতে থাকে। অল্পদিনের মধ্যে বিপিন চন্দ্র পাল সব ভারতীয় পর্যায়ের একজন নেতা হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেন। বিপিন চন্দ্র পাল অসাধারণ বক্তা হওয়ার কারণে বিভিন্ন সভা-সমাবেশের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের জনগণকে জাগ্রত করেন। কিন্তু কংগ্রেসের অভ্যন্তরে মধ্যপন্থি ও চরমপন্থি অংশের মধ্যে এক সাময়িক ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়। নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বিপিন চন্দ্র পাল মতাদর্শগতভাবে মধ্যপন্থি ধারার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন এবং চরমপন্থি অংশের নেতৃত্বে চলে আসেন। ব্রিটিশ শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করতে তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামে যুক্ত হন।
বিপিন চন্দ্র পাল প্রাণশক্তি দিয়ে জাগিয়ে তোলেন ঘুমন্ত জাতিকে। তিনি আহ্বান জানান পরাধীনতার শিকল ভাঙ্গতে। ক্রমেই লালা লাজ-পতরায়, বাল গঙ্গাধর তিলকের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন। তিনি শুধু কলাকতায় বসে থাকেননি, সারা ভারতবর্ষের প্রতিটি অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে পরাধীন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন। সমগ্র দেশে অল্পদিনের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে ঘুমন্ত ভারতকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁহাকে গুরুদেব বলে সম্বোধন করতেন। লালা লাজপতরায়, বাল গঙ্গাধর তিলক ও বিপিন চন্দ্র পাল তখনকার ভারতে রাজনৈতিক অঙ্গনে তিন দিক্পাল ছিলেন।
সত্যিকার অর্থে বিপিন চন্দ্র পাল ছিলেন নারীমুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা। ছাত্রাবস্থায় তিনি ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করে তরুণ বয়স থেকেই বিধবা বিবাহের পক্ষে ছিলেন। তার বলিষ্ঠ অঙ্গীকার ছিলো বিধবা-বিবাহ প্রচলন করা। বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহরোধ এবং নারীশিক্ষার প্রচলনে ভারতীয় সমাজে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করা। এ ধরনের নানা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিপিন চন্দ্র পাল আমৃত্যু লড়েছেন। রাজা রামমোহন প্রবর্তিত বিধবা বিবাহ তিনি মনে প্রাণে সমর্থন করতেন। ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করেছেন যে সমস্ত বক্তব্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিলো নারী জাগরণের প্রসঙ্গটি। এ জন্য ব্রাহ্মসমাজে দ্বারা পরিচালিত হয়ে নিজে একজন বিধবাকে-বিবাহ করেন। ফলে সমাজচ্যুত হয়ে নিজ বাড়ি থেকে বিতাড়িত হন।
নারীর অধিকার বাস্তবায়নে ব্যক্তিজীবনে একাধিক উদাহরণ রেখে গেছেন। বিপিন চন্দ্র পাল তার এক বিধবা মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী উল্লাস কর দত্তের কাছে। বিপিনচন্দ্র পালের উদ্যোগে ও প্রচেষ্টা শুধুমাত্র বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। বহু বিবাহ প্রভৃতি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লেখা-লেখি, সভা-সমিতিতে বক্তব্যের মাধ্যমে জনমত গঠন করেন। নারীশিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তাঁহার যথেষ্ট অবদান ছিল।
বিপিন চন্দ্র পাল স্বাধীন-সুন্দর-মুক্ত সমাজে স্বপ্ন দেখেছিলেন। এ কারণে ধৈর্য সাহস ও দৃঢ়তা নিয়ে তার সুদীর্ঘ জীবনের রাজনৈতিক সংগ্রামে অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে অনুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তা স্মরণাতীতকালের ইতিহাসে দুর্লভ। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রশ্নে মোতিলাল নেহেরু, দেশবন্ধু চিন্তরঞ্জন দাস, গান্ধীর সাথে ভিন্নমত পোষণ করে বিপিনচন্দ্র পাল শেষ জীবনে রাজনীতি থেকে দূরে সরে চলে আসেন। জীবনের শেষাংশে সাহিত্য সৃষ্টিতে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৩২ সালের ২০ মে মারা যান।