কবিতাই কাল হয়েছিল সেনাশাসক এরশাদের

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

সেপ্টেম্বর ৫, ২০২২, ০২:৪৯ এএম

কবিতাই কাল হয়েছিল সেনাশাসক এরশাদের

কবিতা নিয়ে খুব কথা হল কয়েকদিন ধরে। বিশেষ করে এক অতিরিক্ত সচিবের কবিতা এবং কবিতার বই গত কয়েকদিন ছিল ভাইরাল। সরকারি একটি প্রকল্পে বই কেনায় নাকি ওই সচিবেরই ছিল ২৯টি বই, সেসব বইয়ের বেশিরভাগই আবার কবিতার বই! সে যা-ই হোক, কবিতা কবিতাই। কবিতা মানুষকে বিবাগী করে। কাউকে করে প্রেমিক। কাউকে তোলে সম্মানের চূড়ায়, কাউকে করে সিংহাসন ছাড়া। আমরা জানি জেনারেল এরশাদ গদিচ্যূত হয়েছিলেন তীব্র গণআন্দোলনে। কিন্তু সেই গণআন্দোলনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল সেই সময়ের দূরন্ত কবিদের আগুন-কবিতাগুলো।

যেভাবে 'স্বৈরাচার' তকমা পান এরশাদ - banglanews24.com
জেনারেল এরশাদের হাতে কুক্ষিগত গণতন্ত্রের মুক্তির সংগ্রাম রাজপথে ছড়িয়ে পড়ে। ছবি: সংগৃহীত 

 

জেনারেল এরশাদ এবং কবিতা তাঁর শাসনামলে ছিল খুব আলোচিত এক বিষয়। এরশাদ তখন জোর করে ক্ষমতায় থাকা এক রাষ্ট্রপতি। ক্ষমতার পর তিনি পত্রিকার প্রথম পাতাও জোর করে দখল করার চেষ্টা করেছিলেন। তখন এরশাদের কবিতা নামের অসংখ্য লেখা পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হতো। এ বিষয়ে অলিখিত এক নির্দেশ ছিল পত্রিকার সম্পাদকদের জন্য। সম্পাদকদের তখন করার কিছুই ছিল না। কারণ, তাঁদের প্রত্যেকের ঘাড়েই একটি করে মাথা। সেনাশাসকের রাষ্ট্রে থাকলে তার কথামত চলতে হবে। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনাও শুরু হল এক সময়। তখনকার কবিরা ত বটেই, সাধারন পাঠকেরাও সমালোচনা করতে লাগলো এই বলে যে, গায়ে মানে না আপনি কবি!

ক্ষমতায় থাকাকালে একবার এরশাদ সফর করে এলেন আমেরিকা থেকে। সেটি ১৯৮৩ সালের অক্টোবর মাসের ঘটনা। মাত্রই সফর শেষে দেশে ফিরেছেন তিনি। দাঁড়ালেন এক সংবাদ সম্মেলনে। তাঁর নয় বছরের শাসনামলে আর কোন সংবাদ সম্মেলনে ওরকম বিব্রতকর প্রশ্নের মুখোমুখি সম্ভবত আর হতে হয়নি তাঁকে। সেই সংবাদ সম্মেলনেই সাংবাদিক জাহাঙ্গীর হোসেন করলেন সেই দুঃসাহসী প্রশ্নটি। প্রশ্ন তো নয়, যেন প্রতাপশালী এক সামরিক শাসককে চ্যালেঞ্জ করা!

জাহাঙ্গীর হোসেন তখন সরকারি বার্তা সংস্থা বাসসের কূটনৈতিক সংবাদদাতা। প্রশ্ন করার আগে একবার এরশাদকে তিনি সম্পূরক একটি প্রশ্ন করে নিলেন এই বলে যে, "মে আই আস্ক ইউ এ নন-পলিটিক্যাল কোয়েশ্চেন"- অর্থাৎ আমি কি আপনাকে একটি অরাজনৈতিক প্রশ্ন করতে পারি?

এরশাদ ত মহাখুশি। কারণ, তিনি তখন জাতে উঠতে রাজনৈতিক দলগুলোকে বারংবার সংলাপে ডাকছিলেন। কিন্তু কোন দল তাঁর ডাকে সাড়া দিচ্ছিল না। কেউ তাঁর সাথে কথা বলতেও আসছিল না।

ঢাকায় বিদেশি সাংবাদিক পরিবেষ্টিত জেনারেল এরশাদ।
বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে এক সংবাদ সম্মেলনে জেনারেল এরশাদ। ছবি: গেটি ইমেজ ভায়া বিবিসি 

 

ফলে সাংবাদিক জাহাঙ্গীর হোসেনের প্রশ্ন করার এমন আগ্রহে এরশাদ বেশ উৎসাহী হয়ে উঠলেন। জাহাঙ্গীর হোসেন তখন এরশাদের কাছে জানতে চাইলেন, "আপনি ক্ষমতায় আসার আগে কেউ জানতো না আপনি একজন কবি। এখন সব পত্রিকার প্রথম পাতায় আপনার কবিতা ছাপা হয়। পত্রিকার প্রথম পাতা তো খবরের জন্য, কবিতার জন্য নয়। বাংলাদেশের প্রধানতম কবি শামসুর রাহমানেরও তো এই ভাগ্য হয়নি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আপনার কবিতা প্রথম পাতায় ছাপানোর জন্য কী কোন নির্দেশ জারি করা হয়েছে?"

এই প্রশ্ন শুনে একজন প্রবল ক্ষমতাধর সামরিক শাসক একেবারে চুপসে যান। গোটা সংবাদ সম্মেলনই তখন হতচকিত! কারণ এমন প্রশ্নের জন্য এরশাদ আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। প্রতাপশালী একজন সামরিক শাসককে এমন এক প্রশ্ন করে সেদিন জাহাঙ্গীর হোসেন কার্যতঃ বাংলাদেশে সাংবাদিকতার সাহসী এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।

জেনারেল এরশাদ তখন প্রশ্নকারী সাংবাদিক জাহাঙ্গীরকে এক পর্যায়ে বললেন, আমি দেশের জন্য এত করি, এটুকু কি আপনি দেবেন না আমাকে? আপনি যদি চান, আর ছাপা হবে না।"

Journalist Jahangir Hossain And Ershad
সাংবাদিক জাহাঙ্গীর হোসেন (বাঁয়ে) এবং জেনারেল এরশাদ। ছবি: বিবিসি

 

এরপর পত্রিকার প্রথম পাতায় জেনারেল এরশাদের কবিতা নামের লেখাগুলো ছাপা অনেকটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর লেখা প্রথম পাতা থেকে চলে গিয়েছিল ভেতরের পাতায়। তবে এর পরিণাম ভোগ করতে হয়েছিল সাংবাদিক জাহাঙ্গীর হোসেনকে।

এরশাদের কবি হওয়ার বাসনা যখন তুঙ্গে তখন কবিতাকে ঘিরেই চলছিল সামরিক শাসনবিরোধী রাজনীতির লড়াই। একদিকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা সেনাশাসক এরশাদ, যিনি কবিখ্যাতি পাওয়ার জন্য আকুল। অন্যদিকে বিদ্রোহী একদল তরুণ কবি, যাঁরা কবিতাকে পরিণত করে চলেছেন তাঁদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের প্রধানতম অস্ত্রে।

এরশাদও তাঁর রাজকবিদের নিয়ে কবিতা পাঠের আসর বসাতেন। কবিতাকে কবিতা দিয়ে মোকাবিলার চেষ্টা করতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কবিতারই জয় হয়েছিল, তবে সেই কবিতা এরশাদের নয়; সেই সময়ের তরুণ তুর্কি বাংলাদেশের কবিদের। সেই সময়ের আলোচিত অনেক কবিতা ছিল। তারমধ্যে অন্যতম হল মোহাম্মদ রফিকের ‘খোলা কবিতা’ নামের একটি কবিতা। যে কবিতাটি তখন গোপনে হটকেকের মতো বিক্রি হতো। কারণ কবিতাটি নিষিদ্ধ করিয়েছিলেন জেনারেল এরশাদ।

Mohammad Rafik
কবি মোহাম্মদ রফিক এবং তাঁর সেই কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ। ছবি: সংগৃহীত

 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী সাহিত্যের শিক্ষক মোহাম্মদ রফিকের কবিতাটির কয়েকটি পংক্তি এরকম: "সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই, দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই।"

পুরো কবিতাটি ছিল অনেক দীর্ঘ, প্রায় ১৬ পৃষ্ঠা। এটি গোপনে ছাপানো হয় এক ছাপাখানায়। নিউজপ্রিন্টে এক ফর্মায় ছাপানো সেই কবিতা গোপনে বিলি করেন মোহাম্মদ রফিকের ছাত্র-ছাত্রীরা। হাতে হাতে সেই কবিতা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।

মোহাম্মদ রফিক কোনোদিনই জেনারেল এরশাদকে কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। কবি রফিকের ভাষ্য: "সে তো কবি নয়। বাঙালির সবচেয়ে বড় গর্বের জায়গা হচ্ছে কবিতা। কারণ কবিতা চিরকাল বাঙ্গালিকে উদ্বুদ্ধ করেছে। কিন্তু এই কবিতাকে আসলে এরশাদ ধ্বংস করতে চেয়েছে। আমার দেশের একটা চরিত্র আছে। যখন সে জাগে, তখন সে গান শোনে আর কবিতা পড়ে। আর যখন তার অবক্ষয় শুরু হয়, তখন সে কবিতা থেকেও দূরে সরে যায়।"

মোহাম্মদ রফিক মনে করেন, প্রবল পরাক্রমশালী সেনাশাসক জেনারেল এরশাদকে যে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল, তার পেছনে এই কবিতা এক বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল।"

তথ্যঋণ: বিবিসি বাংলা, উইকিপিডিয়া

লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট

 

Link copied!