ইসলামের দৃষ্টিতে গর্ভপাত: “প্রো-চয়েস” নাকি “প্রো-লাইফ”

আল জাজিরা

নভেম্বর ২২, ২০২৪, ০৫:০৮ পিএম

ইসলামের দৃষ্টিতে গর্ভপাত: “প্রো-চয়েস” নাকি “প্রো-লাইফ”

ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে ‘প্রজনন স্বাস্থ্য ও ন্যায়বিচার’ সম্পর্কে একটি জনসচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন পরিচালিত হয়েছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলমান জনগোষ্ঠীকে “প্রজনন অধিকার” সম্পর্কে সচেতন করাই ছিল এই ক্যাম্পেইনের লক্ষ্য। প্রগতিশীল ঘরানার ইসলামি এক সংগঠনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এই ক্যাম্পেইন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমান কমিউনিটির ভেতরে গর্ভপাত বিষয়ে নানামুখী আলাপ-আলোচনাকে উসকে দিয়েছে। 

“প্রো-চয়েস” বনাম “প্রো-লাইফ”

যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক সময়ে গর্ভপাত ইস্যুতে মোটাদাগে দুটি প্রধান ধারা দেখা যায়। একদিকে আছেন “প্রো-চয়েস”-পন্থিরা, যারা ব্যক্তির পছন্দের স্বাধীনতা ও প্রাধান্যে বিশ্বাস করে। অন্যদিকে আছেন “প্রো-লাইফ”-পন্থিরা, যারা প্রতিটি জীবনকে পবিত্র হিসেবে বিবেচনা করে। 

যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ঐতিহাসিক রো বনাম ওয়েড মামলার রায় বাতিল করার ফলে দেশটিতে প্রজনন সংক্রান্ত বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার পেয়েছিল নারীরা অর্থাৎ “প্রো-চয়েস”-পন্থিরা জিতেছিল। তারপর থেকে গর্ভপাতের বিষয়টি দেশটির বিভিন্ন কমিউনিটিতে প্রধান তর্ক-বিতর্ক ও আলাপ-আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। এমনকি সম্প্রতি শেষ হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও এই বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল। বলা হয়ে থাকে যে, যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যকার বিভাজনকে এই ইস্যু আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, গর্ভপাতের পক্ষের ও বিপক্ষের উভয় দলই নিজেদের অবস্থানকে সঠিক ও নৈতিক হিসেবে দাবি করে। এই প্রেক্ষাপটে, গর্ভপাত ইস্যুতে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অব্যাহত নেতিবাচক প্রচারণা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভুল উপস্থাপনা করা হয় বলেও যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানরা মনে করে।  

শিকাগোর ক্যাম্পেইন যারা পরিচালনা করেছে তারা “প্রো-চয়েস”-পন্থি। যুক্তরাষ্ট্রে এদেরকে মূলত সেক্যুলার, প্রগতিশীল ও বাম মতাদর্শের পক্ষের লোক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পশ্চিমা মূল্যবোধের আলোকে এরা সামাজিক ন্যায়বিচারের ধারণা পোষণ করে। ক্যাম্পেইনের উদ্দেশ্য ছিল –এখানকার মুসলমানরাও যাতে এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে গর্ভপাতের ইস্যুটিকে বিবেচনা করে। তারাও যেন “প্রজনন অধিকার”-এর পক্ষে পূর্ণ সমর্থন জানায়। বলাবাহুল্য, আয়োজকরা খুব একটা সাড়া পায়নি। এখানকার মুসলমান জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই মনে করেন যে, গর্ভপাত সম্পর্কে ইসলামের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে এবং তা আরও গভীর। অথচ এই ক্যাম্পেইনে ইসলামি বিশ্বদর্শনের প্রতিফলন ঘটেনি। 

শিকাগো-ভিত্তিক মুসলিম কলেজ দারূল কাসিমের বেশকিছু নারী শিক্ষার্থী এই ক্যাম্পেইনের প্রতিক্রিয়া জানাতে সম্মিলিতভাবে একটি খোলা চিঠি লেখেন। চিঠিতে এই ক্যাম্পেইনের বেশকিছু অসম্পূর্ণতা তুলে ধরা হয়। চিঠিতে বলা হয় যে, গর্ভপাতের মতো জটিল একটা বিষয়কে অতি সরলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, এই খোলা চিঠিটি মুসলমান জনগোষ্ঠীর ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। কেননা, মুসলমানদের মধ্যে একটি আশঙ্কা এই যে, গর্ভপাতের মতো জটিল এক বিষয়ে তাদেরকে “প্রো-চয়েস” ও “প্রো-লাইফ” –এই বাইনারি কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।  

প্রকৃতপক্ষে, ইসলামি আইনের অন্যতম লক্ষ্য জীবন রক্ষা করা। একারণে ইসলাম গর্ভপাতকে পরিপূর্ণভাবে সমর্থনও করে না আবার পরিপূর্ণভাবে এর বিরোধিতাও করে না। অন্যান্য সংবেদনশীল বিষয়ের মতো গর্ভপাত বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও গভীর। নৈতিক বিধান ও ঐশ্বরিক আইনের উপর ভিত্তি করে এই বিষয়ে নির্দেশনা দেয় ইসলাম। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ইস্যুতে যেহেতু ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে তাই বাম কিংবা ডান উভয় শিবির থেকে মুসলমানদের পক্ষে টানার চেষ্টা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে, মুসলমানরা মনে করে টানাটানির বদলে গর্ভপাত সম্পর্কে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি আসলে কী সেটি জানা দরকার এবং এখান থেকে শিক্ষণীয় কিছু আছে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার।

গর্ভপাত সম্পর্কে ইসলাম কী বলে?

পশ্চিমা সেক্যুলার ডিসকোর্সে গর্ভপাত ইস্যুতে ব্যক্তি-স্বাধীনতা বা ব্যক্তির পছন্দের স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। বিপরীতে গর্ভপাত সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি নৈতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক কাঠামো-নির্ভর। গর্ভপাতের ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা কী হবে তা নির্ধারণ করতে মূলত কুরআন ও সুন্নাহর উপর নির্ভর করতে বলে ইসলাম। একই সঙ্গে মাতৃস্বাস্থ্যের অবস্থা ও বিভিন্ন পর্যায়ে ভ্রূণের বিকাশের বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা ও বিবেচনা করা হয়। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে মায়ের কল্যাণ এবং অনাগত জীবন রক্ষা ও এর পবিত্রতাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে সম্মান করা হয়। এটি এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি যা কেবল প্রো-চয়েস ও প্রো-লাইফ –এই দ্বিমুখী রাজনৈতিক বাইনারি দিয়ে বোঝা যাবে না। 

যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্ট মুসলিম পণ্ডিত শায়খ আমিন খলওয়াদিয়া সম্প্রতি দাবি করেন যে, গর্ভপাতের মতো ইস্যুতে প্রগতিশীল নামধারী কিছু লোকের বক্তব্য ও মতামতকে ‘মূলধারার মুসলিম বিবৃতি’ হিসবে ছিনতাই করার চেষ্টা করা হয়। যদিও দেখা যায় যে, এরা বিশ্বব্যাপী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অবস্থানকে প্রতিনিধিত্ব করে না। এমনকি ইসলামের ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রতিফলন এতে ঘটে না। খলওয়াদিয়ার মতে, পশ্চিমের রাজনৈতিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে নয়, গর্ভপাতের মতো বিষয়ে মুসলমানদের অবস্থান ইসলামের সর্বজনীন ও চিরন্তন বিধি-বিধানের উপর ভিত্তি করে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত।

গর্ভপাত ইস্যুতে “প্রজনন অধিকার”-এর যে বয়ান তৈরি করা হয়েছে তা মূলত ব্যক্তি-স্বাধীনতার ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এক্ষেত্রে ইসলামি নৈতিকতার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসলামে মানুষের শরীরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আমানত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই শরীরের যত্ন ও এর ব্যবহার ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা বিবেচনার দ্বারা নয়, ঐশ্বরিক নির্দেশনার দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত বলে মনে করা হয়। এই কারণে মানুষ নিজের শরীর সম্পর্কে যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন, তা কেবল ব্যক্তিগত পছন্দ, ইচ্ছা এবং অধিকারের উপর নির্ভর করে না।

এক্ষত্রে, “প্রো-চয়েস” বনাম “প্রো-লাইফ” –এই বাইনারি অতিক্রম করে ইসলাম একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি হাজির করে। যা আরও সামগ্রিক ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। গর্ভপাতকে যা কেবল ব্যক্তির অধিকার হিসেবে দেখে না। পরিবর্তে, এটিকে পবিত্র নৈতিক কাঠামোর মধ্যে নিহিত বিষয় হিসেবে দেখে। যেখানে মা ও অনাগত সন্তানের অধিকার এবং পরকালে জবাবদিহিতার বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া হয়।  

গর্ভপাত কখন বৈধ হবে বা হতে পারে এবং একটি পরিবার যদি কঠিন গর্ভধারণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হয়, তখন কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত—এসব বিষয়ে ইতোমধ্যেই ইসলামী পন্ডিতরা ইসলামি বিধি-বিধানের আলোকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এই বিধি-নিষেধগুলি গর্ভধারিনী নারী ও অনাগত সন্তানের সামগ্রিক কল্যাণ বিবেচনায় নিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে। যাতে এমন একটি কাঠামো গড়ে ওঠে যাতে সবার কল্যাণ নিহিত থাকে।

শিকাগোর ক্যাম্পেইনও ছিল একই রকম বাইনারি প্রচারণা। এরকম সরলীকৃত সাদা আর কালো বাইনারি দিয়ে ইসলামের অবস্থান বোঝা যাবে না। মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো ইসলামি জ্ঞানের চিরন্তন ও সর্বজনীন নীতিগুলোর আলোকে গর্ভপাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে বোঝা এবং সেই ভিত্তিতে তার সমাধান করা। 

(লেখাটি কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা থেকে নেয়া হয়েছে। এই লেখার দৃষ্টিভঙ্গি লেখকের  নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। মতামত পাতায় লেখাটি লিখেছেন এইচ হাশমি, অনুবাদ করেছেন সোহেল তারেক।) 

Link copied!