জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসের তাৎপর্য ও বাংলাদেশের গ্রন্থাগার উন্নয়ন

এম এ মতিন

ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫, ০১:২৩ পিএম

জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসের তাৎপর্য ও বাংলাদেশের গ্রন্থাগার উন্নয়ন

এম এ মতিন, উপদেষ্টা, গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ ও প্রক্টর, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশুলিয়া, সাভার, ঢাকা –১৩৪১ এবং প্রাক্তন পরিচালক, বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি), সাভার, ঢাকা। ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

বিগত বছরগুলোর মত এবারও সারা দেশে ৫ ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস ২০২৫’। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘সম্মৃদ্ধ হোক গ্রন্থাগার এই আমাদের অংগীকার’। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের আলোকে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি সকল গ্রন্থাগার একযোগে দিবসটি উদযাপন করে থাকে। যেকোন জাতির মেধা-মনন, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক, বাহক ও লালনকারী হিসেবে গ্রন্থাগার গুরুত্বপূর্ণ  ভুমিকা পালন করে। এই দিবস পালনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল স্তরের জনগণ, ছাত্র-শিক্ষক, গবেষক সবাই বইপড়ার গুরুত্ব অনুধাবন এবং  নিজেদের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি করে স্ব স্ব ক্ষেত্রে উন্নততর ফলাফল অর্জন করবেন এবং সার্বিকভাবে জীবনমান ও জাতীয় উন্নতি  ঘটাবেন – এই প্রত্যাশাকে সামনে রেখেই প্রতি বছর এই দিনে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালিত হয়ে থাকে।

তথ্য, সভ্যতা ও উন্নয়নের প্রধানতম চালিকা শক্তি। তথ্যের উপর ভিত্তি করেই মানব সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ক্রমাগত এগিয়ে চলছে। যে জাতি যত বেশী তথ্য ব্যবহার করে – সে জাতি তত বেশী উন্নত ও সভ্য। যেমন – যে জাতি যত বেশী বিদ্যুৎ ব্যবহার করে সে জাতি তত বেশী উন্নত। অনুরূপভাবে এখন মনে করা হয়, যে জাতি যত বেশী ইন্টারনেট ব্যবহার করে সে জাতি তত বেশী অগ্রসর। তবে ইন্টারনেট ব্যবহারের আর এক ধাপ এগিয়ে বিশ্বের অগ্রসরমান দেশগুলো এখন ৫ম শিল্পবিপ্লব (ইন্ডাস্ট্রি-৫) বাস্তবায়নের কাজে ব্যস্ত।

তথ্যের বাহন হচ্ছে পুস্তক, সাময়িকী, দলিলপত্রাদি ও বর্তমানকার ডিজিটাল পাঠসামগ্রী। আর এ সবকিছুর আধার হচ্ছে গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারের কাজ হচ্ছে –প্রয়োজনভিত্তিক তথ্য নির্বাচন ও বাছাই, তথ্য সংগ্রহ, তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও পাঠকের চাহিদা মোতাবেক সেগুলো  বিতরণ।   তথ্য ব্যবস্থাপনার এ সকল কাজ করার জন্যে রয়েছে বিভিন্ন শ্রেণীর গ্রন্থাগার। যেমন –শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগার, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জন্যে বিশেষায়িত গ্রন্থাগার, সকল শ্রেণীর মানুষের জন্যে ব্যবহারযোগ্য গণগ্রন্থাগার এবং জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্যে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত জাতীয় গ্রন্থাগার। বিশ্বের সকল দেশেই এই একই রকম গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। বলা প্রয়োজন, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে উল্লেখিত সকল প্রকার গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা, এ গুলোর সুষ্ঠু পরিচালনা, সর্বোত্তম ও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। গ্রন্থাগারের আবশ্যকতা, এ গুলোর যথাযথ ব্যবস্থাপনা, ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক ও সাধারণ জনগণকে তাদের ঈপ্সিত তথ্য ও সেবা প্রদানের কার্যকারিতা পর্যালোচনা ও ফলাফল ভিত্তিক মূল্যায়নই জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসের মূল প্রতিপাদ্য। জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসে গ্রন্থাগার ব্যবহারকারী, গ্রন্থাগারকর্মী, প্রতিষ্ঠান প্রধান, পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দেশের গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন দিক পর্যালোচনাপূর্বক  জাতীয় উন্নয়নে বিভিন্ন শ্রেণীর গ্রন্থাগারের অবদান,  সফলতা ব্যর্থতা নিরূপণ ও ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারন করবেন –মূলত এই প্রত্যাশাকে সামনে রেখেই জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

অতএব প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, বাংলাদেশের গ্রন্থাগার ও এর ব্যবস্থাপনার সর্বশেষ অবস্থা কী? প্রথমেই আসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারের প্রসঙ্গ। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বাংলাদেশের ৮২,৫৬৬ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগার রয়েছে কিংবা থাকার কথা এবং এগুলোর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছাত্র-শিক্ষক মিলে দুই কোটির বেশি (২,১০,২৯,০৯৯), (ব্যানবেইস-২০২৩)। এ ছাড়া এগুলোতে বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা ও কর্মচারি রয়েছেন যাদের অনেকেই গ্রন্থাগার ব্যবহার করে থাকেন।  অভিজ্ঞতা ও জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশ  ছাত্র-ছাত্রী জানেই না যে তাদের বিদ্যালয়ে একটি গ্রন্থাগার আছে এবং সেখানে বসে বই পড়া যায় কিংবা সেখান থেকে ধার করে বই বাড়ি নিয়ে পড়া যায়। তবে এ কথাও সত্য যে, কিছু অগ্রসরমান শহুরে বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা গ্রন্থাগার ও এর সেবার সাথে ভালোই পরিচিত। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের অবস্থা প্রাথমিকের চেয়ে ভাল। কিন্তু এগুলোর অবকাঠামো ও সংগ্রহ ছাত্র-ছাত্রীদের চাহিদার তুলনায় নিতান্ত অপ্রতুল। একইভাবে কলেজ গ্রন্থাগারগুলোর অবস্থা আর একটু ভাল হলেও প্র্য়োজনের তুলনায় আশানুরূপ নয়। এর পরে আসে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার। সরকারি-বেসরকারি প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার মঞ্জুরি প্রাপ্তির পূর্বশর্ত। তাই বাধ্য হয়েই উদ্যোক্তাদের প্রয়োজন মাফিক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করতে হয়। অন্তত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পরিদর্শন চাহিদা মেটানোর জন্যে। প্রশ্ন উঠতেই পারে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারগুলো কি ছাত্র-শিক্ষক-গবেষকদের তথ্য চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ করতে পারছে? আর বৈশ্বিক মানদন্ড অনুসারে এগুলো কতটুকু মানসম্মত?

শুরু করা যাক প্রাথমিক পর্যায় থেকে। প্রাথমিক শিক্ষা প্রসার ও সর্বজনীন করার কাজে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী ইউনিসেফ ও বিশ্ব ব্যাংকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান আশানুরূপ নয়। প্রতিবেদনে আরো বলেছে যে, প্রতিবেশি শ্রীলংকা ও ভারতের ২য় ও ৩য়  শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরা যা জানে বাংলাদেশের ৫ম শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীরা তা জানে না। আর কলেজ পাশ করা ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় শতকরা ৯০ জন অকৃতকার্য হয় –সংবাদপত্রের পাতায় সে খবর অপ্রিয় হলেও আমাদের দেখতে হয়। 

সুতরাং প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশুনার মান যে আশানুরূপ নয় সে কথা বলাই বাহুল্য। বস্তুত গ্রন্থাগারভিত্তিক পড়াশুনা না করা এর অন্যতম কারণ। গ্রন্থাগার ও তথ্য ব্যবহারের বর্তমান মানদণ্ড হচ্ছে বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক, বৈশ্বিক অর্থনীতি সূচক এবং বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের বৈশ্বিক র‍্যাংকিং ইত্যাদি। এতদসংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এগুলোর কোনটিতেই বাংলাদেশ বতর্মানে সন্মানজনক স্থানে নেই। 

গেল  বছরের বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকের (গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সের) তালিকা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম নলেজ ফাউন্ডেশন (এমবিআরএফ)। এ তালিকায় বিশ্বের ১৫৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম।  টাইমস হায়ার এডুকেশনের বৈশ্বিক বিশ্ববিদ্যালয় সূচক-২০২৩ মতে, বিশ্বের প্রথম ৮০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। এ তালিকায় ভারতের ২৪টি ও পাকিস্তানের ৮টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ইউএনডিপি’র মানব উন্নয়ন সূচক (২০২৩) অনুসারে বিশ্বের ১৯৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১২৯তম। অর্থনীতি সূচকে ১৩৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১৬তম অবস্থানে আছে। বৈশ্বিক উদ্ভাবনী সূচকে ১৩৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০৬তম (২০২৩)। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশনের উদ্ভাবন সূচক-২০২৩ মতে, ১৩২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০৫তম, যা ভারত ও পাকিস্তানের পেছনে। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশন নেটওয়ার্কের মূল্যায়ন রিপোর্ট-২০২৩ মতে, এসডিজি অর্জনে ১৬৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০১তম। (দৈনিক ইনকিলাব,২ নভেম্বর ২০২৩)।

উল্লেখ্য, এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হলে নির্ধারিত সময়ে (২০২৭) বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম লেখানোর সনদ পাবে না। আশা করা যায়, প্রয়োজনীয় সকল চলকে

ঈপ্সিত ফলাফল অব্যাহত রাখতে পারলে ২০২৭ সাল থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে স্বীকৃত হবে।

জ্ঞান-বিদ্যা-লেখাপড়া এবং গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সূচকে বাংলাদেশকে ঈপ্সিত স্থানে নিয়ে যেতে হলে গ্রন্থাগারভিত্তিক পড়াশুনার কোন বিকল্প নেই। শিক্ষার বৈশ্বিক মান অর্জন করতে হলে বিদ্যালয় পর্যায় থেকে  প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও যথোপযুক্ত পাঠসামগ্রী সংগ্রহ নিশ্চিত করে ছাত্র-ছাত্রীদের গ্রন্থাগার ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ  করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখতে হবে। গুণগত শিক্ষা অর্জন তবেই সম্ভব। আগেই বলেছি, আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক অষ্টমাংশ মানুষ শিক্ষায়তন গ্রন্থাগারের অধীন। সুতরাং একে অবহেলা করা আত্নঘাতী। বাংলাদেশের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান, যেগুলো গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট, সেগুলোর গ্রন্থাগার অবকাঠামো, পাঠসামগ্রী, জনবল ও সেবা প্রদানের দিক থেক অগ্রগামী -এক কথা সত্য। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

গণগ্রন্থাগারের অস্তিত্ব বাংলাদেশে প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান। এগুলোর প্রতিষ্ঠাতা স্থানীয় বিদ্যায় উৎসাহী ধনাঢ্য  জমিদার ব্যক্তি। উদাহরণ হিসাবে ঊডবার্ণ পাবলিক লাইব্রেরী, বগুড়া (১৮৫৪), যশোর ইন্সটিটিউট পাবলিক লাইব্রেরী, যশোর (১৮৫৪), বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরী, বরিশাল (১৮৫৪), রাজা রাম মোহন রায় পাবলিক লাইব্রেরী, ঢাকা (১৮৭১), নর্থব্রুক হল লাইব্রেরী, ঢাকা (১৮৮২) ইত্যাদির নাম বলা যেতে পারে। সাধারণ মানুষকে তথ্য ও জ্ঞান প্রদানে এ সকল গ্রন্থাগারের ভূমিকা স্মরণীয় এবং ঐতিহাসিক। 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর জেলায় জেলায় সরকার গণগ্রন্থাগার চালু করে। প্রতি থানা/উপজেলায় গণগ্রন্থাগার স্থাপনের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে বলে জানা যায়। গণগ্রন্থাগারকে বলা হয়, ‘জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়’। আমাদের গণগ্রন্থাগারগুলো দেশের সাধারণ মানুষের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মত জ্ঞানবিস্তারের কাজ কতটা করছে তা আজ এই জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।

সবশেষে আসে জাতীয় গ্রন্থাগার ও জাতীয় আর্কাইভসের কথা। বিশ্বের ছোট বড় সকল দেশেই জাতীয় গ্রন্থাগার ও জাতীয় আর্কাইভস-এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পর সরকার জাতীয় গ্রন্থাগার ও জাতীয় আর্কাইভস প্রতিষ্ঠা করে। এর উদ্দেশ্য হল –জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষার্থে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ব্যবহারের জন্যে দেশ থেকে প্রকাশিত ও দেশ সম্পর্কে বিদেশে প্রকাশিত সকল প্রকাশনার কপি সংগ্রহ করা। আর জাতীয় আরকাইভের কাজ হচ্ছে ইতিহাস ঐতিহ্য ও গবেষণা সম্বলিত শ্রেণিকৃত পুরোনো (২৫ বছরের অধিক) প্রকাশনা ও দলিলাদি সংগ্রহ করা। শের-ই-বাংলা নগরস্থ আগারগাঁওয়ে অবস্থিত সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় আর্কাইভস এবং গ্রন্থাগার নামীয় প্রতিষ্ঠান এই কাজ করছে। প্রকৃত ইতিহাসবিদ ও গবেষকগণই বলতে পারবেন জাতীয় গ্রন্থাগার ও আর্কাইভস জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্যের উপর তথ্য সরবরাহে কতটা সক্ষম?

উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশে সকল প্রকার গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব বিদ্যমান। বৈশ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এর বিকল্প নেই। কিন্তু মানের দিক থেকে আমাদের অবস্থান কোথায় তা নির্ধারণের সময় এসেছে। জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস সেই দাবিই করে। আমরা আমাদের গ্রন্থাগার ব্যবস্থাকে কিভবে মূল্যায়ন করতে পারি? পুস্তক পাঠ, ইন্টারনেটে তথ্য অনুসন্ধান ও ব্যবহার যে কারও জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির সহায়ক। জ্ঞান বৃদ্ধি না হলে পুস্তক পাঠ, গ্রন্থাগার ব্যবহার, ইন্টারনেট সার্চিং সবই নিরর্থক। তবে জ্ঞানের যে উন্নতি বা প্রবৃদ্ধি ঘটছে তা কিভাবে বুঝা যায়? এর বৈশ্বিক পদ্ধতি হচ্ছে –জ্ঞান সূচকে কোন দেশ বা জাতির অবস্থান কোথায়? বৈশ্বিক বিভিন্ন সূচকের আলোকে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, গবেষণা, গ্রন্থাগার ব্যবস্থা এ সব কিছুতেই সংস্কার আনা প্রয়োজন।

করণীয়ঃ

প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলাদেশকে একটি সন্মানজনক স্থানে নিয়ে যেতে হলে বৈশ্বিক বিভিন্ন সূচকে অগ্রসর হতে হবে। সে লক্ষ্যে  শিক্ষার  সর্বস্তরে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম ব্যবহার বৃদ্ধি করে পড়াশুনার লক্ষ্যভিত্তিক

 গুণগত মান বাড়াতে হবে। পড়াশুনার মান তখনই বৃদ্ধি পাবে যখন ছাত্রছাত্রীরা নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি গ্রন্থাগারে গিয়ে বিষয়সংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত রেফারেন্স বই পড়ে নিজেদের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। সেই সাথে অনলাইনে শিক্ষক প্রদত্ত ওয়েবসাইট (একাধিক হতে পারে) ব্রাউজ করে নিজের জ্ঞানস্তরকে সমৃদ্ধ করবেন। এ অবস্থায় জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসে আমাদের পরামর্শ  হচ্ছে –ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যপুস্তক ও গ্রন্থাগারভিত্তিক পড়াশুনায় মনোনিবেশ করানো –শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পড়াশুনার সম্পর্ক দৃঢ়তর করা এবং স্মার্টফোনকে অর্থবহ কাজে লাগানো। প্রতিটি স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসায় অনুমোদনের শর্তানুযায়ী যথানিয়মে গ্রন্থাগার পরিচালনা এবং সরকারী নির্দেশ মোতাবেক এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা। এ ছাড়া সরকার নির্দেশিত লক্ষ্যভিত্তিক শিক্ষা (ওবিই) বাস্তবায়নের জন্যে ছাত্রছাত্রীদের  গ্রন্থাগারের প্রতি উৎসাহিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সর্বস্তরে লক্ষ্যভিত্তিক গুণগত শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্যে অগ্রাধিকারভিত্তিতে নিন্মোল্লেখিত বিষয়গুলো সরকার বিবেচনা করতে পারেন:  

  • শিক্ষাখাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা। জিডিপি’র ২.৫% - ৩.০০% করা যায় কিনা, (চলতি অর্থবছরে শিক্ষাখাতে ব্যয় জিডিপি’র ১.৮৩%); 

  • প্রতিটি গ্রন্থাগারের বাজেট থাকা প্রয়োজন এবং পর্যালোচনাপূর্বক প্রতি বছর তা বৃদ্ধি করা; 

  • স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা পর্যায়ের গ্রন্থাগার পরিচালনায় বিদ্যমান পরিবীক্ষণ পদ্ধতি নিবিঢ়তর করা;  

  • এমপিও’ভুক্তির সময়ে প্রতিষ্ঠান কতৃপক্ষকে যে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে তা মেনে যথানিয়মে গ্রন্থাগার পরিচালনা করা। সেই সাথে প্রতিটি গ্রন্থাগারে ইন্টারনেট সুবিধাসন্বলিত কম্পিউটার সরবরাহ করা। 

  • সরকার নির্দেশিত বিদ্যালয়সমূহে বর্তমানকার প্রচলিত লাইব্রেরী ক্লাশ কার্যক্রম নিশ্চিত ও জোরদার করা; এতে ছাত্র-ছাত্রীদের গ্রন্থাগার ব্যবহারে আগ্রহ বাড়বে;  

  • বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয় গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিকের শূন্য পদ পূরণ করা;  

  • বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধির জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা; বৈশ্বিক র‍্যাংকিং এ যথাস্থানে (উচ্চস্থান) অধিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের নিয়ে টার্মস অব রেফারেন্সসহ একটি সেল তৈরি করা এবং এর কার্যক্রম পরিবীক্ষণ করা; এবং 

  • ওবিই বাস্তবায়নের মাধ্যমে গুণগত শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে সর্বাত্নক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস ২০২৫’ সফল হোক। 

 

লেখক: উপদেষ্টা, গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ ও প্রক্টর, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশুলিয়া, সাভার, ঢাকা –১৩৪১ এবং প্রাক্তন পরিচালক, বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি), সাভার, ঢাকা। 

ইমেইল: amatin.aub@gmail.com

Link copied!