ড. রেজা কিবরিয়া নামটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন নয়। অর্থনীতিবিদ, আন্তর্জাতিক সংস্থায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতা…আর সবচেয়ে বড় পরিচয়, বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে।
কিন্তু তার পরিচয় এখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে “দল বদল” বা ’রাজনৈতিক ডিগবাজি’র ইতিহাস উঠলে যে কয়জনের নাম প্রথমে উঠে আসবে রেজা কিবরিয়া তাদের মধ্যে অন্যতম।
২০১৮ সাল থেকে ২০২৫ এই ৭ বছরে চারবার দল পরবির্তন করে আলোচনায় উঠে এসেছেন রেজা কিবরিয়া।

২০১৮ সাল। আর্ন্তজাতিক দাতা সংস্থা ‘আইএমএফ’ এ দীর্ঘদিন চাকরির পর দেশে ফিরে রাজনৈতিক ময়দানে নামার সিদ্ধান্ত নিলেন রেজা কিবরিয়া। প্রথম গন্তব্য—গণফোরাম। সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেনের দল। তখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জোটের অধীনে এক নতুন রাজনৈতিক জোয়ার চলছে দেশে। দলে যোগ দিয়েই গণফোরামের প্রার্থী হয়ে ভোট করলেন বিএনপির প্রতীক ‘ধানের শীষ’ নিয়ে।
নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী তিনি হবিগঞ্জ-১ আসনের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন ওই নির্বাচনে। ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে রেজার বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালায় এবং নির্বাচনের জন্য ছাপানো তার পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে ও কাগজপত্র জব্দ করে নিয়ে যায়।
ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ৮৫ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে পরাজিত হন তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজের কাছে। যিনি ভোট পেয়েছিলেন ১ লাখ ৫৮ হাজার।

নির্বাচনের পর রেজা কিবরিয়াকে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক করা হলে তা নিয়ে দলে বিতর্ক ও সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়।
পরে ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে তিনি গণফোরাম ত্যাগ করেন। তবে দল ত্যাগ করলেও জানিয়েছিলেন যে তিনি রাজনৈতিক জীবন ত্যাগ করেননি।
২০২১ সালে রেজা কিবরিয়া আবার হাজির হন দৃশ্যপটে। একেবারে নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম নিয়ে। তৎকালীন ডাকসুর আলোচিত ভিপি নুরুল হক নুরকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করেন গণ অধিকার পরিষদ। নতুন দল, নতুন ভাষা, নতুন পোস্টার, আর নতুন স্বপ্ন। ছিল ক্ষমতায় যাওয়ার রোডম্যাপও।
তবে অচিরেই দেখা দিল সংকট: কে আসল নেতা? দলের দিক কোনদিকে যাবে? এক দল নুরের পাশে, অন্য দল রেজার পাশে। রেজা কিবরিয়া আবারো দেখলেন, দরজার বাইরে যাওয়ার পথটা তার জন্যই বানানো। এবং… তিনি গেলেন।

যে গতিতে নতুন এই দলের শুরু হয়েছিল অনেকটা একই গতিতে দল থেকে সরে আসলেন রেজা কিবরিয়া।
২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে গণঅধিকার পরিষদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরে নিজেদের দ্বন্দ্বে দলটি দুই ভাগ হয়ে যায়।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক পদ থেকে সরে যান রেজা কিবরিয়া।
পরবর্তীতে রেজা কিবরিয়ার অংশের নেতৃত্বে আসেন মিয়া মশিউজ্জামান ও ফারুক হাসান। আট মাস পর ২০২৪ সালে আবারও গণঅধিকার পরিষদে (মশিউজ্জামান) ফিরে আসেন রেজা কিবরিয়া। তাঁকে গণঅধিকার পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ঘোষণা করেন তৎকালীন আহ্বায়ক কর্নেল (অব.) মিয়া মশিউজ্জামান।


পরবর্তীতে এই অংশটি গণঅধিকার পরিষদ নামে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন না পেয়ে ’আমজনতা দল’ নামে নিবন্ধন নেয়। যদিও আমজনতার দলের সাথে রেজা কিবরিয়ার সরাসরি কোনো জনংযোগ দেখা যায় নি, তবে দলটির নেতারা পরিচয় দিতেন, রেজা কিবরিয়া তাদের ’প্রধান উপদেষ্টা’।
এবার ২০২৫ সালে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আগে আগের সব দল ছেড়ে সরাসরি বিএনপিতে যোগ দিলেন রেজা কিবরিয়া।
পহেলা ডিসেম্বর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের হাতে ফুল তুলে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেন রেজা কিবরিয়া।
রেজা কিবরিয়াকে স্বাগত জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, “আজ দেশের একজন অত্যন্ত মেধাবী ও বিশিষ্ট সন্তান আমাদের দলে যোগ দিলেন। তিনি নিজের যোগ্যতায় আইএমএফ এর উচ্চ পদে কাজ করেছেন। দেশে ফিরে ২০১৮ সালে গণফোরামের হয়ে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করেছেন।
পরবর্তীকালে তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। ড. রেজা কিবরিয়া আজ আমাদের দলে যোগ দেওয়ায় আমরা অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে তাকে আনুষ্ঠানিক স্বাগত জানাচ্ছি।”
২০১৮ সালের নির্বাচনে রেজা কিবরিয়া হবিগঞ্জ-১ (বাহুবল–নবীগঞ্জ) আসনে ধানের শীষ প্রতীকে লড়েছিলেন। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি একই আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আগ্রহী। বিএনপি যে ২২৭ আসনের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে হবিগঞ্জ-১ আসনটি এখনো শূন্য রাখা হয়েছে।

বিএনপিতে যোগ দিয়ে কী বললেন রেজা কিবরিয়া?
তিনি বলেন, “বিএনপিতে যোগ দিতে পেরে আমি অত্যন্ত গর্বিত। আজ আমি আনুষ্ঠানিকভাবে এই দলে যুক্ত হলাম। এই দলের ইতিহাস মানেই গণতন্ত্রের ইতিহাস। দুই দফায় ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের হাত থেকে তারা গণতন্ত্র রক্ষা করেছে।”
জিয়াউর রহমানকে নিজের আদর্শ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন,“একটি দল দুইবার বহুদলীয় গণতন্ত্র রক্ষা করেছে—বিশ্ব ইতিহাসে এমন উদাহরণ খুব কমই পাওয়া যায়। এই কারণেই বিএনপির প্রতি আমার আকর্ষণ জন্মেছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আমার আদর্শ।”
বর্তমান বিএনপি নেতৃত্ব নিয়ে তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব ও সিনিয়র নেতারা দেশের নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন পূরণ করতে সক্ষম হবেন। তাদের ভিশন আগের মতো নয়—দেশ বদলে গেছে, আর এখন সময় নতুন ভাবনায় এগিয়ে যাওয়ার।”
তারেক রহমানকে নিয়ে রেজা কিবরিয়া বলেন, “ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের রক্তের মান, আপনারা ভাবতে পারেন তিনি কী পরিবার থেকে এসেছেন। এটি ইনক্রিডিবল। এমন ‘ব্লাডলাইন’ বাংলাদেশে আর কারও নেই। আমরা সবাই তাকে সহযোগিতা করব নতুন বাংলাদেশ গড়তে।”
৭ বছরে চারবার দল পরিবর্তন করা রেজা কিবরিয়াকে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন প্রশ্ন—বিএনপি কি তার শেষ ঠিকানা?
নাকি সামনে আরও কোনো চমক অপেক্ষা করছে?
এটা সময়ই বলবে।