কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গের চাবুক আবুল মনসুর আহমদ

নাফিস সাদিক

মার্চ ১৮, ২০২১, ০৬:৩৪ পিএম

কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গের চাবুক আবুল মনসুর আহমদ

শুধু বাংলাদেশ নয়, এই পুরো উপমহাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ, সংকটময় এবং জাগরণের দিনে জন্ম নিয়েছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। উনিশ শতকের একবারে শেষ দশকে জন্ম নিয়ে তিনি দেখেছেন বিশ শতকের তিন-চতুর্থাংশ। দীর্ঘ ৮১ বছরের (১৮৯৮-১৯৭৯) জীবনে খিলাফত আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এবং সবশেষে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ পথকে তিনি অবলোকন করেছেন। তাঁর এই দেখা শুধু দূর থেকে দেখা নয়, বরং অনেক আন্দোলনে তিনি সরাসরি সংযুক্তও থেকেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক উত্থানপতনকে তিনি যেমনিভাবে দেখেছেন, তেমনিভাবে এই অঞ্চলের মানুষের জীবনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার এবং চিন্তাধারার ক্রমপরিবর্তনকেও তিনি নিষ্ঠার সাথে লক্ষ করেছেন। আজ ১৮ মার্চ তার প্রয়াণ দিবসে স্মরণ করছি শ্রদ্ধার সাথে।

আবুল মনসুর আহমদ একজন বহুল পরিচয়ের মানুষ। একদিকে ছিলেন সাংবাদিক। ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’, ‘দি মুসলমান’, ‘সওগাতে’র মতো পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থেকে এক সময় তিনি ‘দৈনিক কৃষক’ এবং ‘দৈনিক ইত্তেহাদে’র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ময়মনসিংহ এবং কলকাতায় আইন ব্যবসার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন বহুদিন। দীর্ঘদিন মুসলিম লীগের সাথে যুক্ত থাকার পর দেশভাগের পর তিনি ‘আওয়ামী মুসলিম লীগে’ যোগ দেন।

আবুল মনসুর আহমদ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী এবং ১৯৫৭ সালে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগ সরকারের কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী ছিলেন।

সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ- এ পরিচয়গুলোর বাইরে তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হল তিনি একজন ‘সাহিত্যিক’। সমাজ এবং পরিপার্শ্বের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক কুসংস্কার, বিরোধ, ভণ্ডামি এবং ধর্মব্যবসার বিপক্ষে তিনি সারাজীবন সোচ্চার ছিলেন। সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মানুষের এই বিভ্রম এবং বিপথগামিতাকে যেমন লক্ষ্য করেছেন, একইসাথে তা হাস্যরসের মাধ্যমে পাঠকের সামনে তুলে ধরে তার অন্তর্নিহিত বেদনাটুকু পাঠকের হৃদয়ে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন। এজন্যই তাঁর পক্ষে ‘আদুভাই’য়ের মতো সূক্ষ্ম রসবোধসম্পন্ন সুপরিচিত হাস্যরসের গল্প লেখা যেমন সম্ভব হয়েছে, একইসাথে সমাজে জেঁকে বসা পীরপ্রথার কুৎসিত দিকগুলোকে যথাযথ রূপে উপস্থাপন করতে ‘হুযুর কেবলা’র মতো কালজয়ী শক্তিশালী গল্পও তিনি লিখতে পেরেছেন।

তাঁর সময়ের এতটা বছর পেরিয়ে এসেও তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোকে এখনও সমাজে দেখা যায়। হাস্যরসের মাধ্যমে স্বরূপ প্রকাশ করে তাদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের ঝংকার তিনি তুলেছিলেন, তার প্রয়োজনীয়তা এতদিন পরেও আমরা প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি। এজন্যই তাঁর রচিত সাহিত্য চিরকালীন এবং বর্তমান সময়ে এসেও অতিমাত্রায় প্রাসঙ্গিক। এভাবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সমস্ত পরিচয়ের উর্ধ্বে তাঁর ‘সাহিত্যিক’ পরিচয়টিই ক্রমশ মুখ্য হয়ে উঠছে।

আবুল মনসুর আহমদের সাহিত্য

রাজনীতি, সাংবাদিকতা এবং আইন পেশার ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে ফাঁকে আবুল মনসুর আহমদ বাংলা সাহিত্যে তাঁর রচনার যে সম্ভার রেখে গিয়েছেন তা রীতিমত বিস্ময়কর। তিনটি উপন্যাস, চারটি ছোটগল্পের (ব্যঙ্গরচনা) সংকলন, পাঁচটি স্মৃতিকথা ও প্রবন্ধগ্রন্থের পাশাপাশি শিশুকিশোর উপযোগী সাহিত্য এবং অনুবাদ সাহিত্যেও তাঁর অবদান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে তাঁর সব রচনার মধ্যে তাঁর ব্যঙ্গরচনা বাংলা সাহিত্যে ব্যাপকভাবে সমাদৃত এবং অন্য সব রচনাকে বাদ রাখলেও তাঁর এই ব্যঙ্গরচনাগুলোর জন্য তিনি বাংলাসাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

১. ব্যঙ্গরচনা থেকে উপন্যাস

ময়মনসিংহের ত্রিশালে ‘ফরাযী’ বংশে ১৮৯৮ সালে আবুল মনসুর আহমদের জন্ম হয়। ওই অঞ্চলে মোহাম্মদী ঐতিহ্যের ধারক ছিল ফরাযী পরিবার। জীবনকালে তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘আত্মকথা’য় (১৯৭৮) তিনি তাঁর পারিবারিক পরিবেশের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘ফরাজী পরিবারের আনুষ্ঠানিক ধার্মিকতার পরিবেশে আমার জন্ম। বুদ্ধি হওয়ার সাথে সাথেই দেখেছি নামায রোজার ধুম। সুরুজ উঠার দুই ঘণ্টা আগেই দাদাজী খোশ ইলহানে বুলন্দ আওয়াযে আযান দিতেন। তাঁর আযান আশে পাশের দু’চার গ্রামের লোক শুনিতে পাইত। লোকে বলাবলি করিতঃ ‘ফরাযী সাবের আযানই আমাগর ঘড়ি।’ দাদাজীর আযানে আমাদের বাড়ির সকলেই জাগিয়া উঠিতেন।’’

পাঁচ বছর বয়সে তিনি কোরআন খতম করেন। শৈশবে ধর্মকর্মে তিনি অত্যধিক মনোযোগী এবং উৎসাহী হয়ে পড়েন। রাত জেগে নফল ইবাদাত করতে করতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিজের ‘টুপি নিষ্ঠা’ সম্পর্কে ‘আত্মকথা’য় তিনি লিখেছেন, ‘টুপি ছাড়া আমি কোথাও যাইতাম না, স্কুলে-মকতবে তো নয়ই। ক্লাশে কখনও মাথা হইতে টুপি নামাইতাম না। আমার টুপিটা ছিল লাল তুর্কী টুপি।’

শৈশবে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে পড়ার সময় কয়েকজন গুণী মানুষের সংস্পর্শে এসে আবুল মনসুর আহমদের মধ্যে উদারতা জন্ম নেয়। চারপাশের ধর্মীয় কুসংস্কার এবং অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে তিনি সচেতন হয়ে ওঠেন। এই সচেতনতা তাঁর ধর্মবিশ্বাসকে দুর্বল না করে বরং আরও দৃঢ় করেছিল।

আবুল মনসুর আহমদ রচিত সর্বাধিক সমাদৃত ব্যঙ্গগল্পের সংকলন ‘আয়না।’ ১৯৩৫ সালে এ গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় এবং লেখকের জীবদ্দশাতেই এ বইটির সাত-আটটি সংস্করণ বের হয়েছিল। ‘আয়না’র বেশির ভাগ গল্পই ১৯২২ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে রচিত এবং ‘সওগাত’ পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে তা প্রকাশিত হয়। তৎকালীন সমাজের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় কুসংস্কারগুলোকে যথার্থরূপে প্রতিফলিত করে ‘আয়না’ বাংলা সাহিত্যের ব্যঙ্গরচনায় একটি অনন্য সংযোজন।

‘আয়না’ গল্পগ্রন্থের ভূমিকায় আবুল মনসুর আহমদের বন্ধুবর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘...ব্যঙ্গ-সৃষ্টিতে অসাধারণ প্রতিভার প্রয়োজন। এ যেন সেতারের কান মলে সুর বের করা- সুরও বেরুবে, তারও ছিঁড়বে না। ... ভাষার কান মলে রস-সৃষ্টির ক্ষমতা আবুল মনসুরের অসাধারণ। এ যেন পাকা ওস্তাদী হাত।’ আবার ‘আয়না’ গ্রন্থটি লেখক তাঁর আরেক বন্ধু সুসাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীনকে উৎসর্গ করে উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছেন, ‘বন্ধুরা বলছেন, এই বইয়ে আমি সবাইকে খুব হাসিয়েছি। কিন্তু এই হাসির পেছনে যে কতটা কান্না লুকানো আছে, তা তুমি যেমন জান, তেমন আর কেউ জানে না।’ এ থেকেই পরিষ্কার হয় যে, আবুল মনসুর আহমদ নিছক ব্যঙ্গরসে পাঠকদেরকে আমোদিত করার উদ্দেশ্যে এ গল্পগুলো লেখেন নি বরং সমাজের কুসংস্কারের এবং গোঁড়ামির বিরুদ্ধে পাঠক হৃদয়ে সচেতনতা সৃষ্টিই ছিল তাঁর সাহিত্যের মুখ্য উদ্দেশ্য।

আবুল মনসুর আহমদ ‘আয়না’র সাতটি গল্পের বেশিরভাগেই ধর্মকে আশ্রয় করে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। ‘আয়না’র গল্পগুলোতেও ব্যঙ্গের মাধ্যমে সমাজের ধর্মীয় ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অনেকে আপন স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কিভাবে কাজে লাগায়, তার সরস বর্ণনার মাধ্যমে লেখক পাঠকের অন্তরে নাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ‘লীডারে-কওমে’, ‘নায়েবে নবী’ অথবা ‘মুজাহেদিনে’র মতো গল্পগুলো তাঁর এ প্রচেষ্টারই সার্থক ফসল।

‘আয়না’ শিরোনামে এ গল্পগ্রন্থটিতে কোনো নামগল্প নেই। লেখক ‘আয়না’য় এমন এক প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করতে চেয়েছেন যাতে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ নিজেই তার যথাযথ রূপটি দেখতে পায়।

১৯৪৪ সালে প্রকাশিত পরবর্তী ব্যঙ্গরচনার সংকলন ‘ফুড কনফারেন্সে’ আবুল মনসুর আহমদ মানুষের অসহায়তা নিয়ে খেলা করা রাজনৈতিক নেতা, নীতিহীন ব্যবসায়ী এবং তথাকথিত সমাজসেবকদের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। বাংলা ১৩৫০ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় সেই সময়ের নেতারা যে ব্যর্থ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং দুর্ভিক্ষ দূরীকরণে তাদের সকল কর্মকাণ্ড যে মিটিং- কনফারেন্সেই সীমাবদ্ধ ছিল, তা এ গ্রন্থের নামগল্প ‘ফুড কনফারেন্সে’ লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্পে খাদ্য নিরসনের উদ্দেশ্যে আহ্বান করা সভায় সভাপতির পদ অলংকৃত করেছেন শেরে বাংলা। শেরে বাংলার পাশে মঞ্চ অলংকৃত করেছেন মহিষে বাংলা, সিংগিয়ে বাংলা, টাট্টুয়ে বাংলা, গরুয়ে বাংলা, গাধায়ে বাংলা, পাঠায়ে বাংলাসহ আরও অনেকে। গ্রাণ্ড হোটেলে ফুড কমিটির বৈঠক আয়োজন করা হয়েছে এবং বৈঠক শেষে উপস্থিত সকলের জন্য বিশাল খানাপিনার আয়োজন করা হয়েছে। দীর্ঘক্ষণের বৈঠক শেষে সকল নেতা- পাতিনেতার স্বার্থসিদ্ধি করে তারা বের হয়ে দেখলেন, দেশের সকল গরীব দুঃখী, ফকির মিসকিন- ইতোমধ্যে মারা গেছে। এ মৃত্যু পশুদেরকে ব্যথিত না করে বরং উল্লসিত করে তুলল।

গল্পের শেষাংশটা আবুল মনসুর আহমদ বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘সবাই সে হাসিতে যোগ দিলেন। শুধু ছাগলে বাংলাটা দাড়ি নেড়ে বললেন: তা হল বটে, কিন্তু শেরে বাংলা হাতিয়ে বাংলা প্রভৃতি শুধু জানোয়ারে বাংলারাই আমরা বেঁচে রইলাম। মানুষে বাংলারা যে সবাই মারা গেল।

সে কথায় কেউ কান দিলেন না। বরঞ্চ সকলে সমস্বরে আসমান ফাটিয়ে জয়ধ্বনি করলেন: জানোয়ারে বাংলা জিন্দাবাদ!

গড়ের মাঠের ওপর পাশের ফোর্টের দিক থেকে প্রতিধ্বনি হল: মানুষে বাংলা মুর্দাবাদ।’

মানুষের দুরবস্থা দূরীকরণের মহান দায়িত্ব যাদের উপর পতিত হয়েছিল, তারা কিভাবে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে গরীব, দুঃখী, অসহায়দের বঞ্চিত করেছে, তার নির্মম করুণ বয়ান এই গল্পটির ন্যায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে এ গল্পগ্রন্থের ‘রিলিফ ওয়ার্ক’, ‘লঙ্গরখানা’, ‘গ্রো মোর ফুডে’র মত গল্পগুলোতেও।

১৯৫৭ সালে প্রকাশিত আরেক ব্যঙ্গরচনার সংকলন ‘আসমানী পর্দা’য় আবুল মনসুর আহমদ পাকিস্তানি শাসনামলে চরিত্র ঠিক রাখার জন্য নারী পুরুষ নির্বিশেষে যে হাস্যকর পর্দাপ্রথা প্রচলনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তাকে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। এ গ্রন্থের অন্যান্য গল্প ‘খাজাবাবা’, ‘নিমক হারাম’ প্রভৃতি গল্পেও স্বার্থন্বেষী মানুষের আপন স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত কূটকৌশলের উন্মোচনের মাধ্যমে তাদের প্রতি লেখকের ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে। ‘আদুভাইয়ে’র মতো অসাধারণ রস রচনাটিও এ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত।

আবুল মনসুর আহমদের সর্বশেষ ব্যঙ্গরচনার সংকলন ‘গালিভরের সফর নামা’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। পাকিস্তানি শাসনামলের রাজনীতির নানা ত্রুটি বিচ্যুতিসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের অনিয়ম এবং বিশৃঙ্খলার প্রতিফলন ঘটিয়ে এটি মূলত একটি রাজনৈতিক ব্যঙ্গ।

আবুল মনসুর আহমদ রচিত তিনটি উপন্যাস ‘সত্যমিথ্যা’ (১৯৫৩), ‘জীবনক্ষুধা’ (১৯৫৫) এবং ‘আবে হায়াতে’ও (১৯৬৪) তৎকালীন সমাজের চিত্র অঙ্কন করার পাশাপাশি সেই সময়ের কুসংস্কারাচ্ছন্নতা এবং পশ্চাৎপদতার বিরুদ্ধেও জেগে ওঠার ডাক দিয়েছেন। ‘জীবনক্ষুধা’ রচনার দিক থেকে প্রথম হলেও প্রকাশের দিক থেকে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস। হালিম চরিত্রের মাধ্যমে লেখক এ উপন্যাসে বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের জীবনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং উচ্চাশার স্বরূপ ফুটিয়ে তুলেছেন। উচ্চবিত্ত হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে এক তরুণের আদর্শচ্যুতির বর্ণনার পাশাপাশি একটা সময়ের বাঙালি মুসলমান সমাজের ধারাবাহিক গল্প এখানে বর্ণিত হয়েছে।

জোহান বোয়ারের ‘দি পাওয়ার অব লাই’ অনুসরণে রচিত আবুল মনসুর আহমদের ‘সত্যমিথ্যা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। লেখকের অসামান্য অনুবাদ দক্ষতায় গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত এ উপন্যাসে বিদেশি লেখার কোনো ছোঁয়া পাওয়া যায় না। ব্যাংক ঋণ নিয়ে আমির আলীর সঙ্গে তাঁর যামিনদার ওসমান সরকারের সম্পর্কের অবনতি ঘটার কারণ বিশ্লেষণের পাশাপাশি দুই পরিবারের সদস্যদের আপন গল্পে এ উপন্যাসটি বিধৃত হয়েছে।

আবুল মনসুর আহমদ রচিত সর্বশেষ উপন্যাস ‘আবে হায়াত’ (১৯৬৪) এ রক্ষণশীল পীর পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেও শিক্ষার সংস্পর্শে এসে পীরপুত্র হামিদের সংস্কারহীন ও যুক্তিবাদী হয়ে ওঠার গল্পের মাধ্যমে সমাজের ক্রমরূপান্তরের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।

আবুল মনসুর আহমদের উপন্যাস তিনটি বিশ শতকের প্রথম অর্ধে বাঙালি মুসলমান পরিবার ও সমাজের অমূল্য প্রতিফলন। সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্ম বাণিজ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর লেখায় মূলত পারিপার্শ্বিক সমাজকে প্রতিফলিত করেছেন। সমাজের কাঠমোল্লা, ধর্ম ব্যবসায়ী, স্বার্থসন্ধানী রাজনীতিবিদসহ তৎকালীন সমাজের সকল অসঙ্গতিকে তিনি তাঁর লেখায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।

২. চরিত্র এবং পরিবেশের পরিপূর্ণ পরিস্ফুটনে শব্দ ও ভাষার যথাযথ প্রয়োগ

খুব সহজ ভাষায় কথা বলে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করা অনেক সময় দুরূহ হয়ে পড়ে। কিন্তু কথার মাঝে দুর্বোধ্যতা থাকলে তা মানুষের মনোযোগ আকর্ষণে যথেষ্ট সহায়ক হয়। এজন্যই হয়তো বা আমাদের সমাজের ধর্মব্যবসায়ীগণ তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের সময় কথার মাঝে প্রচুর পরিমাণে আরবী-ফারসী শব্দের ব্যবহার করেন এবং সাধারণ মানুষ সে সব শব্দ অনেক সময় না বুঝেই মুগ্ধ হয়ে নিজেদের তাদের কাছে সঁপে দেয়। সমাজের ধর্ম ব্যবসায়ীদের এই চিরকালীন কৌশল এবং সাধারণ মানুষের ধর্মব্যবসায়ীদের কাছে নিঃসঙ্কোচ আত্মসমর্পণের দিকটি আবুল মনসুর আহমদ খুব ভালোভাবে অনুভব করেছিলেন।

সাহিত্যে পরিস্থিতির যথার্থ বর্ণনার উদ্দেশ্যে শব্দের ব্যবহারে বিশেষ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন আবুল মনসুর আহমদ। আরবী-ফারসি ভাষায় গুরু গাম্ভীর্য্য প্রকাশের পাশাপাশি সময়ের প্রয়োজনে সব ধরনের শব্দের যথার্থ প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তিনি। তাঁর সমগ্র সাহিত্যে তাই সমাজের অসঙ্গতিকে প্রতিফলিত করে মানুষের হৃদয়ে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়।

৩. বর্তমান সময়ে আবুল মনসুর আহমদের সাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা

সাম্প্রতিক সময়েও যে কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় কিংবা রাজনৈতিক সংকটে আমাদের মেয়র-মন্ত্রীদের ভূমিকার সঙ্গে আবুল মনসুর আহমদের ‘ফুড কনফারেন্সে’র ‘জানোয়ারে বাংলা’র মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মূল সমস্যা নিরসনের দিকে নজর না দিয়ে তাদের বরং সংকটের পিছনের নানাবিধ কারণ আবিষ্কার এবং সমস্যাটিকে অস্বীকার করার দিকেই ঝোঁক বেশি।

আবার সমগ্র বিশ্বজুড়ে উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও ফ্যাসিবাদের উত্থান যখন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে (আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প, ব্রিটেনে বরিস জনসন অথবা ভারতে নরেন্দ্র মোদির মতো কট্টরপন্থী শাসকদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়া অন্তত তাই-ই নির্দেশ করে), তখন আবুল মনসুর আহমদের ব্যঙ্গরচনার তাৎপর্য নতুন করে অনুভব হচ্ছে।

সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্ম নিয়ে বাণিজ্য এখনও আমাদের সমাজের ভয়াবহ দু'টি সমস্যা। পাশাপাশি মত প্রকাশের স্বাধীনতা যখন ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে, তখন আমাদের প্রতিবাদের ভাষায়ও পরিবর্তন আনা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ছে। এক্ষেত্রে আবুল মনসুর আহমদের ব্যঙ্গ-সাহিত্য আমাদের সামনে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি যেভাবে পশু- প্রাণির রূপকে সমাজের সমস্যাকে প্রতিফলিত করেছেন অথবা তাঁর অনুজ সাহিত্যিক শওকত ওসমান যেভাবে পাকিস্তানি শাসনামলের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ‘ক্রীতদাসের হাসি’তে ‘আরব্য রজনী’র মত রূপকের আশ্রয় নিয়েছিলেন, তা আমাদের সামনে প্রয়োজন সাপেক্ষে পাথেয় হয়ে থাকবে।

আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন একজন সমাজ সচেতন এবং জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্যিক। সমাজের সকল অপসংস্কৃতি এবং কুসংস্কার নিজে অনুভব করার পাশাপাশি তা সাহিত্যের পাঠকদের সামনে উন্মোচিত করার মহান দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। ব্যঙ্গ এবং বিদ্রুপের মাধ্যমে মূলত সমাজ, জাতি এবং রাষ্ট্রকে জাগিয়ে তোলার প্রয়াস চালিয়েছেন আজীবন। তাই বর্তমান সময়ে এসে আবুল মনসুর আহমদ চর্চা আমাদের জন্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

গ্রন্থপঞ্জি এবং তথ্যসূত্র

১. আবুল মনসুর আহমদ, ‘আয়না’ (প্রথম প্রকাশ-১৯৩৫)।

২. আবুল মনসুর আহমদ, ‘আত্মকথা’ (ঢাকা, ১৯৭৮)

৩. রাজীব হুমায়ূন, ‘আবুল মনসুর আহমদের ব্যঙ্গরচনা’ (জুন ১৯৮৫, বাংলা একাডেমি, ঢাকা)।

৪. ইমরান মাহফুজ সম্পাদিত, কালের ধ্বনি দুর্লভ কথক আবুল মনসুর আহমদ (ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)।

৫. আবুল মনসুর আহমদ, ‘গালিভরের সফরনামা’ (ঢাকা, ১৯৫৯)।

৬. আবুল মনসুর আহমদ, ‘ফুড কনফারেন্স’ (প্রথম প্রকাশ- ১৯৪৬)।

৭. ইমরান মাহফুজ, ‘আবুল মনসুর আহমদ দুর্লভ আলো’ (সিল্করুট- বণিক বার্তা) (https://bit.ly/2MdCr7p)

৮. আবুল মনসুর আহমদ, ‘সত্যমিথ্যা’ (জোহান বোয়ারের ‘দি পাওয়ার অব লাই’ অবলম্বনে রচিত উপন্যাস, ১৯৫৩)।

৯. ইমরান মাহফুজ, ‘আবুল মনসুর আহমদের আয়না ও তার প্রাসঙ্গিকতা’ (The Daily Star) (https://shorturl.at/wEMOU <http://shorturl.at/wEMOU>)

১০. আবুল মনসুর আহমদ, ‘জীবনক্ষুধা’ (ময়মনসিংহ, ১৯৫৫)।

Link copied!