ডাটার সার্বভৌমত্ব: ডিজিটাল বাংলাদেশের মূলভিত্তি

প্রকৌশলী আরশাদ পারভেজ

মার্চ ২৮, ২০২১, ১২:৫৮ এএম

ডাটার সার্বভৌমত্ব: ডিজিটাল বাংলাদেশের মূলভিত্তি

১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক বছরে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিচল নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে দেশের উন্নয়নের পথকে বাধাগ্রস্থ করে দেশবিরোধী ঘাতকরা।

পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘসময় পরে হলেও বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নের্তৃত্ব ও সরকার পরিচালনায় এখন আমরা ডিজিটাল বংলাদেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছি। একটি জাতির জন্য নেওয়া ডিজিটাল পদক্ষেপগুলো অসংখ্য সুবিধা ও কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে গিয়ে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশ ও সরকার পরিচালনায় শেখ হাসিনা অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ডিজিটাল ডাটার সার্বভৌমত্ব নিরাপত্তায় কয়েকটি আইন প্রণয়ন এবং তা কার্যকর করেছেন। এরকম একটি অনুকরণীয় আইন হলো- ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ২০১৮’।

প্রাথমিকভাবে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ব্যক্তি, সংস্থা, গোষ্ঠী ও মহলের বিরুদ্ধে ভুল সংবাদ ও মিথ্যা তথ্য প্রচার এবং অপপ্রচারের অবসান ঘটাতে এ আইনটি প্রবর্তন করা হয়।

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা ইউনাইটেড ন্যাশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (UNCTAD) বাংলাদেশকে নিয়ে এক তথ্য-প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে; অনলাইনে লেনদেন, গ্রাহক সুরক্ষা এবং সাইবার অপরাধ সম্পর্কিত আমাদের দেশে আইন থাকলেও এখন পর্যন্ত দেশটিতে একটি 'গোপনীয়তা এবং ডাটা নিরাপত্তা'র যথাযথ আইন নেই। তথ্য নিরাপত্তা আইনের অভাব একটি ডিজিটাল সার্বভৌম জাতির উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে।

এ কারণেই যখন কেউ ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভূয়া খবর, ভুল তথ্য কিংবা অপপ্রচার ছড়ায় তা নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। আর যখন দেশের বাইরে থেকে এসব মিথ্যা তথ্য ও ভূয়া খবর ছড়ানো হয়, সেই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা সরকারের জন্য আরো বেশি জটিল হয়ে পড়ে। বিদেশ থেকে আসা ‘তথ্য হামলা’ মোকাবেলায় সরকারকে জরুরিভাবে ‘ডাটা নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা আইন’ প্রবর্তন করা দরকার।

যদিও ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ২০১৮’ একটি অত্যন্ত কঠোর আইন, তবুও ‘ডাটা নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা আইন’ ব্যতীত এই আইনটির অনেকগুলো দুর্বলতা রয়েছে। যার ফলে অপরাধীদের পক্ষে ডিজিটাল নিরাপত্তায় আক্রমণ করা সহজ হয়ে যায়। পূর্বোক্ত আইনের অনুমোদন ছাড়া ডিজিটাল সার্বভৌম রাষ্ট্র/ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা একটি ‘সুদূর স্বপ্ন’ হিসেবেই থেকে যাবে।

এখানে উল্লেখ্য যে, বিশ্বের ১৯৪টি দেশের মধ্যে ১২৮টি দেশে তাদের নিজস্ব ‘ডাটা নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা আইন’ রয়েছে। সে হিসেবে বলা যায়, ডিজিটাল যুগে বাংলাদেশ প্রবেশ করলেও আমরা এখনও ’তথ্য-সার্বভৌম জাতি’ হয়ে উঠতে পারি নি। দেশটি এখনও পশ্চিমা শক্তির অধীনে এবং ‘ডিজিটালি উপনিবেশিক’ আমলেই রয়ে গেছে।

এখন পর্যন্ত বিশ্বের যেসব দেশে ‘ডাটা নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা আইন’ রয়েছে এবং আইনটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ও তালিকা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (UNCTAD)। এ বিষয়ে আরও জানুন: unctad.org/page/data-protection-and-privacy-legislation-worldwide

‘তথ্য আধিপত্যের’ এই কর্তৃত্ব ব্যবস্থার সাথে আমাদের লড়াই করার জন্য ডাটার সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ। বিশ্বের বৃহত্তম এবং প্রভাবশালী অনলাইন প্রতিষ্ঠান; গুগল, অ্যামাজন, ফেসবুক, আলিবাবা’র কাজের ভিত্তি হলো ডেটা। তারা ইতোমধ্যে ‘ডেটাকে বা তথ্য উপাত্তকে মুদ্রা’ হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছে। ফলে ডিজিটাল ও উন্নত দেশের অগ্রযাত্রায় আমরা এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এখনই শিক্ষা নিতে পারি।

ডিজিটাল জাতি হিসাবে সম্পূর্ণরূপে সমৃদ্ধ হওয়ার জন্য আমরা প্রত্যাশা করি ডাটার সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে সরকার আইন তৈরি করবে। দেশের নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সুরক্ষা এবং বহিরাগত হুমকি থেকে মুক্ত রাখতে বাংলাদেশে একটি নতুন আইনি কাঠামো প্রবর্তন করার এখনই সঠিক সময় এসেছে।

ডাটার সার্বভৌমত্ব কোনো ব্যক্তির বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সাইবার হামলাকারীদের থেকে ‘ক্লাউড-ফর্ম’এ সংরক্ষণ করে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা দিবে। এইভাবে ডাটার অপব্যবহার রোধ করা যেতে পারে। কোনো ব্যক্তির বিস্তারিত তথ্য তাদের আবাসস্থল দেশে সংরক্ষণ করে এবং তাদের নিজের দেশে সংরক্ষিত আইনের সাহায্যে সুরক্ষিত রাখা যায়।

বিভিন্ন প্রচেষ্টা ও পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশ এবং জাতির উন্নয়নের জন্য কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার। এই অসাধারণ উদ্যোগের কারণে দেশের উন্নয়নের ছোঁয়া শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলে সবখানেই ছড়িয়ে গেছে।

ই-গভর্ন্যান্স উদ্যোগ-সহ বর্তমান সরকার দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যাংকিং ইত্যাদি খাতে এবং অন্যান্য বিভাগেও সম্পূর্ণরূপে ডিজিটাল পরিষেবা চালু করেছে।   

ব্যাপক পরিসরে এসব পদক্ষেপের জন্য ‘ক্লাউড সিস্টেম’-এ আমাদের কয়েক কোটি ডাটা ডিজিটাল ফরম্যাটে ইনপুট হচ্ছে। দেশে শীঘ্রই ‘ক্লাউড সিস্টেম’ চালু হতে যাওয়ায় সেখানে ব্যাপক পরিমাণ ডেটা সুরক্ষার জন্য আমাদের একটি অপরাজেয় ডেটা সুরক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে।

অপরদিকে, আমরা যদি এ সুরক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হই, তাহলে ঠিক বিপরীত ও সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিও হতে পারে। এই আশঙ্কা কখনোই অবাস্তব নয়, কারণ প্রায় সময়ই আমাদের দেশে সাইবার হামলা ঘটে থাকে। এবং সবসময় আমাদেরকে এ হুমকির মধ্যে থাকতে হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাইবার হামলার ঘটনা উদাহরণ হয়ে থাকবে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম ডিজিটাল ব্যাংক ডাকাতি হিসাবে  আলোচিত। অথচ আমাদের যদি একটি শক্তশালী সাইবার সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকতো তাহলে এই সাইবার হামলা খুব সহজেই প্রতিরোধ করা যেতো। শুধু তাই নয়, এ ধরণের সাইবার হামলার পর বিষয়টি নিয়ে বিচার করার জন্যও প্রয়োজন নিজের দেশের ডাটার ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ, যা থেকে এখনো বহু দূরে বাংলাদেশ।  

আমরা শক্তিশালী তথ্য নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা আইন প্রবর্তন করে ডাটার সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে পারি। এ বিষয়ে বেশকিছু সুপারিশ হলো-

১. আন্তঃসীমানায় ডাটা আদান-প্রদান এবং সংরক্ষণের নিরাপত্তা, নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের জন্য কঠিন আইন প্রণয়ন করা।

২. ব্যক্তিগত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরকারকে অবহিত করতে হবে এবং এটি অবশ্যই বাংলাদেশে সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাত করতে হবে।

৩. ব্যক্তিগত তথ্য-উপাত্ত দেশের বাইরে আদান-প্রদান করা যাবে, তবে দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী তাদের নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে, সংরক্ষণ ও তথ্য অধিকারের শর্তাবলী মেনে চলতে হবে।

৪. বাংলাদেশে অবস্থিত সার্ভার বা ডেটা সেন্টারে ব্যক্তিগত তথ্য-উপাত্তের কমপক্ষে একটি অনুলিপি সংরক্ষণ করতে হবে।

ডাটার সার্বভৌমত্ব তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারে সহায়তা করে। ২০১৭ সালে ব্রিটেনের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্ট একটি প্রতিবেদনে জানায়, বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে ‘ডাটা বা তথ্য-উপাত্ত’। তেল এবং গ্যাসের মূল্যকে ছাড়িয়ে গেছে আমাদের ডিজিটাল সম্পদ ‘ডাটা’। বিশ্বজুড়ে মানুষ এখন কেবল তাদের মুঠোফোনে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ তৈরি করছে।

কোনো ব্যক্তি যদি তার নিজস্ব নজরদারির ব্যবস্থা নিতে পারেন, খুব ভালো। তবে এখনও কোন ব্যক্তির পক্ষে এককভাবে এতো পরিমাণ ডাটার নজরদারি চালিয়ে যাওয়া সম্ভবপর নয়। বিষয়টি এখন এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, আমাদের ডাটার অধিকারগুলি কীভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে তা আমরা বুঝতে পারি না।

ডাটার সার্বভৌমত্ব আমাদের সমাজকে শক্তিশালী করতে পারে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির উন্নয়নে সহচরের ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি দেশকে আরও বড় স্বপ্ন দেখতে এবং তার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে।

টেকসই এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের কাঠামো তৈরিতে ডাটার সার্বভৌমত্বের গুরুত্ব অপরিহার্য। ডিজিটাল ও শক্তিশালী জাতি গঠনে এবং জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি তৈরির প্রারম্ভিক সূচনা হলো 'ডাটার সার্বভৌমত্ব'।

লেখক: প্রকাশক, দ্য রিপোর্ট । ই-মেইল: ‍arsad@thereport.live

 

Link copied!