এখন পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় বেশিরভাগই শহরের সংবাদ। অনলাইন পোর্টালগুলোতেও একই অবস্থা। টিভি চ্যানেলগুলো তো সারাক্ষণ মন্ত্রী-এমপি, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, শোবিজের লোকদের কাভারেজ দিয়েই চব্বিশ ঘন্টা কাটিয়ে দেয়। এসব গণমাধ্যমে গ্রাম থাকে কমই। অথচ গ্রামে সমস্যা ও সম্ভাবনা মিলিয়ে শত সহস্র সংবাদ। শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষের সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। অথচ এখানেই দেশের ৮০ ভাগ মানুষ বাস করে। একটি দেশের বৃহত্তর অংশকে পাশ কাটিয়ে এভাবে যদি গণমাধ্যম ক্ষুদ্রতরকে সারাক্ষণ ফোকাস করতে থাকে, সেটি তাদের দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক। উপরন্তু গণমাধ্যম যে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে, এই সত্যকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। কারণ দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হলে গণমাধ্যমকে গ্রামকেও তুলে আনতে হবে সমানভাবে।
অথচ এ দেশে আঞ্চলিক সাংবাদিকতার রয়েছে এক গৌরবময় ইতিহাস। শহুরে সাংবাদিকতার অনেক আগেই এ দেশে আঞ্চলিক সাংবাদিকতার চর্চা শুরু হয়। এই আধুনিককালেও তাই দেশের উন্নয়নে এবং সমাজ থেকে অশিক্ষা-কুসংস্কারের অন্ধকার বিতাড়নে এই আঞ্চলিক সাংবাদিকতাই এখন বেশি করে দরকার। কারণ সংবাদের বেশিরভাগ উপকরণ এই মফস্বল আর পল্লী অঞ্চলেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু এ দেশে এখন হচ্ছে তার উল্টোটা।
দেশের মিডিয়াগুলো শহরকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে এখন তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে চলেছে। রাজধানী শহরের সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমগুলো মফস্বলকে গোানায়ও ধরছে না! উপরন্তু আঞ্চলিক সাংবাদিকতার প্রতি তাদের এক রকমের তাচ্ছিল্যও দেখা যাচ্ছে! এই প্রবণতা যে হঠাৎ করেই শুরু হয়েছে, তা নয়। এটি বেশি করে শুরু হয় নব্বইয়ের দশকের পর থেকেই। আঞ্চলিক সাংবাদিকতার প্রতি এই অবহেলার কারণে দেশ ও সমাজ এই পেশা থেকে যথার্থ তথ্যসেবা বা উপকারিতা পাচ্ছে না।
ব্রিটিশ শাসনামলে যশোরের ঝিকরগাছার মাগুরা গ্রামের শিশির কুমার ঘোষ নিজস্ব ছাপাখানায় দিনরাত শ্রম দিয়ে পাক্ষিক ‘অমৃত প্রবাহিনী’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সেই সময় ওই পত্রিকায় নীল বিদ্রোহ নিয়ে অগ্নিঝরা লেখনি প্রকাশ করতেন তিনি। যার ফলে অত্যাচারী নীলকরদের হৃদকম্পন শুরু হয়। এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে আঞ্চলিক সাংবাদিকতার।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘ধূমকেতু’ নামে যে সাময়িকীটি প্রকাশ করতেন সেটিও আমাদের আঞ্চলিক সাংবাদিকতার জগতে উজ্জ্বল এক আলোকবর্তিকা। আর সে পত্রিকায় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সাহিত্যকর্ম প্রকাশের পাশাপাশি ধর্মীয় উগ্রবাদিতা, হিংসা, ঘৃণার বিরুদ্ধে এবং ভালোবাসা ও মানবীয় মুক্তির পক্ষে কলম চলতো। অমৃত প্রবাহিনী বা ধূমকেতু-ও কোনো শহুরে বা রাজধানীকেন্দ্রিক তথাকথিত রাজরাজরাদের পত্রিকা ছিল না। অথচ আবহমান পল্লীর সমুদয় চিত্র তুলে ধরবার চেষ্টা থাকতো এসব পত্রিকায়।
কালের বিবর্তনে সাংবাদিকতার পরিসর ও গতি বেড়েছে। প্রযুক্তি সাংবাদিকতার জগতকে দিয়েছে ভিন্ন এক মাত্রা। সাংবাদিকতায় প্রযুক্তি এসে প্রক্রিয়াটি সহজ করে দিলেও সামাজিক ও রাষ্ট্রিক পরিস্থিতি এখন সাংবাদিকতাকে করে ফেলেছে কঠিন। সাংবাদিকতা তার নিজস্ব গতিতে চলতে গিয়ে প্রায়শঃ মুখ থুবড়ে পড়ছে। সাংবাদিকতায় পদে পদে চলে এখন অনিশ্চয়তা, সাংবাদিকের নিজের জীবনের, ক্যারিয়ারের। এসব কারণে এই দেশে সাংবাদিকতাকে ঝুকিপূর্ণ পেশা বলা হয়। যদি এই সত্যটি মেনে নিতে হয়, তাহলে বলা যায়, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি এ দেশের মফস্বলের আঞ্চলিক সাংবাদিকদের।
শহরে সাংবাদিকতা করা সে হিসেবে অনেকটাই সহজ। শহরে কেউ কাউকে তেমন একটা চেনে না, জানে না। তাদের খুঁজেও পায় না। তা ছাড়া সংবাদে নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রতিবেদক, বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে রিপোর্টারের পরিচিতি লিখলে সেই সাংবাদিককে চেনার আর সেভাবে সুযোগ থাকে না। জেলা-উপজেলায় যারা কাজ করেন তাঁদের ক্ষেত্রে একজনই নিয়োগ পান যাঁকে সবাই চেনেন ও জানেন। সে ক্ষেত্রে জেলা প্রতিনিধি, কিংবা উপজেলা প্রতিনিধি সোর্স হিসেবে লিখলেও স্পষ্ট বোঝা যায় যে কে সংবাদটি লিখেছেন। মফস্বলে সাংবাদিকতা করা তাই এত সহজ কাজ নয়। তাঁদের কাজও বেশি এবং ঝুঁকিও বেশি। আর পারিশ্রমিক? সেটি না হয় এখানে আলোচনায় নাইবা আনলাম। (যাঁরা অসৎ সাংবাদিক তাঁদের জন্য এ কথা অবশ্য প্রযোজ্য নয়)।
মফস্বলের সাংবাদিককে একটা এলাকার মধ্যে প্রভাবশালী কিংবা সন্ত্রাসীর গানপয়েন্টে থেকে কাজ করতে হয়। গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষ তাঁকে পূর্ণ বেতন সুবিধা বা কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ না দিলেও তাঁকে ওই নিদিষ্ট এলাকার সমুদয় সংবাদ কভারের ভার তাঁর কাধে তুলে নিতে হয়। তিনি রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে চরাচর ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করেন। তাঁকে আসলে ‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের মতো’ সব বিষয় নিয়েই ছুটতে হয়। এভাবে তিনি একাই নিজ এলাকার খেলার খবর, সংঘাত, সংঘর্ষ, ফিচার, অপরাধ, রাজনীতির সব খবরই সরবরাহ করেন।
কিন্তু পত্রিকার প্রধান অফিসে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা একেক জন থাকেন এক একটি বিষয় (বিট) নিয়ে। তাঁদের বেশিরভাগই আঞ্চলিক সাংবাদিকতার প্রতি একরকমের উন্নাসিক মনোভাব পোষন করেন। নতুন মিডিয়ার যাত্রা শুরু হলেও আঞ্চলিক সংবাদকে খুব কম গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ ও প্রচার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। মূলত এখন মিডিয়ার সিংহভাগ জুড়ে থাকে সরকারের কর্তাব্যক্তি বা মন্ত্রী-এমপিরা সারাদিনে কে কী বলেছে, কোথায় কোথায় সংবাদ সম্মেলন হয়েছে, দু-একটা দুর্ঘটনা আর সরকারি আমলা-প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের বদলির খবর!
আঞ্চলিক সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালনকালেও নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যে পড়েন। সংবাদের কারণে মামলা-মোকদ্দমায় পড়লে সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো দূরে থাক, মিডিয়ার প্রধান কার্যালয়ও অনেক সময় তাঁদের পাশে থাকে না! তখন আঞ্চলিক সাংবাদিককে জেলজুলুম সহ্য করতে হয়। অনেক সময় প্রভাবশালী মহলের হাতে প্রাণও যায় তাঁদের। অথচ একজন আঞ্চলিক সাংবাদিক নামেমাত্র বেতন-ভাতায় কাজ করে থাকেন।
দেশের সংবাদ মিডিয়া এখন মোটা দাগে তিনটি ভাগে বিভক্ত। একটি ভাগ সরকারি ওয়েজবোর্ডের নিয়ম মেনে ঢাকার সাংবাদিকদের পাশাপাশি আঞ্চলিক সাংবাদিকদেরও নিয়োগপত্র এবং তাঁদের প্রাপ্য বেতন ভাতা দেয়। এই ভাগের সংখ্যাটি একেবারে নগণ্য। আরেকটি ভাগ ছয় মাস বা এক বছরের কথা বলে সাংবাদিকদের অস্থায়ী নিয়োগপত্র দেয়। এরপর সেই সময় পেরিয়ে গেলেও তাঁদের আর স্থায়ী নিয়োগ হয় না। বেতন-ভাতাও দেওয়া হয় না। শেষোক্তরা কোনো নিয়োগপত্র বা বেতন-ভাতার নামটিও মুখে আনেন না। তাঁরা শুধু একটি নিয়োগপত্র এবং একটি আইডি বা পরিচয়পত্র ধরিয়ে দেয়। এটুকুই। এরপর তাঁদেরকে নামিয়ে দেওয়া হয় সাংবাদিকতার মাঠে। এটি পত্র-পত্রিকা ও টিভির ক্ষেত্রে অহরহই ঘটছে। এই দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পক্ষের বেশিরভাগ সাংবাদিক পেশাকে অসৎ উপায়ে ব্যবহার করেন।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমানে মিডিয়ার রমরমা বাণিজ্যের সময়েও শেষোক্ত দলই ভারি। অর্থাৎ আঞ্চলিক সাংবাদিকরা বেতন ভাতা বা নিয়োগপত্র ছাড়াই দিনের পর দিন বেগার খেটে যান। এরফলে অনেক সাংবাদিক অসৎ পথে অর্থ উপার্জনে নামেন। সাংবাদিকতা পেশারও দুর্নাম হয়। সাংবাদিকতা পেশার দুর্নাম এরইমধ্যে যথেষ্ট হয়ে গেছে। এখন হরেদরে সাংবাদিকতার পরিচয়পত্র দিয়ে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এসব কাজ করছেন রাজধানী শহরের এসি রুমে বসে থাকা অসৎ সম্পাদক ও তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা।
দেশের প্রকৃত উন্নয়নের অন্যতম শর্ত হল তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য আঞ্চলিক সাংবাদিকতাকে অবমূল্যায়ন করবার প্রবণতা থেকে বের হতে হবে। আঞ্চলিক সাংবাদিক আর শহরের সাংবাদিকের পার্থক্য করার মনোভাব ঝেড়ে ফেলতে হবে। সাংবাদিকতা কেউ শহরে করবেন, কেউবা করবেন বিভাগ-জেলা-উপজেলায়। কেউ বেতন পাবেন তিন হাজার, কেউবা তিন লাখ। বেতনে পার্থক্য হলেও সবাই সাংবাদিক। সাংবাদিকতায় তাঁদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
একটি দেশ ও সমাজের সামনে এগিয়ে চলার জন্য গঠনমূলক সাংবাদিকতার বিকল্প নেই। শুধু নাগরিক বা শহুরে সাংবাদিকতা দিয়ে দেশ ও সমাজের প্রকৃত উপকার সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার শহর ও আঞ্চলিক সাংবাদিকতার সমন্বিত ভূমিকা। যদি দেশের মফস্বল ও পল্লীর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে কম গুরুত্ব দিয়ে শহরকেন্দ্রীক সরকার-মন্ত্রী-আমলারা কে কী বলেছেন তা দিয়েই গণমাধ্যম তার দায়িত্ব পালন হয়েছে বলে মনে করে, তাহলে সেটি কোনওভাবেই গণের মাধ্যম হবে না। কারণ বৃহত্তর গণ তো মফস্বল আর পল্লীতে থাকেন। তাঁদের খবর বাদ দিয়ে যে সাংবাদিকতা, কোনো ক্রমেই সেটি গণসাংবাদিকতা হতে পারে না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পাঁচ দশক পরে এসেও এত সাফল্য ও অগ্রগতির আখ্যানকাব্যে নগর ও মফস্বল নামের বিভাজিত সাংবাদিকতার অনুদার গল্পে গ্রামের সাংবাদিকটির যথার্থ মর্যাদা নিশ্চিত করতে না পারা বিরাট এক ব্যর্থতা বটে! সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাংবাদিকদের রাষ্ট্র নির্দেশিত তথাকথিত ওয়েজবোর্ড বা বেতন কাঠামোর সুবিধাগুলো এবার দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে মিডিয়া কর্তাদের।
‘গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশংসনীয়’ কিংবা ‘আঞ্চলিক সাংবাদিকতার সমস্যা ও সম্ভাবনা’ এরকম গালভরা টেবিল আলোচনার মধ্যেই আঞ্চলিক সাংবাদিকদের ভাগ্য রাজধানীকেন্দ্রিক কর্তাদের ইচ্ছের পেন্ডুলামে আর দোল খেতে দেওয়া যায় না। সংবাদ রাজ্যের নাগরিক পিতারা গ্রাম্য ‘অনার্য বা হরিজন’ সাংবাদিকদের সাথে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের সামন্তপ্রথার বিলোপ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদ নিয়ে যদি একটি দেশ হয়, তাহলে সেই দেশের রাজধানীকেন্দ্রিক সাংবাদিকেরা কিন্তু সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। তাদেরকে গণমাধ্যমের মূল প্রবাহ বলা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই বলা হচ্ছে তাই-ই! বেরিয়ে আসুন এই হীনমন্যতা থেকে। দেশের প্রকৃত উন্নয়ন নির্ভর করে অবাধ তথ্যপ্রবাহের ওপর। পল্লী ও মফস্বলেই ছড়িয়ে আছে সম্ভাবনার শতসহস্র তথ্যউপাত্ত। সেসব মূলস্রোতে আনার জন্য আঞ্চলিক সাংবাদিকতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করার বিকল্প নেই।
রাজধানীকেন্দ্রিক মিডিয়ার কর্তৃপক্ষ, সম্পাদক ও সিনিয়রদের প্রতি আহ্বান রাখছি, আঞ্চলিক সাংবাদিকদের নানা বৈষম্য থেকে রক্ষা করে দেশের প্রকৃত সাংবাদিকতা চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করুন। আঞ্চলিক সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ, প্রধান কার্যালয়ের কর্মীদের মতো সুযোগ-সুবিধা প্রদান, তাদের চাকরির নিরাপত্তার পাশাপাশি জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ যাবতীয় পদক্ষেপ নিন। দেশের প্রকৃত উন্নয়নে এই আঞ্চলিক সাংবাদিকতার সুবিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগান।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট। সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ। ইমেইল: lutforrahmanhimel@gmail.com