বিপ্লবী, নাট্যকার ও সাংবাদিক শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত

দ্য রিপোর্ট

মার্চ ৫, ২০২১, ০৪:৫১ পিএম

বিপ্লবী, নাট্যকার ও সাংবাদিক শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত

দেশের স্বাধীনতা লাভের পূর্ব সময়ে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে যেসব গুণী কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। বাংলা নাট্যসাহিত্যের জনপ্রিয় এ নাট্যকার সেসময়ে সাংবাদিকতা পেশায়ও বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। বিপ্লবী সংগঠন স্বদেশী ও অনুশীলন সমিতির অন্যতম সদস্য ছিলেন। ১৯৬১ সালের আজকের দিনে (৫ মার্চ) খ্যাতিমান এ সাংবাদিক ও নাট্যকার শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত মৃত্যুবরণ করেন।

তিনি দেশাত্মবোধ চেতনাকে ধারণ করে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক নাটক রচনার মাধ্যমে তৎকালীন সমাজে নতুন জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন। তার ঐতিহাসিক নাটক সিরাজদ্দৌলা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৪৬ সালে কলকাতার রঙ্গমঞ্চে অভিনীত রাষ্ট্রবিপ্লব নাটকটিও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। 

বিপ্লবী, নাট্যকার ও সাংবাদিক শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।

শচীন্দ্রনাথ কিছুদিন একটি কলেজে অধ্যাপনা এব্ং সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন। সাংবাদিকতার সূত্রে তিনি অনেক ঘটনাকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। যেগুলি তার নাট্য রচনায় রসদ যুগিয়েছে। বৃহত্তর সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবেই তিনি নাট্য-আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। নাটককে হাতিয়ার করে মানুষকে সচেতন করতে চেয়েছেন। ফলে তার সামাজিক নাটকগুলিতে উঠে এসেছে- কুমারী জীবনে মাতৃত্বের সমস্যা, দাম্পত্যজীবনে নারী-পুরুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের দ্বন্দ্ব, নারীস্বাধীনতার সুস্পষ্ট রূপ, সমাজ জীবনের নানা ভাঙন, ভণ্ড দেশপ্রেম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সার্বিক অবক্ষয় ইত্যাদি দিকগুলি।

১৮৯২ সালের জুলাইয়ে খুলনা জেলার সেনহাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। পিতা সত্যচরণ সেনগুপ্ত। পিতার কর্মস্থল রংপুরে প্রাথমিক শিক্ষালাভ করে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দিয়ে শচীন্দ্রনাথ বিদ্যালয় ত্যাগ করেন এবং অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার জাতীয় বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পাস করে তিনি বিএ পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। পরে তিনি কটক মেডিক্যাল স্কুলে চিকিৎসাবিদ্যা ও ময়মনসিংহে কবিরাজি শেখেন। তিনি ছোট থেকেই ছিলেন দেশপ্রেমে জাগ্রত এক কিশোর।

১৭৫৭ সালের ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে রচনা করেন নাটক ‘সিরাজদ্দৌলা’।

কর্মজীবনের শুরুতে শচীন্দ্রনাথ কিছুদিন একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। পরে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন। তার সাংবাদিক জীবনের শুরু দৈনিক কৃষক ও ভারত পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে। এছাড়া তিনি সাপ্তাহিক হিতবাদী, বিজলী, আত্মশক্তি প্রভৃতি পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। বেসরকারি সাংস্কৃতিক দলের নেতা হিসেবে তিনি রাশিয়া, নরওয়ে, পোল্যান্ড, চীন, সিংহল প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন।

শচীন্দ্রনাথ বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন নাটক রচনায়। তার রচিত ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক নাটকের মূল প্রতিপাদ্য দেশাত্মবোধ। তার নাটকে ফুটে উঠেছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও হিন্দু-মুসলমানের মিলনের বাণী।

তার উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক নাটকগুলি হলো: গৈরিক পতাকা (১৯৩০), দেশের দাবি (১৯৩৪), রাষ্ট্রবিপ্লব (১৯৪৪), সিরাজুদ্দৌলা (১৯৩৮), ধাত্রীপান্না (১৯৪৮), সবার উপরে মানুষ সত্য (১৯৫৭), আর্তনাদ ও জয়নাদ (১৯৬১)। এছাড়াও রক্তকমল (১৯২৯), ঝড়ের রাতে (১৯৩১), নার্সিংহোম (১৯৩৩), স্বামী-স্ত্রী (১৯৩৭), তটিনীর বিচার (১৯৩৯), মাটির মায়া, কাঁটা ও কমল, প্রলয়, জননী প্রভৃতি তার সামাজিক নাটক। তিনি অনুবাদ গ্রন্থ রাচনা করেও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

ঐতিহাসিক নাটক ‘সিরাজদ্দৌলা’ মঞ্চায়ন।

তার লেখা গৈরিক পতাকা (১৯৩০), কিংবা, সিরাজদ্দৌলা (১৯৩৮) আজও অভিনয়ের সময় আমাদের শোণিতে শোণিতে শিহরায়মান এক অনির্বচনীয় অনুভূতি জাগায়। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়চেতনার প্রসার ঘটাতে সেদিন সফল হয়েছিল এইসব ঐতিহাসিক নাটক। তিনি মনে প্রাণে অনুভব করেছিলেন যে সমগ্র পরাধীন জাতিকে সংগঠিত করতে পারে সাহিত্য ও নাটক। 

Link copied!