ভারতবর্ষের সবচেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তি

সন্দীপন ধর

জুন ১, ২০২১, ০৩:৪৯ পিএম

ভারতবর্ষের সবচেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তি

পয়সার গরম তো জীবনে অনেক দেখলেন। কিন্তু বিদ্যার এমন গরম দেখেছেন না শুনেছেন কখনও? সবটা শুনলে মাথা ঝিমঝিম করবে আপনার, হাত পা-ও অবশ হয়ে যেতে পারে বৈকি। এক জীবনে এত পড়াশোনা কোন রক্ত মাংসের মানুষ করতে পারেন? না পড়লে বিশ্বাস হবে না; তাও আবার সেই ভদ্রলোক যদি ভারতীয় হন!

Jisken dhar

শ্রীকান্ত জিচকার। ১০ টি স্নাতোকত্তর ডিগ্রীধারী এই জ্ঞানপিপাসুর ২০০৪ সালের ২ জুন এক পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়।

মারাঠি এই ভদ্রলোকের নাম শ্রীকান্ত জিচকার। তার পড়াশোনার জীবনটা একবার হাল্কা করে চোখ বুলিয়ে নিন শুধু। তাহলেই বুঝবেন, ভদ্রলোক কি কাণ্ডটাই না করেছেন!

(১) জীবন শুরু 'M.B.B.S.' ও 'M.D.'-  এ' দিয়ে।

(২) এরপর 'L.L.B.' করলেন । সাথে করলেন 'International Law'-এর উপর স্নাতকোত্তর।

(৩) এরপর 'Business Management'-এর উপর 'Diploma' ; সাথে 'M.B.A.'।

(৪) এরপর 'Journalism' নিয়ে স্নাতক।

এতদূর পড়ার পর আপনার যখন মনে হচ্ছে, লোকটা পাগল নাকি? তখন আপনাকে বলতেই হচ্ছে, এ তো সবে কলির সন্ধ্যে । এখনো গোটা রাত বাকি।

এই ভদ্রলোকের শুধু স্নাতকোত্তর 'ডিগ্রী'ই আছে দশটা বিষয়ের উপর । স্নাতকোত্তরের বিষয়ের তালিকাটা একবার দেখুন:

(১) 'Public Administration'

(২) 'Sociology'

(৩) 'Economics'

(৪) 'Sanskrit' (ডি. লিট).

(৫) 'History'

(৬) 'English'

(৭) 'Philosophy'

(৮) 'Political Science'

(৯) 'Ancient Indian History', 'Culture' and 'Archaeology'

(১০) 'Psychology'

উপরের যতগুলো বিষয় দেখছেন সব কটিতেই প্রথম শ্রেণীর সঙ্গে স্নাতকোত্তর এবং ২৮টি স্বর্ণপদক বিজয়ী তিনি। সব মিলিয়ে ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রতি গ্রীষ্মে ও প্রতি শীতেই উনি কোন না কোন স্নাতকোত্তরের বিষয়ের পরীক্ষা দিয়ে গেছেন ।

মাথা ঝিমঝিম করছে তো আপনার? তা মাথার আর দোষ কি বলুন? তবে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আগে একবারটি শুধু শুনে যান, এতসব পড়তে পড়তে ওনার যখন একঘেঁয়েমি লাগছিল তখন ঠিক করলেন, এবার একটু স্বাদ বদলানো যাক।

স্বাদ বদলাতে আমি-আপনি বেড়াতে যাই আর উনি 'I.P.S.' পরীক্ষায় বসলেন এবং পাশ করলেন । সেটা ১৯৭৮ সাথে । কিন্তু পোষাল না চাকরিটা। ফলে সেটা ছেড়ে দিয়ে বসলেন 'I.A.S.' পরীক্ষায় । ১৯৮০ সালে উনি 'I.A.S.' হলেন।

নটে গাছটা তাহলে মুড়োল শেষ অবধি ? আজ্ঞে না, মুড়োয়নি এখনো । চারমাসের মধ্যে 'I.A.S.'- এর চাকরিটাও ছেড়ে দিলেন মহারাষ্ট্রের বিধান সভা ভোটে লড়বেন বলে । ১৯৮০ সালে উনি যখন বিধায়ক নির্বাচিত হলেন তখন ওনার বয়স সবে ২৫ বছর। উনি হলেন ভারতের সবচেয়ে কমবয়সী বিধায়ক।

সবই হল যখন, তখন মন্ত্রী হওয়াটাই বা আর বাকী থাকে কেন ? সেটাও হলেন এবং একটা কিংবা দু'টো দপ্তরের নয়, একেবারে ১৪টা দপ্তরের । ১৯৯২ সাল নাগাদ রাজ্যসভার সদস্যও নির্বাচিত হলেন।

ওনার এই ‘সামান্য’ কয়েকটি গুণ ছাড়াও উনি:

■ অসাধারণ চিত্রশিল্পী।

■ পেশাদার আলোকচিত্রকর।

■ মঞ্চাভিনেতা।

■ সখের বেতার চালক।

পরে উনি 'জাতিসংঘ' ও 'ইউনেস্কো'তে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ব্যক্তিগত সংগ্রহে মাত্র ৫২,০০০ বই রয়েছে ওনার। ‘লিমকা বুক অফ রেকর্ডস’ ওনাকে 'ভারতবর্ষের সবচেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তি'র শিরোপা দিয়েছে। ১৯৮৩ সালে উনি ‘বিশ্বের অসামান্য দশজন তরুণ’ হিসেবে নির্বাচিত হন।

২০০৪ সালের ২ জুন এক পথ দুর্ঘটনায় ওনার মৃত্যু হয়। তখন বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৯ বছর। তার মর্মান্তিক মৃত্যুতে একটি জ্বলন্ত নক্ষত্র নিভে যায়। তিনি মৃত্যুর আগে এই শিক্ষা দিয়ে যান, 'যার যত জ্ঞান, তার অহংকার তত কম'।

নাগপুর শহরে শ্রীকান্তের নামে একটি সংস্থাও (non-profit organisation) আছে যেখান থেকে মানুষকে নানাভাবে সাহায্য করা হয়। এই সংস্থার বিবিধ কাজের মধ্যে অন্যতম হল শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্য সচেতনতা, কর্মসংস্থান, পরিবেশ সচেতনতা ইত্যাদি। শ্রীকান্ত একটি সুন্দর ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখতেন যেখানে মানুষ সুস্থ এবং সচেতন থাকবে, শিক্ষিত হবে এবং ভালো থাকবে। নব্বই দশকের থেকেই তিনি নাগপুরে স্বাস্থ্য আন্দোলন (fitness movement) শুরু করেন। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করা যাতে তারা ১০০ বছর বাঁচতে পারে। এই সংস্থাটি সারা বছর ধরেই নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে জড়িয়ে থাকে এবং শ্রীকান্তের জন্মদিনের দিন নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকে।

শ্রীকান্তের ভারতীয় রাজনীতিতে এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় অসামান্য অবদান মানুষ এখনো মনে রেখেছে। শ্রীকান্ত নিজে একশো বছর বাঁচতে পারেননি, কিন্তু তিনি শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্য সচেতনতা, কর্মসংস্থান, পরিবেশ সচেতনতাসহ দীর্ঘায়ু লাভের মন্ত্র শিখিয়ে গেছেন। 

লেখক: সন্দীপন ধর, ভারত সরকারের প্রাক্তন অতিরিক্ত সচিব, প্রাবন্ধিক ও বিজ্ঞান লেখক।

Link copied!