মাও সে তুং: মেহনতি মানুষের মুক্তির অগ্রসেনা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ডিসেম্বর ২৬, ২০২১, ১১:০৯ পিএম

মাও সে তুং: মেহনতি মানুষের মুক্তির অগ্রসেনা

চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অগ্রনায়ক এবং আধুনিক চীনের জনক মাও সে-তুং। চীনা সমাজ ও সংস্কৃতিতে ওতোপ্রোত ভাবে ছড়িয়ে আছেন তিনি। পুৃজিঁবাদী সমাজের কবল থেকে মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন  লড়াই করে গেছেন মাও সে-তুং।

মাও ছিলেন একজন লেখক, কবি এবং দার্শনিক। তার প্রচারিত দর্শন মাওবাদ হিসেবে চীন এবং সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত, তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং আমৃত্যু কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন।

তার দর্শনই মাওবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। জীবদ্দশায় পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের যেমন আদর্শে পরিণত হয়েছিলেন, তেমনই নানা মহলের তীব্র সমালোচনারও শিকার হয়েছিলেন তিনি।

বিপ্লবী মার্কসবাদী তাত্ত্বিক মাও সে-তুং

বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হযে যখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা ও যাত্রা শুরু হয়, ঠিক তখনই বিশালাকার চীনের বিভিন্ন প্রান্তে ক্রিয়াশীল গ্রুপগুলো থেকে ৫২ জন কমিউনিস্টের মাত্র ১২ জন প্রতিনিধি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না, সিপিসি। প্রতিষ্ঠা লগ্নেই পার্টি মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে তার মতাদর্শিক হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে লেনিনীয় একশিলা পার্টি গঠনের পদ্ধতির অনুসরণে গণতান্ত্রিক নীতিমালার ভিত্তিতে আন্তঃপার্টি বিতর্কের মাধ্যমে চীনের নিজস্ব বাস্তবতা মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের চীনদেশীয় প্রেক্ষাপটে তাকে মাওসেতুং থট, দেং শিয়াও পিংয়ের থিয়োরিতে বিকশিত করে আজ পৃথিবীর বৃহত্তম সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করছে। আর এখানেই শেষ নয়, চলমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের রণকৌশল বিনির্মাণে আজ চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদকে নবতর উচ্চতায় উন্নীত করেছেন যা একুশ শতকের মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ বলে স্বীকৃত।

মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ মানবজাতির ইতিহাসের বিশ্বজনীন নিয়মাবলীকে তুলে ধরে প্রমাণ করেছে যে পুঁজিবাদী সমাজের অন্তর্গত দ্বন্দ্ব অন্তর্গতভাবে সমাধানের অযোগ্য আর তাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবই সমাজে অনিবার্য একমাত্র সমাধান যা পর্যায়ক্রমে সমাজকে সমাজতন্ত্র থেকে কমিউনিজমে উন্নীত করবে। । প্রতিষ্ঠার মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ঐতিহাসিক বস্তুবাদী তত্ত্বকে প্রয়োগ করে চীনের বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার সম্পন্ন করে সিপিসি গ্রহণ করে দলের রণনীতি, রণকৌশল এবং আশু ও চূড়ান্ত কর্মসূচি। আশু কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রতিক্রিয়াশীল সামন্তবাদের অবশেষ এবং বৈদেশিক আগ্রাসী শক্তি জাপ-সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে চীনের জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতিনিধিত্বকারী কুয়োমিনটাঙ-এর সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে শুরু করে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম। 

চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অগ্রনায়ক

সিপিসি’র নেতৃত্বে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়ায় সিপিসি’র সাথে ঐক্যবদ্ধ কুয়োমিন্টাঙের একটি প্রতিক্রিয়াশীল অংশ যার নেতৃত্বে ছিলো চিয়াং কাইশেক। চিয়াং কাইশেক আবার বেছে নেয় জাপ সাম্রাজ্যবাদীদের সহযোগিতার পথ। তাতে সিপিসিকে লাগাতার এক সশস্ত্র লড়াই অব্যাহত রাখতে হয়। সেই সশস্ত্র লড়াইয়ের জন্য জনগণকে সংগঠিত করে গড়ে তোলা পিপলস লিবারেশন আর্মি বা রেড আর্মির ধারণা ও নতুন ধরণের যুদ্ধ কৌশল প্রদান করার মাধ্যমে কমরেড মাও সে তুং যে অবদান রাখেন তা একেবারেই চীনা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তাই মাও সে তুং-য়ের চিন্তাধারাও মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের প্রয়োগিক সম্প্রসারণ বলে আজ মার্কসবাদ-লেনিনবাদের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকৃত। কমরেড মাও সে তুং মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্ব অনুসরণ করে চীনের বাস্তবতায় একটি আধা সামন্তান্ত্রিক-আধা উপনিবেশিক দেশে প্রলেতারীয় পার্টি গঠনের এক অনন্য কৌশল গ্রহণ করেন যার নেতৃত্বে ছিলো শ্রমিক শ্রেণী এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় ছিলো কৃষক সমাজ ও পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী।  

পার্টি সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মাও সে-তুং এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলো হলো প্রথমত তিনি এমন একটি সংগঠন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যেটি আন্তরিকভাবে জনগণকে সেবা করবে এবং দ্বিতীয়ত যে সংগঠনটির থাকবে দৃঢ় মতাদর্শিক ভিত্তি। চীনা বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নতুন ধরণের এই কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সফল লং মার্চের মাধ্যমে গড়ে তোলা ঘাঁটিসমূহে পার্টির শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে একদিকে চলমান থাকে দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ততান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে দীর্ঘকালীন গৃহযুদ্ধ আর অপরদিকে চলমান থাকে জাপ-সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধ। এই দ্বিমুখী যুদ্ধকে যুগপৎভাবে মোকাবেলা করে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি জয়যুক্ত হয়ে ১৯৪৯ সালে প্রলেতারীয় শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে প্রতিষ্ঠা করে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন। এরপর চলতে থাকে নব উদ্যমে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকাশ ও বিনির্মাণের পথে অগ্রযাত্রা। সেই পথ মোটেও সরল ও সহজ ছিলো না। কারণ তখনও পার্টিকে চালাতে হয়েছে ডান সুবিধাবাদ ও বাম হঠকারিতার বিরুদ্ধে লাগাতার সংগ্রাম। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তার শক্তিশালী মতাদর্শিক ভিত্তির কারণে কখনও মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ থেকে বিচ্যুত হয়নি।

হান নেতা মাও সে-তুং

সময়ের সঙ্গে রীতিনীতি বদলায়। চীনেও বদলেছে। মাও সে-তুংয়ের চীন আর এখনকার চীন এক নয়। তবে সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করেন, মাও তার সময়ে যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিলেন, সেগুলো সে সময়ের জন্য যথাযথ ছিল। পৃথিবী কাঁপানো বিপ্লবী মহান নেতা মাও সে-তুং ১২৮তম জন্মদিনে তার প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা।

Link copied!