রুমি: প্রেম-বিরহে ধ্যানমগ্ন এক সুফি কবি

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২২, ০৬:০০ এএম

রুমি: প্রেম-বিরহে ধ্যানমগ্ন এক সুফি কবি

রুমি নামে পরিচিত মাওলানা জালালুদ্দিন মুহাম্মদ রুমি ১২০৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর খোয়ারিজমীয় সাম্রাজ্যের বলখে (বর্তমান আফগানিস্তান) জন্মগ্রহণ করেন। ৮১৪ বছর আগে জন্ম নেওয়া এই মনীষী আজ বিশ্বের সর্বত্র সুপরিচিত। হাজার বছরেও তাঁর জ্ঞানের আলোর মশাল জ্বলছেই।  বলখ শহর থেকে তাঁর অভিযাত্রা শুরু হয়। এরপর উজবেকিস্তান, ইরান ও সিরিয়ায় বসবাস করার পর মোঙ্গল দস্যুদের হুমকির কারণে তুরস্কে থিতু হয়েছিলেন তিনি। মূলত পার্সি ভাষায় লিখলেও তুর্কি, আরবি ও গ্রিক ভাষাতেও লিখেছেন তিনি। তুরস্কের কোনিয়ায় মৃত্যুর পর তাঁর জানাজায় অংশ নিতে প্রায় সব ধর্মের মানুষ সমবেত হয়েছিল।

বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর উক্তি শেয়ার করে থাকেন প্রতিনিয়ত। ৮০০ বছর আগে বলে যাওয়া কথামালা যেন চির তরুণ, সজীব, সতেজ। প্রতিদিন ধরা দিচ্ছে মানুষের জীবনের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম হয়ে। আর এখানেই এই ধ্যানী মহামনীষীর স্বার্থকতা।

তুরস্কের কোনিয়ায় রুমির সমাধি। 

রুমির রুমি হয়ে ওঠার পেছনে তার গুরু শামস তাবরিজের অবদান সবচেয়ে বেশি। তাবরিজের সঙ্গে মাত্র ৩ বছর ছিলেন রুমি। সময়টা ১২৪৪ সাল, যে বছর রুমি শামস তাবরিজের সঙ্গে প্রথম মোলাকাত করেন। এটিই রুমির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। স্বাধীন চিন্তার অধিকারী আধ্যাত্মিক সুফিগুরু শামস তাবরিজের সঙ্গে রুমির মোলাকাতের আগে ৩৭ বছর বয়েসী রুমি ছিলেন একজন ধর্মতাত্ত্বিক ও প্রচারক। তাবরিজের সঙ্গে কাটানো সময়ের মধ্যেই রুমি একজন সুফিতে পরিণত হন। ৩ বছর পর তাবরিজ গায়েব হয়ে যান। ঐতিহাসিকদের ধারণা, রুমির কোনো ঈর্ষান্বিত পুত্র তাবরিজকে খুন করে ফেলে। তাবরিজের প্রস্থানের পর বিচ্ছেদের আগুনে পুড়তে থাকেন রুমি। বিচ্ছেদের দহন থেকে রুমি নিজেকে পুরোপুরি কবিতায় সঁপে দেন। রুমির অধিকাংশ কবিতাই মূলত ৪০ থেকে ৬৭ বছর বয়সকালে লেখা। গুরু শাসম তাবরিজ, নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও খোদাকে নিয়ে লেখেন তিন হাজার ‘প্রেমসংগীত’। লিখেছেন ২ হাজার রুবাইয়াত। ৬ খণ্ডে লিখেছেন আধ্যাত্মিক মহাকাব্য ‘মসনবী’। মসনবী শেষ করার আগেই মারা যান রুমি। ফলে অসম্পূর্ণ থেকে যায় তার এই অমরকীর্তি।

রুমির গুরু শামস তাবরিজের সমাধি। ছবি: সংগৃহীত

তবে মৃত্যুর মধ্য দিয়েই যেন রুমি বিশ্ববাসীর কাছে নতুন করে ধরা দিয়েছেন। উদ্ভাসিত হয়েছেন নতুন চেহারায়। রুমী নিজেই তার মসনবীর ৭০৭ নম্বর শ্লোকে বলেছেন,

 ‘কুশতান ওয়া মুর্দানকে বার নাকশে তানা’স্ত

চোন আনা'র ও সীবরা' বেশকাস্তান আস্ত’-‘মানুষের দৈহিক মৃত্যু মূলত আনার বা আপেলের খোসা ছাড়ানোর মতোই’।

খোসা ছাড়ালেই আসল রূপ উন্মোচিত হয়। নিজের জীবনে মসনবীর এই লাইনকে যেন আপ্ত বাক্য হিসেবে নিয়েছিলেন। তাই তো আজ মরণের প্রায় হাজার বছর পরেও রুমির জনপ্রিয়তা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। বিশ্বের বেশ কয়েকটি ভাষায় রুমির বেশির ভাগ লেখা অনুদিত হয়েছে। বাংলাভাষায় তো হয়েছেই, ইংরেজিতেও হয়েছে।

ক্যালিগ্রাফিতে রুমি। ছবি: সংগৃহীত

রুমিকে সারাবিশ্বে পরিচিত করার পেছনে বেশির ভাগ অবদান আমেরিকান সাহিত্য গবেষক, অনুবাদক কোলম্যান বার্কসের। তিনি আর্থার জে আরবেরির করা রুমির কিছু কবিতাকে পুনরায় ইংরেজিতে অনুবাদ করে ফেলেন। তারপর থেকেই রুমিকে নিয়ে তার যাত্রা শুরু। প্রায় ৩৩ বছর সাধনার পর ২২ খণ্ডে রুমির কাজ এবং তাকে নিয়ে নিজের চিন্তাভাবনা লিপিবদ্ধ করেছেন কোলম্যান বার্কস। ‘দ্য এসেনশিয়াল রুমি’, ‘আ ইয়ার উইথ রুমি’, ‘রুমি: দ্য বিগ রেড বুক’, ‘দ্য স্পিরিচুয়াল ডায়েরি অব রুমিস ফাদার’। বইগুলো বিশ্বের অন্তত ২৩টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। বিক্রি হয়েছে বিশ লাখ কপিরও বেশি। যদিও তাকে নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। তবে এটা সত্য যে, আধুনিক দুনিয়াকে রুমির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কৃতিত্বের অনেকটাই কোলম্যান বার্কসের।

রুমির জনপ্রিয়তা সম্পর্কে কোলম্যান বলেছিলেন, ‘রুমির চিন্তার আশ্চর্য সজীবতা যে অর্থ নিয়ে হাজির হয়, তাঁর জনপ্রিয়তার বড় কারণ তা–ই। তার অনুভূতির সূক্ষ্ম কৌতুক ও খেলাচ্ছলে বলা কথাতেও লুকিয়ে থাকে গভীর চিন্তা আর বুদ্ধির ঝলক’।

রুমিকে সারাবিশ্বে পরিচিত করার পেছনে বেশিরভাগ অবদানের অনেকটাই কোলম্যান বার্কসের।

দিনে দিনে রুমি যেন তার মসনবীতে বলা সেই আনার বা আপেল হয়ে ধরা দেন আমাদের সামনে। যতো দিন যাচ্ছে ততো উদ্ভাসিত ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন আমাদের জীবনে। বিশ্বজুড়ে রুমি ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পরিচিত হলেও বাংলা ভূখণ্ডে রুমি এসেছেন এদেশীয়দের হাত ধরেই, সরাসরি ফারসি থেকে। তবে তাকে জানতে হলে সাবধানে আনারের খোসা ছাড়ানোর মতো করে প্রত্যেকটি কোষ বাঁচিয়ে উন্মোচন করতে হবে। নইলে রুমি আমাদের সামনে সস্তা আবেগ প্রকাশের হাতিয়ার বলে বিবেচিত হবেন, যা তিনি আদৌ না।

আমেরিকার রুটগার্স ইউনিভার্সিটির প্রাচ্যসাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ জাভেদ মুজাদ্দেদির মতে, রুমি ছিলেন ফারসি ভাষার কবিদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয়, নিরীক্ষাধর্মী কবি ও প্রভাব বিস্তারকারী সুফি দরবেশ। তার প্রভাব কেবল তার নিজের ভাষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তার প্রভাব সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে। কেবল ইসলামের গণ্ডি নয়, তিনি পরিচিত বিশ্বের অন্যান্য ধর্মের পরিমণ্ডলেও। খ্রিস্টান, হিন্দু ধর্মের অনেক সুফি চরিত্রের উপর রুমির প্রভাব যথেষ্ট। ভারতীয় আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব রজনীশ ওশো রুমিকে অনুসরণ করেন দারুণভাবে।

রুমির সমাধির বাইরের অংশ। ছবি: সংগৃহীত

রুমির জনপ্রিয়তার মূল রহস্য হলো সুফিচিন্তাকে কবিতার ভাষায় দারুণভাবে উপস্থাপন করার ক্ষমতা। এপ্রসঙ্গে জাভেদ মুজাদ্দেদি বলেন, ‘রুমির চারটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য আছে। তার একটি হলো, রুমি তার কবিতায় পাঠককে সরাসরি সম্বোধন করেন। তার সময়ের সাহিত্যে এটি ছিল বিরল ব্যাপার। ঠিক একারণেই বর্তমান পাঠকরাও রুমির কবিতা বা আধেয়র সঙ্গে নিজেদের ভালোভাবে মিলিয়ে নিতে পারেন’। ফলে যুগ যগ পেরিয়েও পাঠককে সরাসরি এনগেজ বা ‍নিজের লেখার সঙ্গে একাত্মবোধ করাতে বেগ পেতে হয় না। 

রুমির জনপ্রিয়তার দ্বিতীয় কারণ হিসেবে মুজাদ্দেদি উল্লেখ করেছেন, রুমির কবিতায় থাকা শিক্ষামূলক বক্তব্যকে। অনুপ্রেরণামূলক সাহিত্যের (মোটিভেশনাল লিটারেচার) পাঠকেরা রুমির কবিতার প্রতি এ কারণে ভীষণভাবে আগ্রহী। পাঠকের জীবনকে বদলে দেওয়ার মতো এসেন্স বা সারবত্তা রুমির লেখায় সবসময় হাজির থাকে। ফলে একারণেও পাঠক আর রুমিকে অস্বীকার করতে পারেন না। তখন রুমি সেই আনারের মতো হয়ে উঠেন। যার খোসা ছাড়ালেই জীবন আরো দারুণভাবে ধরা দেয় পাঠকের কাছে। এভাবে রুমি নিজের জীবন দিয়ে মৃত্যুর পরও হাজার বছৈর ধরে পাঠকদের আলোকিত করে যাচ্ছেন।

রুমির কবর। ছবি: সংগৃহীত

তৃতীয় কারণ, রুমি তার কবিতায় মানব জীবনের রোজকার দৃশ্য এঁকেছেন। ফলে মানুষের আত্মিক-বাহ্যিক অভাববোধের এই সময়ে রুমি যে মানুষের কাছে আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন তাই বোধহয় স্বাভাবিক।

রুমির জনপ্রিয়তার চতুর্থ রহস্যটি হলো, রুমির গজলে থাকে প্রিয়তমের সঙ্গে মিলনের গভীর আশাবাদ। আর আমাদের বাংলা কবিতার ধারায় রয়েছে প্রিয়জনের বিচ্ছেদের কথা। ফলে রুমির প্রিয়তমের সঙ্গে মিলনের আশাবাদ মানুষকে ইতিবাচকভাবে নেন।  

তবে এখানে অনেক প্রাজ্ঞজনের দ্বিমত আছে প্রিয়জনের ব্যাখ্যা নিয়ে। অনেকেই এই প্রিয়জনকে খোদা বা এমন কোন আধ্যাত্মিক সত্বা বলে বিবেচনা করেছেন যা মানুষের জীবনের আত্মিক শান্তি এবং জীবন চলার পথের শক্তি ও রসদ জোগায়। আবার আরেকদলে আছেন যারা বলেন যে, রুমির প্রিয়তম আসলে রক্ত মাংসে গড়া মানুষের যে প্রিয়তম আছে বা থাকে তারাই। তবে এপ্রসঙ্গে রুমির কি মত? রুমি বলেন, ‘যে জগত দেখা যাচ্ছে না, তা আসলে আছে /যে জগত দেখা যাচ্ছে, তা আসলে মিছে’–এখানে রুমির হেঁয়ালি স্পষ্ট। এই লাইন ধরে বিবেচনা করলে রুমির ভাষ্যকে সাধারণ বা প্রচলিত অর্থে নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। যা দেখা যায় না তা আসলে আছে, অর্থ্যাৎ, যে প্রিয়তম দেখা যায় না-খোদা/সৃষ্টিকর্তা- তাই আসলে প্রিয়তম। রুমি মসনবীর ১১১ নম্বর শ্লোকে বলেছেন,

‘প্রেমাসক্তি, হোক এদিকের বা ওদিকের

অবশেষে ওদিকেরই পথ দেখায় আমাদের’- এই ওদিক কোন দিক? নিঃসন্দেহে সৃষ্টিকর্তার দিকে।

ফলে রুমির ভাষ্যকে সংকীর্ণ অর্থে নেওয়ার এবং না নেওয়ার দুই রাস্তাই খোলা আছে। কেউ যেমন দুনিয়ার প্রিয়তমর পথ বেছে নিতে পারে তেমনি বেছে নিতে পারে ইটারনাল বা আধ্যাত্মিক এবং পরমসত্ত্বার প্রেমের পথ।

রুমির আবক্ষ ভাস্কর্য। ছবি: সংগৃহীত

মাওলানা শব্দটি দিয়ে অনেকে রুমিকে একটি গণ্ডির মধ্যে আটকে ফেলার চেষ্টা করেন। প্রকৃতপক্ষে মোল্লা, মাওলানা এবং মেভলানার অর্থ হলো শিক্ষক। জালালুদ্দিন রুমি প্রকৃতপক্ষে একজন শিক্ষকই। তিনি মানুষকে গত ৮ শতাধিক বছর ধরে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। পরমসত্ত্বার সন্ধানে তার শিক্ষা চির সবুজ। পুরনো হয় না কখনো।

মাওলানা জালালুদ্দিন রুমিরে কবিতা যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বহুল পঠিত এবং বহুল বিক্রিত। কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয় সারা বিশ্বেই রুমি সমান জনপ্রিয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তার জনপ্রিয়তা।

একবার এক খ্রিষ্টানকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ‘তোমরা কেন এত দুঃখিতচিত্তে তার কবরের পাশে কান্না করছ’? উত্তরে খ্রিষ্টান বলেছিলেন, ‘উনি আমাদের যুগের মসিহ। আমরা তাকে যুগের মুসা এবং দাউদ বলে শ্রদ্ধা করি। আমরা সবাই তার ভক্ত’।

সবাই তার ভক্ত হবারই কথা। তার মুখ নিঃসৃত বাণী আজো মানুষকে মানবতার বাণী শেখায়। তার শিক্ষায় কোন হিংসা, সংঘাতের পথ খোলা থাকে না। এককভাবে কেবল মানব মুক্তি এবং নিজ আত্মার মুক্তির মাধ্যমে পরমসত্ত্বার সন্ধানে নিরন্তর ছুটে চলার শিক্ষা দেন রুমি। প্রেমময় জীবনের আহ্বান পাওয়া যায় তার কবিতায়।

শেষের আগে, রুমি একদা বলেছিলেন, ‘মার্'উন মাখ্ফিয়্যুন লাদাই ত্বায়্যিল্ লিসান’- মানুষ লুকিয়ে আছে তার জিহ্বার নিচেই৷

অর্থাৎ, মানুষের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় সে তার মুখ নিঃসৃত বাণী থেকেই। ফলে, রুমির অন্যান্য বাণীর মতো এই বাণীও যে, আমাদের জীবনে এক পরম শিক্ষা হয়ে থাকবে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। রুমি আজ আমাদের মাঝে জেগে আছেন কেবল তার মুখ নিঃসৃত বাণীর কারণেই।

Link copied!