অগ্নিঝরা মার্চ-৪: ‘রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা’ হয়ে গেল ‘ঢাকা বেতার’

মাহাবুব আলম শ্রাবণ

মার্চ ৪, ২০২৩, ০৫:৩৩ পিএম

অগ্নিঝরা মার্চ-৪: ‘রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা’ হয়ে গেল ‘ঢাকা বেতার’

আজ ৪ মার্চ। ঐতিহাসিক ১৯৭১ সালের এদিনটি ঢাকাসহ পুরো বাংলাদেশ পরিণত হয়েছিল এক বিক্ষুব্ধ জনপদে। হরতাল আর অবরোধে প্রায় অচল হয়ে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের এই শহরটি। উত্তাল সারাদেশ বিক্ষোভ মিছিল আর জনসমাবেশের জোড়ালো কন্ঠস্বরে ভেসে আসে একের পর এক দাবী দাওয়া।

পাকিস্তানের তৎকালীন শাসক ইয়াহিয়া খান এক ফরমানের মাধ্যমে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দিলে সেই অবৈধ এবং স্বৈরাচারী ঘোষণার মাধ্যমে বাঙালি জাতির কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় যেতে পারবে না। বাঙালি জাতি বুঝতে পেরেছিল স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করা ছাড়া অধিকার আদায়ের আর কোনও বিকল্প নেই।

জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা ও গণহত্যার প্রতিবাদে ১৯৭১ সালের এদিনও বঙ্গবন্ধুর ডাকে পালিত হয় ৮ ঘণ্টার হরতাল। যার ফলে ভেংগে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক শাসনব্যবস্থা।

এদিন, পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে চলা হরতালের সময় হামলা, অগ্নিসংযোগ ও গুলিবর্ষণের খবর পাওয়া যায়। চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে দুদিনে (৩-৪ মার্চ) ১২০ জন নিহত ও ৩৩৫ জন আহত হয়। খুলনায় হরতাল পালনকালে সেনাবাহিনীর বিক্ষিপ্ত গুলিবর্ষণে ৬ জন নিহত হয় ও ২২ জন আহত হয়।  

বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে একাত্তরের এদিন পূর্ব পাকিস্তানে থাকা রেডিও পাকিস্তানের ছয়টি বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা অত্যন্ত সাহসীপূর্ণ এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ৪ঠা মার্চ প্রতিষ্ঠানের নাম 'রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা কেন্দ্রের' নাম বদল করে ঘোষণা করা হয় 'ঢাকা বেতার কেন্দ্র'। বদলে ফেলা হয় পাকিস্তান টেলিভিশন এর নামও। রাখা হয় ঢাকা টেলিভিশন।

ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট ও খুলনা বেতার কেন্দ্র একই পদক্ষেপ অনুসরণ করে একাগ্রতা প্রকাশ করে। শুধু তাই নয়, একাগ্রতা প্রকাশের পরই প্রচার শুরু হয় আন্দোলনের সব ধরণের খবরাখবর।

১৯৭১ সালের এদিন বেতার ও টেলিভিশনের শিল্পী ও কলাকৌশলীরা এক গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দেয়। ওিই বিবৃতিতে বেতার-টেলিভিশন সহ চলচ্চিত্র শিল্পীরা জানান, যতদিন পর্যন্ত দেশের জনগণ ও ছাত্রসমাজ সংগ্রামে যুক্ত আছেন, ততদিন পর্যন্ত ‘টেলিভিশন ও বেতারের কোন অনুষ্ঠানে তারা অংশ নেবেন না।

এদিন বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন। এক জরুরি সভায় সামরিক শাসন প্রত্যাহারের দাবি ও ৬ মার্চ সাংবাদিকদের মিছিল এবং বায়তুল মোকাররমে সমাবেশের কর্মসূচিও ঘোষণা দেন তারা।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আলী আশরাফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বলা হয়, সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ওপর যে সব বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের করতে হবে এবং ‘মার্চের গণআন্দোলনে যারা শহীদ হওয়া সেই সকল পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও তাদের হত্যার বিচারের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবীও জানানো হয় সভায়।

তিনি আরোও বলেন ‘স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার না দিলে সাংবাদিকরা বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন না।’

এরা আগে ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ এবং শ্রমিক লীগের যৌথ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

সেই দিনের বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘হয়তো এটাই আমার শেষ ভাষণ। আমি যদি নাও থাকি, আন্দোলন যেন থেমে না যায়। বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলন যাতে না থামে।’ আমার যদি মৃত্যুও হয়, সাত কোটি মানুষ যেন স্বাধীন দেশ দেখতে পায়। বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণ এবংসমাবেশে ছাত্রনেতা শাহজাহান সিরাজের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইশতেহার পাঠ’র সংবাদ পরের দিন ৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়।

Link copied!