নির্বাসনের খাঁচা ভেঙে কবি দাউদ হায়দারের ‘চিরমুক্তি’

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

এপ্রিল ২৮, ২০২৫, ১১:৫৯ এএম

নির্বাসনের খাঁচা ভেঙে কবি দাউদ হায়দারের ‘চিরমুক্তি’

ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

১৯৬০-এর দশকের শেষদিকে দাউদ হায়দার নামক এক যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে যান। ভাইভা বোর্ডে তাকে প্রশ্ন করা হয়: বল তো, ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’—কবিতাটি কার লেখা?

তিনি হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিলেন, আমারই লেখা। কবিতাটির ক’টি লাইন:

‘আমার জন্যই তোমাদের এত দুঃখ

আহা দুঃখ

দুঃখরে!

আমিই পাপী, বুঝি তাই এ জন্মই আমার আজন্ম পাপ।’

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেওয়া কবির বয়স তখন মাত্র ১৭ বছর! সম্ভবত নামের মিলের কারণেই তাকে প্রশ্নটি করা হয়েছিল। উত্তর শুনে বোর্ডের শিক্ষকরা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। 

দেশ থেকে বহিষ্কার

দাউদ হায়দার দেশের প্রথম কবি যাকে কবিতা লেখার জন্য দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। 

সত্তরের দশকের শুরুর দিকে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতার সম্পাদক ছিলেন দাউদ হায়দার। তখন তিনি সাহসী ও প্রগতিশীল কণ্ঠস্বর হিসেবে সাহিত্যজগতে নিজের পরিচয় গড়ে তুলছিলেন। ১৯৭৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘দৈনিক সংবাদ’-এর সাহিত্য পাতায় তাঁর লেখা কবিতা ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ প্রকাশিত হলে তা প্রবল বিতর্কের জন্ম দেয়।

ওই কবিতায় হযরত মোহাম্মদ

, যিশুখ্রিস্ট এবং গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কিত অবমাননাকর উক্তি রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ এনে ঢাকার এক কলেজ-শিক্ষক আদালতে এই ঘটনায় দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।

১৯৭৩ সালে তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর সরকার কবিকে নিরাপত্তামূলক কাস্টডিতে নেয়। ১১ মার্চ ১৯৭৪ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই বছরই ২০ মে সন্ধ্যায় তাকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে ২১ মে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটা রেগুলার ফ্লাইটে ভারতের কলকাতায় পাঠানো হয়। ওই ফ্লাইটে তিনি ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিল না।

তার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, তার কাছে সে সময় ছিল মাত্র ৬০ পয়সা এবং কাঁধে ঝোলানো একটা ছোট ব্যাগ –ব্যাগে ছিল কবিতার বই, দু’জোড়া শার্ট, প্যান্ট, স্লিপার আর টুথব্রাশ। কবির ভাষায়, ‘আমার কোন উপায় ছিল না। মৌলবাদীরা আমাকে মেরেই ফেলত। সরকারও হয়ত আমার মৃত্যু কামনা করছিল।’ 

কলকাতায় নির্বাসিত জীবন

কলকাতায় শুরু হয় দাউদ হায়দারের দীর্ঘ নির্বাসিত জীবন। সেখানকার দিনগুলোও খুব সহজ ছিল না। নির্বাসনে থাকাকালে তিনি তার সাহিত্যচর্চা চালিয়ে যান, লিখে যান বেদনা ও বিচ্ছিন্নতার গভীর কবিতা।

বাংলাদেশের কোনো সরকারই তার প্রতি সহানুভূতি দেখায়নি। নির্বাসিত অবস্থায় ১৯৭৯ সালে তিনি ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসে নবায়নের জন্য পাসপোর্ট জমা দিলে তা বাজেয়াপ্ত করা হয়। তখন ছিল জিয়াউর রহমানের শাসনামল। এরপর ভারত সরকারও তাকে ভারত ত্যাগের ফাইনাল নোটিশ দেয়- “… য়্যু হ্যাভ নো কেইস ফর গ্রান্ট অব লংটার্ম ষ্টে ফ্যাসিলিটিজ ইন ইন্ডিয়া এন্ড য়্যু আর দেয়ারফর রিকোয়েষ্টেড টু লীভ ইন্ডিয়া ইম্মিডিয়েটলি উইদাউট ফেইল।”

বার্লিন-যাত্রা

১৯৮৬ সালের ২২ জুলাই জার্মানির নোবেলজয়ী সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাসের সহায়তায় তিনি বার্লিনে যান। তারপর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই বাস করছিলেন।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এলে আটক পাসপোর্ট ফেরত চেয়ে আবেদন করেও বিফল হন। বার্লিন যাত্রায় তিনি পাসপোর্টের পরিবর্তে জাতিসংঘের বিশেষ ট্র্যাভেল পাস ব্যবহার করেন। পরে এই ট্র্যাভেল পাস ব্যবহার করে বহু দেশ ঘুরেছেন। ১৯৮৯ সালে তিনি জার্মানীতে সাংবাদিক হিসেবে চাকুরী করেন।

উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ

দাউদ হায়দার প্রায় ৩০টির মতো বই লিখেছেন জার্মান, হিন্দি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জাপানি ও স্প্যানিশ ভাষায়। দাউদ হায়দারের কবিতায় ব্যক্তিগত বেদনা, নির্বাসনের কষ্ট, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, স্বাধীনতা-চেতনা, দ্রোহ এবং মানবতাবাদী চেতনা প্রবলভাবে ফুটে ওঠে।

দাউদ হায়দারের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’, ‘সম্পন্ন মানুষ নই’, ‘ধূসর গোধূলি ধূলিময়’, ‘আমি ভালো আছি, তুমি?’, ‘নির্বাসিত’ প্রভৃতি। তার আত্মজীবনী ‘ইল্লিন ঝিল্লিন’ পাঠককে নিয়ে যায় পাবনার দোহারপাড়া গ্রামে, যেখানে তার শৈশব কেটেছিল। এই বইতে উঠে এসেছে ৬০-৭০-এর দশকের সাহিত্য আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি এবং নির্বাসনের করুণ অভিজ্ঞতা।

পরিবার

দাউদ হায়দার ছিলেন এক রত্নগর্ভা মায়ের সন্তান। তার সব ভাই-ই বিখ্যাত, লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। বড় ভাই জিয়া হায়দার নাটকের লোক। রশীদ হায়দার কথাসাহিত্যিক, গবেষক। মাকিদ হায়দার কবি। তারা সবাই প্রয়াত। আছেন কবি জাহিদ ও আরিফ। কনিষ্ঠ আরিফ হায়দার নাটকের মানুষ।

শেষ জীবনের একাকীত্ব

‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’বাংলা কবিতার ইতিহাসে এই পংক্তির রচয়িতে কিংবদন্তি কবি দাউদ হায়দার। প্রায় পাঁচ দশক ধরে মাতৃভূমির মাটি ছুঁতে না পারা এই কবি, শেষ পর্যন্ত ২৭ এপ্রিল ২০২৫ বার্লিনের একটি ক্লিনিকের একাকী কক্ষেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। 

তার একাকী প্রবাসজীবনের শেষ পর্যায় ছিল আরো কঠিন। গত বছরের ডিসেম্বরে বাড়ির সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন তিনি। এরপর রাইনিকেডর্ফ, নয়েকোলন ও গ্রাইফভাল্ডের হাসপাতালগুলোতে দীর্ঘ চিকিৎসা চলে। যদিও কখনো একটু সাড়া ফিরেছিল, তবে কখনোই সম্পূর্ণ সুস্থ হননি।

কবির চিরমুক্তি

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর লেখালেখির কারণে প্রথম নির্বাসিত লেখক দাউদ হায়দারের মৃত্যু শুধু একটি জীবনের অবসান নয়, বরং একটি দীর্ঘ বেদনার গল্পের পরিসমাপ্তি। নির্বাসিত জীবন থেকেও কবির চিরমুক্তি।

তার মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন প্রবাসী লেখক মাইন চৌধুরী। ধারণা করা হচ্ছে, বার্লিনেই কবির দাফন সম্পন্ন হবে।

পঞ্চাশ বছরের নির্বাসনে, কোনো সরকার দাউদ হায়দারকে দেশে ফেরানোর উদ্যোগ নেয়নি। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত তিনি মাতৃভূমির মাটিতে পা রাখতে পারলেন না।

১৯৮৩ সালে কলকাতায় অবস্থানকালে কবি দেশান্তরী হওয়ার গভীর বেদনার কথা লিখেছেন ‘তোমার কথা’ কবিতায়।

‘মাঝে মাঝে মনে হয়

অসীম শূন্যের ভিতরে উড়ে যাই।

মেঘের মতন ভেসে ভেসে, একবার

বাংলাদেশ ঘুরে আসি।

মনে হয়, মনুমেন্টের চুড়োয় উঠে

চিৎকার করে

আকাশ ফাটিয়ে বলি:

দ্যাখো, সীমান্তের ওইপারে আমার ঘর

এইখানে আমি একা, ভিনদেশী।’

বিদায় দাউদ হায়দার।

Link copied!