ইরান, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র—তিন পক্ষই কী বিজয়ী এই ‘১২ দিনের’ যুদ্ধে?

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুন ২৪, ২০২৫, ০৯:৪৮ এএম

ইরান, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র—তিন পক্ষই কী বিজয়ী এই ‘১২ দিনের’ যুদ্ধে?

Photo: collected

মিসাইল ছোড়ার আগেই, ইরান সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছিল। সোমবার সকালে, ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ এক জরুরি বৈঠক করে যুক্তরাষ্ট্রে পাল্টা আঘাতের বিষয়ে আলোচনা করা হয়। তার আগের সপ্তাহজুড়ে ইসরায়েলের হামলায় ইরানের সামরিক নেতৃত্ব ও অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর, সপ্তা শেষে আমেরিকার বোমা হামলায় ইরানের তিনটি মূল পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস হয়—যা ছিল আরেকটি বড় ধাক্কা।

ইরানের সম্মান রক্ষা করা দরকার ছিল। যুদ্ধ পরিকল্পনায় সম্পৃক্ত চার জন ইরানি কর্মকর্তার বরাতে নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, একটি বাংকার থেকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পাল্টা হামলার নির্দেশ দেন।

তবে খামেনি একই সঙ্গে এমন নির্দেশও দেন যে, হামলা সীমিত রাখতে হবে—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এড়ানোর জন্য।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ইরান চেয়েছিল কোনো একটি আমেরিকান লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে, তবে তারা একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আর কোনো পাল্টা হামলা ঠেকাতেও আগ্রহী ছিল।

তাই, ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী কাতারের আল উদেইদ বিমানঘাঁটিকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নেয়—দুই গার্ড সদস্য জানান, এর দুটি কারণ ছিল।

এক, এটি অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি, এবং তারা মনে করেছিল এই ঘাঁটি থেকেই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বি-২ বোমারু বিমান হামলা সমন্বয় করা হয়েছিল।

দুই, এটি কাতারে অবস্থিত—যা ইরানের মিত্র দেশ—তাই ইরান মনে করেছিল যে, ক্ষয়ক্ষতি সীমিত রাখা সম্ভব হবে।

হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে, ইরান মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে আগাম বার্তা পাঠাতে শুরু করে যে হামলা আসন্ন। কাতার তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দেয় এবং আমেরিকানদের সতর্ক করে দেওয়া হয়।

জনসাধারণের কাছে ইরান এই হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রচার করে। টেলিভিশনে এক ভাষণে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র বলেন, কাতারের মার্কিন ঘাঁটিতে হামলাটি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী পরিচালনা করেছে।

তিনি বলেন, “আমরা আমাদের শত্রুদের সতর্ক করে দিচ্ছি—হিট অ্যান্ড রান-এর যুগ শেষ।”

ইরানি রাষ্ট্রীয় টিভিতে দেশপ্রেমমূলক গান বাজানো হয়, আর কাতারের আকাশে বলিস্টিক মিসাইলের আলোয় আলোকিত দৃশ্য দেখানো হয়। টিভি উপস্থাপকরা নাটকীয় ভঙ্গিতে ইরানের গৌরব ও বিজয়ের কথা বলেন, যেন তারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে যুদ্ধে জয় পেয়েছে।

তবে পর্দার আড়ালে ওই চার কর্মকর্তা জানান, ইরানের নেতারা আশা করেছিলেন, তাদের সীমিত হামলা ও আগাম সতর্কবার্তা হয়তো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে পিছু হটতে বাধ্য করবে, আর তার বদলে ইরানও তা করতে পারবে।

কাতারে আমেরিকানদের ওপর হামলা চালানোর আগে, এক ইরানি কর্মকর্তা জানান, পরিকল্পনাটি এমনভাবে করা হয়েছিল যাতে কোনো আমেরিকান নিহত না হয়—কারণ কোনো প্রাণহানি হলে যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা হামলা করতে পারে এবং তাতে সংঘাত চক্রবৃদ্ধি আকারে বাড়তে পারে।

এই পরিকল্পনা কার্যকর হয়েছিল বলে মনে হচ্ছে।

পরে ইরানের পাল্টা অাঘাতের জবাবে ট্রাম্প বলেন, ইরানের ছোঁড়া ১৪টি মিসাইলের মধ্যে ১৩টি ধ্বংস করা হয়েছে, কেউ হতাহত হয়নি এবং ক্ষয়ক্ষতি ছিল সামান্য।

এক বিস্ময়কর বিবৃতিতে ট্রাম্প এমনকি ইরানকে “আগাম সতর্কবার্তা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ” জানান—যার ফলে কারও প্রাণহানি হয়নি।

তিনি বলেন, “তাদের যত কিছু বলার ছিল, সব তারা বলে ফেলেছে। আশা করি, এখন আর কোনো বিদ্বেষ থাকবে না।”

ট্রাম্প এর পর ঘোষণা দেন যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি আসন্ন, যদিও কোনো দেশই তাৎক্ষণিকভাবে তা নিশ্চিত করেনি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি যুদ্ধবিরতির একটি সুবর্ণ সুযোগ। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরানবিষয়ক পরিচালক আলি ভায়েজ বলেন:“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলতে পারে তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে পিছিয়ে দিয়েছে। ইসরায়েল বলতে পারে তারা ইরানকে দুর্বল করেছে। আর ইরান বলতে পারে তারা বেঁচে আছে এবং বড় শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।”

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলার জবাবে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় কোনো মার্কিন নাগরিক নিহত হয়নি, এবং বিশ্লেষকদের মতে এখন একটি যুদ্ধবিরতির সুযোগ তৈরি হয়েছে—কারণ প্রতিটি দেশই নিজেদের জন্য একটি বিজয়ের গল্প তুলে ধরতে পারছে।

এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরায়েল-ইরান সংঘাতকে ‘১২ দিনের যুদ্ধ” হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সবকিছু ঠিকভাবে চললে—যা অবশ্যই চলবে—আমি উভয় দেশকে অভিনন্দন জানাতে চাই।’

ট্রাম্প আরও বলেন, ‘এই যুদ্ধ বহু বছর ধরে চলতে পারত এবং পুরো মধ্যপ্রাচ্য ধ্বংস করে দিতে পারত। কিন্তু তা হয়নি এবং হবেও না!’

বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভাষ্য অনুযায়ী, এ যুদ্ধের অবসান একটি বড় ধরনের মানবিক ও কূটনৈতিক সাফল্য।

 

Link copied!