মে ২১, ২০২৫, ১২:২২ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
ছোটগল্পের সংকলন ‘হৃদপ্রদীপ’ (হার্ট ল্যাম্প) এর জন্য আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জিতে নিয়ে ইতিহাস গড়লেন ভারতীয় লেখক, আইনজীবী ও অধিকারকর্মী বানু মুশতাক।
দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের আনুষ্ঠানিক ভাষা কন্নড়ে লেখা এটাই প্রথম বই, যা আন্তর্জাতিক বুকার জিতল।
১৯৯০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বানু মুশতাকের লেখা ১২টি ছোটগল্পের এই সংকলন ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন দীপা ভাস্তি।
পুরস্কারের ৫০ হাজার পাউন্ড তারা সমান ভাগে ভাগ করে নেবেন। দীপা ভাস্তিই প্রথম ভারতীয় অনুবাদক যিনি আন্তর্জাতিক বুকারে পুরস্কার জিতলেন।
‘হৃদপ্রদীপ’ এর গল্পগুলো দক্ষিণ ভারতের মুসলমান নারীদের দুঃখ-কষ্ট ও সংগ্রামী জীবনের অনন্য চিত্রায়ন। এটাই প্রথম ছোটগল্পের সংকলন, যা বিশ্ব সাহিত্যের এই সম্মানজনক পুরস্কার জিতল।
এর আগে ২০২২ সালে হিন্দি ভাষায় লেখা গীতাঞ্জলি শ্রীর বালির সমাধি (টম্ব অফ স্যান্ড, অনুবাদক: ডেইজি রকওয়েল) আন্তর্জাতিক বুকার জিতেছিল।
বিবিসি লিখেছে, সমকালীন ভারতীয় সহিত্যে বানু মুশতাক পরিচিত এক নাম। তবে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার তার জীবন ও লেখার ওপর নতুন আলো ফেলেছে। ধর্মীয় রক্ষণশীলতা আর পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলা নারীদের জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখা যায় তার গল্পগুলোতে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তার বই নিয়ে এক পর্যালোচনায় লিখেছে, “যে সাহিত্য সমাজে চমকপ্রদ উপস্থাপনাই বেশি বাহাবা পায়, সেখানে হার্ট ল্যাম্প প্রান্তিক জীবনের দিকে মনোযোগ দিতে বলে—এটাই বানু মুশতাকের নিঃশব্দ শক্তি।”
কে এই বানু মুশতাক?
কর্ণাটকের ছোট্ট শহর হাসানের মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় বানু মুশতাকের বেড়ে ওঠা। শৈশবের ভাষা ছিল উর্দু, লেখাপড়ার শুরু মক্তবে। তবে সরকারি কর্মচারী বাবা মেয়ের জন্য চেয়েছিলেন ভিন্ন কিছু।
আট বছর বয়সে বানু মুশতাককে ভর্তি করা হয় শিভামজ্ঞার এক কনভেন্ট স্কুলে, যেখানে পড়ানো হত কন্নড় ভাষায়। শর্ত দেওয়া হল, ছয় মাসের মধ্যে কন্নড় ভাষা তাকে শিখে নিতে হবে।
তবে বেশ দ্রুতই নতুন এ ভাষা রপ্ত করে নেন বানু, পরবর্তী জীবনে এ ভাষাই হয়ে ওঠে তার সাহিত্যচর্চার মাধ্যম।
স্কুল জীবনেই তার লেখালেখির শুরু। সহপাঠীদের অনেকেই যখন বিয়ে করে সন্তান পালনে মনোযোগী হলেন, বানু মুশতাক পড়তে গেলেন কলেজে।
২৬ বছর বয়সে নিজের ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করলেও বানু মুশতাকের দাম্পত্য জীবনের শুরুটা ছিল টানাপড়েন আর বিষাদে ভরা। তিনি নিজেই একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কীভাবে বিয়ের পর তাকে বোরকা আর গৃহস্থালির কাজে বন্দি করে ফেলা হয়েছিল।
ভোগ ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি সবসময় লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু বিয়ের পর হঠাৎ করে আমাকে বলা হল বোরকা পরতে হবে, আর ঘরের কাজেই সময় দিতে হবে। ২৯ বছর বয়সে সন্তানের জন্মের পর আমি বিষণ্নতায় ভুগছিলাম।”
দ্য উইক ম্যাগাজিনকে তিনি বলেছিলেন, হতাশার ওই দিনগুলোতে একবার নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টাও তিনি করেছিলেন।
“সেদিন আমি গায়ে পেট্রল ঢেলে দিয়েছিলাম, কিন্তু আমার স্বামী সময়মতো টের পেয়ে যায়, ম্যাচবক্সটা সরিয়ে নেয়। আমাদের সন্তানকে আমার সামনে রেখে বলে, ‘আমাদের ছেড়ে যেও না’।”
কী আছে বানু মুশতাকের লেখায়?
হৃদপ্রদীপের নারী চরিত্রগুলো যেন বানুর মতই প্রতিরোধ আর টিকে থাকার মানসিকতার অবতার।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এক নিবন্ধে লিখেছে, “মূলধারার ভারতীয় সাহিত্যে মুসলিম নারীদের প্রায়ই নিঃশব্দ দহনের শিকার কিংবা অন্য কারও নৈতিক বিতর্কের প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়। সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে বানু প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার চরিত্রগুলো সহ্য করে, বাহাস করে, মাঝে মাঝে প্রতিবাদও করে—যদিও তা শিরোনাম হয় না, কিন্তু তাদের জীবনে তা গুরুত্বপূর্ণ।”
একসময় স্থানীয় একটি ট্যাবলয়েডে সাংবাদিকতা করেছেন বানু মুশতাক। সাহিত্যের মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়েরবান্দায়া আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
পরে সাংবাদিকতা ছেড়ে বেছে নেন আইন পেশা। সেটা তিনি করেছিলেন সংসারে অর্থ যোগানোর তাড়নায়।
কয়েক দশকের সাহিত্য ক্যারিয়ারে ছয়টি ছোটগল্প সংকলন, একটি উপন্যাস এবং একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশ করেছেন ৭৭ বছর বয়সী বানু মুশতাক।
লিখনশৈলীর তীক্ষ্ণতার কারণে বিতর্ক আর আক্রমণের শিকারও হতে হয়েছে বানু মুশতাককে।
দ্য হিন্দুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, নারীদের মসজিদে নামাজ পড়ার অধিকার চাওয়ায় ২০০০ সালে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। তার নামে ফতোয়া জারি হয়, এমনকি ছুরি মেরে হত্যারও চেষ্টা করে একজন, সে সময় তার স্বামী তাকে বাঁচান।
তবুও লেখালেখিতে বিরতি আসেনি। দ্য উইককে তিনি বলেন, “আমি বরাবরই ধর্মীয় রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে লিখেছি। এখনো তাই করছি। সমাজ বদলেছে, কিন্তু মূল সমস্যা একই রয়ে গেছে। প্রেক্ষাপট হয়ত বদলেছে, কিন্তু নারী আর প্রান্তিক মানুষের সংগ্রামের শেষ হয়নি।”
সাহিত্যকর্মের জন্য কর্ণাটক সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার এবং দানা চিন্তামণি আত্তিমাব্বে পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা পেয়েছেন বানু মুশতাক।
২০২৪ সালে প্রকাশিত তার পাঁচটি ছোটগল্পের সংকলনের অনুবাদ হাসিনা অ্যান্ড আদার স্টোরিজ পেয়েছে পেন অনুবাদ পুরস্কার।
সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।