জাহানারা ইমাম: বাংলাদেশের ন্যায়বিচারের আপোসহীন কণ্ঠস্বর

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুন ২৬, ২০২৫, ০৪:২৩ পিএম

জাহানারা ইমাম: বাংলাদেশের ন্যায়বিচারের আপোসহীন কণ্ঠস্বর

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কিছু নাম রয়েছে, যাদের সাহস, নৈতিকতা ও দৃঢ়তা যুগের পর যুগ ধরে প্রতিধ্বনিত হয়—জাহানারা ইমাম সেই নামগুলোর শীর্ষে। “শহীদ জননী” নামে পরিচিত এই সংগ্রামী নারী ছিলেন শুধু একজন শোকাহত মা কিংবা প্রথিতযশা শিক্ষিকা বা লেখিকা নন, বরং তিনি ছিলেন সেই বিবেকের প্রতিচ্ছবি যিনি জাতিকে ১৯৭১ সালের বিভীষিকা ও আদর্শের বিশ্বাসঘাতকতা ভুলতে দেননি।

১৯২৯ সালের ৩ মে, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন জাহানারা ইমাম। সময়টা ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতার, যা তার বেড়ে ওঠাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। পরবর্তীতে তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং শিক্ষাক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন, হয়ে ওঠেন সিদ্ধেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের সম্মানিত প্রধান শিক্ষিকা।

কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তার বড় ছেলে, মেধাবী ছাত্র শফি ইমাম রুমি, স্বাধীনতার জন্য মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর তিনি আর ফিরে আসেননি। তার স্বামী প্রকৌশলী শরীফুল আলম ইমাম আহমদও বন্দিদশায় নির্যাতনে প্রাণ হারান।

অনেকেই এমন শোকের ভারে নুয়ে পড়তেন। কিন্তু জাহানারা ইমাম সেই বেদনা ও ক্ষোভকে রূপান্তরিত করেন জাতীয় আন্দোলনে।

১৯৮৬ সালে প্রকাশ করেন তার যুদ্ধকালীন দিনলিপি "একাত্তরের দিনগুলি"—যা ভালোবাসা, হারানোর যন্ত্রণা ও প্রতিরোধের এক জীবন্ত দলিল। বইটি দেশে ও বিদেশে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায় এবং একটি যুদ্ধবিদীর্ণ দেশের সামষ্টিক স্মৃতিতে গভীর রেখাপাত করে।

১৯৯০-এর দশকে এসে জাহানারা ইমাম হয়ে ওঠেন জাতির নৈতিক দিকনির্দেশক। যখন ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধে জড়িত ব্যক্তিরা রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ পেতে থাকেন, তিনি স্পষ্ট অবস্থান নেন। ১৯৯২ সালে তিনি গঠন করেন ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, এবং আয়োজন করেন গণআদালত—যা ছিল প্রতীকী বিচার, কিন্তু জনমনে বিপুল আলোড়ন তোলে।

তাঁর এই অবস্থান তাকে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়, হুমকি আসে বারবার, আর শরীরেও বাসা বাঁধে রোগ। তবুও পিছু হঠেননি তিনি। তার কণ্ঠে ছিল সাহসের দৃঢ়তা, যা দাবি জানায়: শহীদদের জন্য বিচার চাই, ইতিহাসের সত্য প্রতিষ্ঠা চাই।

১৯৯৪ সালের ২৬ জুন, যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েটে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করতে করতে চিরবিদায় নেন জাহানারা ইমাম। কিন্তু তার নাম আজও বেঁচে আছে সাহস, প্রত্যয় ও স্মৃতির প্রতীক হয়ে। তিনি জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন—ক্ষমতার বলয়ে ইতিহাসকে চাপা দেওয়া গেলেও সত্যকে চিরকাল দমন করা যায় না। একজন মায়ের শোকও জাতীয় বিবেকের জাগরণে পরিণত হতে পারে।

আজ, যখন বাংলাদেশ এখনো সংগ্রাম করছে পরিচয়, বিচার ও স্মৃতি নিয়ে—তখনও জাহানারা ইমাম আমাদের জন্য পথ দেখানো এক বাতিঘর। তিনি ছিলেন সেই মা, যিনি নিজের কষ্টকে পরিণত করেছিলেন এক জনগণের প্রত্যয়ের ভাষায়।

Link copied!