এপ্রিল ৩০, ২০২৩, ১১:২৯ পিএম
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, আমি মনে করি, কেবল রাষ্ট্রপতি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারেন না। এটা করতে পারে মূলত, জনগণ এবং তারপর, জনগণের শাসন ও গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে চায় এমন সরকার।
রবিবার একটি নিউজ পোর্টালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্যারিস্টার শফিক এসব কথা বলেন।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “আপনি যদি সঠিক গণতন্ত্র চান, নির্বাচন অবশ্যই সঠিক, নিরপেক্ষ এবং অবশ্যই অংশগ্রহণমূলক হতে হবে।
“কারও ইঙ্গিতে নির্বাচন সঠিক হবে না, কারণ এটা গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে পারবে না, আমি সেটাই বিশ্বাস করি।”
৫৬ বছর ধরে আইন অঙ্গণে পদচারণা থাকা শফিক আহমেদকে ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেছে নেন আইনমন্ত্রী হিসেবে। তিনি নির্বাচন করেননি, তবে টেকনোক্র্যাট কোটায় তাকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া হয়।
শফিক আহমেদ মন্ত্রী থাকার সময় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হয়েছে, যে সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করে নির্বাচিত সরকারের অধীনে ভোটের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়।
এর আগে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ‘অসাংবিধানিক’ হিসেবে বর্ণনা করে।
কিছু বিরোধী দল আবার যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছে, তার কোনো আইনি সুযোগ আছে কি-না, এমন প্রশ্নে সাবেক আইনমন্ত্রী বলেন, “গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আপনাকে এমন পথে যেতে হবে, যেটা অন্য অনেক দেশে অনুসরণ করা হয়। যদি অন্য অনেক দেশ যেটা অনুসরণ না করে তাহলে সমস্যায় পড়তে হবে, যেটা আমরা দেখেছি।”
আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার সে অর্থে সরকার নয়। যে সরকার নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কিছু দায়িত্ব পালন করে, সেটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটে সরকার হবে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সেই ধরনের সরকারই গঠন করতে হবে।”
রাষ্ট্রপতির কি আরও ক্ষমতা থাকা উচিত ছিল?
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার বিষয়ে এক প্রশ্নে শফিক আহমেদ বলেন, “অন্যদের সহায়তার মাধ্যমে তিনি দেশ চালান, তার মানে হচ্ছে তিনি একাই এটা চালাচ্ছেন না। অন্যদের সহায়তা পেলে তিনি পরিচালনা করেন এবং সেটাই তিনি করছেন। আমি সেটাই বিশ্বাস করি।”
এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির পদটিকে আলঙ্করিক করা হয়। তার নামে সব আদেশ জারি হলেও আসলে সব নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর। ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য রাষ্ট্রপতির কিছু ক্ষমতা থাকা উচিত ছিল কি না, এটা ছিল আলোচনার বিষয়।
এই প্রশ্নের শফিক আহমেদ বলেন, “রাষ্ট্রপতি এরশাদের পতনের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এর আগে আমরা দেখেছি, রাষ্ট্রপতি পদটির ক্ষমতা ছিল ব্যাপক, অনেকটা আদালতের মত। তবে এটি জনগণের কোনো স্বার্থে ছিল না, তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন।”
১৯৯১ সালে সংবিধান সংশোধনের সময় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য না থাকায় আদর্শ সংসদীয় শাসন নিশ্চিত করা যায়নি বলে যে মত অনেকে দিয়ে থাকেন, সে বিষয়েও প্রশ্ন রাখা হয় সাবেক আইনমন্ত্রীর কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত এবং কোনো কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করেন।
নির্বাচনী ব্যবস্থায় ‘ঘাটতি আছে’
প্রবীণ এই আইনজীবীর মতে, দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় কিছু ঘাটতি ‘নিশ্চিতভাবেই রয়েছে’। তবে ‘সঠিক গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিকদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, “এটা দেশের মানুষকে জানতে হবে এবং এটা অবশ্যই ওইসব মানুষদের নিশ্চিত করতে হবে, যারা বাস্তবিক অর্থে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এটা আমার বিশ্বাস।”
ভারতে নির্বাচন নিয়ে সেভাবে বিতর্ক না থাকা এবং বাংলাদেশে বারবার বিতর্ক উঠার মূল কারণ নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার অভাব কি না, এই প্রশ্নও রাখা হয় সাবেক আইনমন্ত্রীর কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে কিছু ঘাটতি রয়েছে। সে কারণে আমরা সঠিকভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। তবে, আমি মনে করি, যে পথে আমরা যাওয়ার প্রত্যাশা করছি, তা করতে পারলে সেটা করতে পারব।”
তিনি বলেন, “যদি সরকার ও অন্যরা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাদেরকে এমন কিছু করতে হবে, যা সঠিক গণতন্ত্রের জন্য করা প্রয়োজন, সেটা তাদের করতে হবে। এ ছাড়া সঠিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে না। এটা আমার বিশ্বাস।”
ভারত সেটা কীভাবে করেছে- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “ভারতের নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের তুলনায় ভিন্ন। ভারত দীর্ঘদিন ধরেই তাদের দেশ গণতান্ত্রিক উপায়ে চালাচ্ছে। তবে বাংলাদেশ কিছু হোঁচট খেয়েছে, যে কারণে আমরা সঠিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। তবে আমি আশা করি আমরা ভবিষ্যতে সেটা করতে পারব।”
‘এটা দুর্ভাগ্যজনক’
নির্বাচনের ফলাফল চ্যালেঞ্জ করে মামলা নিষ্পত্তি হতে হতে মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া নিয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি বলব, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, এক্ষেত্রে সিদ্ধান্তে আসতে অনেক দীর্ঘ সময় লাগে। এটা আদতে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে।
“এবং এটা জনগণের কাছে কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, যারা চায় গণতন্ত্র সত্যিকার অর্থে এগিয়ে যাক এবং আমাদের রীতি নীতি আরও ভালোভাবে মেনে চলা উচিত।”
নির্বাচনে আস্থা ফেরাতে বিচারালয় কতটা ভূমিকা রাখতে পারে- এই প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক এই সভাপতি বলেন, “কেন নয়? আমাদের বিচারব্যবস্থা নির্বাচনের সময় এক ধরনের ভূমিকা পালন করে। এবং তাদেরকে অনেক দায়দায়িত্ব দেওয়া হয়। এবং আমরা দেখেছি, এটা খুব ভালোভাবে করেছে।”
রাজনৈতিক বিরোধের সমাধান কোথায়?
এ প্রশ্নে শফিক আহমেদ বলেন, “যদি আপনি সমস্যা চিহ্নিত করতে পারেন, তাহলে সেটা সমাধানের সম্ভাবনা থাকবে। শুরুতে সমস্যা চিহ্নিতকরণটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা যদি বের করা যায়, তাহলেই কেবল সেটা সমাধান করা যাবে। আমি বিশ্বাস করি, অনেক ক্ষেত্রে এটা চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সমাধান হয়েছে।
“আমি মনে করি, এক্ষেত্রে চিহ্নিত করা হবে এবং সমাধান করা হবে। তা না হলে, দেশ উন্নতি ও সামনের দিকে এগোতে পারবে না।”
দেশের পথচলার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, দেশ যেভাবে চলা উচিত সেভাবে চলছে না। পরিবর্তন সেখানে রয়েছে এবং এই ক্ষেত্রে পরিবর্তন দরকার।
“আমি বলছি না, সরকার ঠিকমত চলছে না, সরকার ভালোমত চলছে এবং অনেক সমস্যা মুখোমুখি হয়ে তা সমাধানের চেষ্টা করছে। এবং অনেক ক্ষেত্রে সমাধান করা হয়নি এবং এটাও অস্বীকার করা যাবে না। অবশ্যই যদি আপনি সমস্যা তুলে ধরেন, তাহলে সেটার সমাধান করা যাবে।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ‘অপব্যবহারও হচ্ছে’
শফিক আহমেদ আইনমন্ত্রী থাকার সময়ে ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের সংশোধনী এনে সেটাকে ‘কঠোর’ রূপ দেওয়া হয়।
২০১৩ সালের সেই সংশোধনীর পর ২০১৮ সালে সরকার নতুন করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করে, সেটাকে ‘কালাকানুন’ হিসাবে সমালোচনা করে আসছেন অনেকে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হচ্ছে কি না এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “অনেকক্ষেত্রে এটা অপব্যবহার হচ্ছে আবার অনেক ক্ষেত্রে হচ্ছে না।
“আপনি বলতে পারেন না, এটা পুরোপুরি অপব্যবহার হচ্ছে, আবার আপনি বলতে পারেন না এটাকে অনুসরণ করা হচ্ছে। এটাকে অনুসরণের পাশাপাশি অপব্যবহারও করা হচ্ছে। এটার মিশ্রণ এখানে আছে।”
কেবল একটি ফেইসবুকে পোস্টের জন্য জামিনের সুযোগ আইনে না থাকার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “যদি কাউকে গ্রেপ্তারের পর ছাড়া না হয়, তাহলে উচ্চ আদালত আছে, যারা দেখবে কাউকে অন্যায়ভাবে আটক রাখা হচ্ছে কি-না। এভাবে বিভিন্ন জিনিস করতে হবে এবং গণতন্ত্র চলবে।”
গ্রেপ্তারের পরে মামলা দায়ের এবং রাতের আঁধারে গ্রেপ্তারের বিষয়ে এক প্রশ্নে শফিক আহমেদ বলেন, “এটা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
“যদি কাউকে কাস্টডিতে নেওয়া হয়, হয়ত কোনো অপরাধ সংঘটন করতে পারে সেজন্য তাকে আটক করা হয়েছে এবং সেক্ষেত্রে তাকে তার পক্ষে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। সে অপরাধ করেছে কি না। এবং সরকারও সুযোগ নেবে তার অপরাধ প্রমাণের।
“সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে এই ব্যক্তি দোষী, নাকি দোষী নয়। যদি দোষী হয়, তাহলে কেন সে দোষী। দোষী কিংবা নির্দোষ প্রমাণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট উপায়-উপকরণ (ওয়েজ অ্যান্ড মিনস) রয়েছে। অন্যথা হলে জনগণ ও সমাজ সঠিকভাবে চলবে না।”
মামলার নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার সমাধান কী
এ বিষয়ে এক প্রশ্নে সাবেক আইনমন্ত্রী বলেন, “আমাদের মামলার যে সংখ্যা, আর তা নিষ্পত্তিতে যে নানা ধাপ রয়েছে, তাতে বেশ সময় লেগে যায়। কিন্তু তাই বলে এটা বলা যাবে না যে, মামলাগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা হচ্ছে না। আমি বলতে পারি, মামলাগুলো যত দ্রুত সম্ভব নিষ্পত্তি করতে সর্বোচ্চটা দেওয়া উচিত।”
মামলা নিষ্পত্তির গতি বাড়াতে কী কী উদ্যোগ নেওয়া যায়, এমন প্রশ্নে শফিক আহমেদ মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ পদ্ধতি গ্রহণ এবং মামলা আটকে থাকার কারণ অনুসন্ধানের ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, “এমন ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে কেউ মনে না করতে পারে, আমি মামলায় পড়ে হয়রানির শিকার হচ্ছি।”
বিচার ব্যবস্থা বিচারপ্রার্থী দুই পক্ষের মানুষের স্বার্থেই জরুরি, এই বিষয়টাও জানিয়ে রাখেন তিনি।
অনেক সময় আইনজীবীদের কারণেই মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নে জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী বলেন, “আমি মনে করি, খুবই অন্যায়। আইনজীবীদের উচিত নয় এই ধরনের পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়া।
“যদি এটা গ্রহণ করা হয়, তাহলে বিচারব্যবস্থা ভিন্ন দিকে চলে যাবে। সেক্ষেত্রে সঠিক বিচার জনগণকে দেওয়া সম্ভব হবে না।”
সূত্র: বিডিনিউজ