নভেম্বর ২৬, ২০২৪, ০৪:১৬ পিএম
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরই দেশের প্রধান আলোচিত বিষয় সংস্কার। অবশ্য এ আলোচনা এসেছে নতুন সরকারের পক্ষ থেকেই।
অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচনী ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও গণমাধ্যমসহ নানাক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার চালাবে বলে শুরু থেকেই ঘোষণা দিয়ে দেয়। আর এ লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছে আলাদা দশটি কমিশন।
তবে এই মুহূর্তে সংবিধান ও নির্বাচনী সংস্কারের বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বলে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সংস্কার কমিশনের হাতেও সময় কম। প্রস্তাবনাগুলো চূড়ান্ত করে আগামী ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যেই সরকারের কাছে জমা দিতে হবে।
সংবিধান সংস্কার বিষয়ক কমিশন বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে। পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল, আনুপাতিক হারে ভোটের বিধান, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ চালু, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোসহ সংবিধানে বড়সহ পরিবর্তনের পরামর্শ জমা হয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্যরা জানিয়েছেন।
এদিকে গত তিনটি সাধারণ নির্বাচন নিয়ে দেশে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। অনেকেই এটাকে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার সংকট হিসেবেও দেখে থাকেন।
তাই সেখান থেকে উত্তরণে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইনের পরিবর্তন, দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান বাতিল করা, প্রবাসীদের ভোট দেয়ার বিধান চালু এবং ইভিএম পদ্ধতি বাতিল করাসহ বেশ কিছু পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
নির্বাচনী সংস্কার কমিশনের কমিশনের প্রধান হয়েছেন সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন, “যে সব বিষয় সংস্কারের কাজ শুরু করেছি, সেটি বাস্তবায়ন করা গেলে, আগামীতে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হবে।”
তবে সংস্কারের আগেই পুরোনো আইনেই সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং আরও চার কমিশনার নিয়োগ দিয়ে কমিশন পুনর্গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতে সংবিধান সংস্কার করে আইনজীবী শাহদিন মালিককে কমিশন প্রধান করা হয়। কয়েকদিন পরেই তাকে বদলে কমিশন প্রধান করা হয় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আলী রীয়াজকে। নতুন প্রধান এসে ঘোষণা দেন, সংবিধান সংস্কার নয়, পূর্নলিখন করা হবে।
যদিও সংবিধান পুনর্লিখন সম্ভব কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। কারণ বর্তমান সংবিধান মেনেই সরকার ও কমিশনগুলোর কাজ চলছে। এখন সংস্কার কমিশন সংবিধান পুনর্লিখনে হাত দিলে, এসব প্রস্তাবনার অনেক কিছুই সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে, এমন শঙ্কাও দেখা যাচ্ছে বলে বিবিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “আমরা চেষ্টা করবো যাতে আমাদের প্রস্তাবনাগুলোয় সামঞ্জস্য থাকে। পরস্পরবিরোধী না হয়। সেই বিবেচনায় থেকে সেই কাজ করবো।”
সংস্কার যেটাই হোক, সেখানে সমর্থন লাগবে রাজনৈতিক দলগুলোর। কারণ পরবর্তীতে যে দল নির্বাচিত হবে, সংসদে এসব সংস্কার কাজের বৈধতা দিতে হবে তাদেরই।
একারণেই এসব সংস্কারের প্রস্তাবনায় রাজনৈতিক দলগুলো যদি সায় না দেয়, তাহলে এই উদ্যোগ কতখানি সফল হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে বিবিসির প্রতিবেদনে।
তবে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস আশাবাদী যে, রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারে মত দেবেন। জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, সংস্কার কমিশনগুলো সুপারিশমালা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবে সরকার। সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতেই প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে।
আরও পড়ুন: চিন্ময় দাস গ্রেপ্তার: পদক্ষেপ নিতে ভারতের প্রতি ইসকনের আর্জি
সংস্কার কমিশনের সাথে বৈঠকে প্রস্তাব এসেছে যে, বিদ্যমান সংবিধান যে কোনো সরকারকে স্বৈরাচারী করে তুলতে পারে। এ কারণে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে নানা প্রস্তাব এসেছে।
সংস্কার কমিশন এর মধ্যে যেসব পরামর্শ পেয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু, সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা চালু, আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু।
প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা কমানোসহ একজন ব্যক্তিকে দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না রাখার বিষয়টি সংবিধানে যুক্ত করতেও পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে।
২০১১ সালে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে করা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়েও নানা বিতর্ক হয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে ওই সংশোধনী বাতিলের পরামর্শও দিয়েছে অংশীজনদের কেউ কেউ।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরই বর্তমান সংসদ বিলুপ্ত করা হয়েছে। যে কারণে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো কীভাবে অনুমোদন করা যায়, তা নিয়েও মতামত আসছে।
এক্ষেত্রে কারো কারো পরামর্শ গণপরিষদ গঠন করে সংবিধানের অনুমোদন করা। আবার অনেকে বলছেন, সংস্কার প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত করে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে দিলে তারা তা সংসদে তা অনুমোদন করবে।
বাংলাদেশের চারটি নির্বাচন হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সর্বশেষ ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের হওয়া নির্বাচনের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় আসার পর সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপরই বাতিল করা হয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা।
আওয়ামী রীগ সরকারের অধীনে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া তিনটি নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। এতে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে।
এরই ফলে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার করতে কমিশন সদস্যরা দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথ খুঁজছেন বলে বিসিবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আব্দুল আলীম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বলা হয়ে থাকে নির্বাচন কমিশন বা ইসি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ভোটের সময় সরকার যদি ইসির কথা না শোনে তাহলে এ নিয়ে কিছু বলা নেই সংবিধান কিংবা আইনে।”
কমিশন প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনে স্বচ্ছ ভোটার তালিকা প্রস্তুত, রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, নির্বাচনী অপরাধ বন্ধে আইনে সংস্কারের মতো বিষয়গুলোতেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে মতামত নিতে এরই মধ্যে ২২টি রাজনৈতিক দলের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে সংস্কার কমিশন।
বাংলাদেশে পুলিশি কার্যক্রম নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনা রয়েছে মুরু থেকেই। গত সরকারের সময়ও পুলিশের নানা কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আর বিষয়টি সামনে রেখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের পুলিশি কাঠামো ঢেলে সাজাতে চাচ্ছে। এরি মধ্যে সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে ওয়েব সাইটে জনমত জরিপও করেছে।
সেখানে আইনি কাঠামো সংস্কার, পুলিশের জবাবদিহিতা, পেশাদারি দক্ষতা বৃদ্ধি, জনকল্যাণমূলক কাজে পুলিশের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, পুলিশের অপকর্ম রোধে নানা প্রস্তাবনাও এসেছে।
আরও পড়ুন: বুশরার অনড় অবস্থানে অচল ইসলামাবাদ, কে এই বুশরা বিবি
বিবিসর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারের আমলে সরকারি চাকরিজীবীদের আচরণ নিয়ে নানা মহলে প্রশ্নও উঠেছে। আবার অনেক সময় সরকারি আমলাদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি কিংবা পক্ষপাতিত্ব নিয়ে নানা অভিযোগ উঠলেও সেগুলো বন্ধে কঠোর কোন উদ্যোগও নেয়া হয় নি।
গত অক্টোবরে সাবেক আমলা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনও গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই কমিশন এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে।
সংস্কার প্রস্তাবে জনপ্রশাসনে দুর্নীতি বন্ধে উদ্যোগ নেয়া, সরকারি চাকরিতে নিয়োগে স্বচ্ছতা, প্রশাসনে বিকেন্দ্রীকরণে উদ্যোগ, বদলি কিংবা পদায়নে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা মানার মতো বিষয়গুলোও উঠে এসেছে।
সংস্কারকে বর্তমান সংবিধানের সঙ্গে কীভাবে সমন্বয় করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “কোন কোন পরির্বতনগুলো সাংঘর্ষিক হতে পারে, সেটি আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করার আগে তাদের সাথে বৈঠকে বসবো যাতে সাংঘর্ষিক কোন পরিবর্তন না হয়।”
আলী রীয়াজ বলে, “আমরা চাইবো আমাদের প্রস্তাবনার মধ্যে যেন সামঞ্জস্য থাকে। পরস্পরবিরোধী ও সাংঘর্ষিক ধারা না থাকে। সেই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখেই কাজ করতে হচ্ছে।”
এসব কমিশনগুলো সংস্কার প্রস্তাব দিলেও যে চূড়ান্তভাবে সরকার বাস্তবায়ন করতে পারবে, সেটি নিয়েও সন্দেহ আছে বলে বিবিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কারণ কেননা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করার পর, এটি নিয়ে রাজনৈতিক দলের সাথে আবার বৈঠকে বসার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে, অনেক সুপারিশই শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন না হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিবিসির প্রতিবেদন: রাষ্ট্রের যেসব বিষয়ে বড়সড় পরিবর্তনের কথা ভাবছে সংস্কার কমিশনগুলো