ফুলবাড়ী ট্র্যাজেডি দিবস আজ, ১৯ বছরেও পূরণ হয়নি ৬ দাবি

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

আগস্ট ২৬, ২০২৫, ১২:২৪ পিএম

ফুলবাড়ী ট্র্যাজেডি দিবস আজ, ১৯ বছরেও পূরণ হয়নি ৬ দাবি

ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি এশিয়া এনার্জির উন্মুক্ত খননপদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালে ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট রক্তাক্ত হয় দিনাজপুরের ফুলবাড়ী। দেশের সম্পদ রক্ষা ও এশিয়া এনার্জিকে প্রত্যাহার দাবির এই আন্দোলনে সেদিন বিশাল বিক্ষোভে তৎকালীন বিডিআরের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন তরিকুল, আমিন ও সালেকিন নামের তিন তরুণ। আহত হন ২ শতাধিক আন্দোলনকারী। সেই আন্দোলনের ১৯ বছর আজ। প্রতিবছর এই দিনটিকে ‘ফুলবাড়ী ট্র্যাজেডি দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।

তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ প্রদীপ সরকার দীর্ঘদিন ভুগে মারা যান। শ্রীমান বাস্কে গুলিবিদ্ধ হয়ে দীর্ঘদিন ভোগেন। আর এক গুলিবিদ্ধ বাবলু রায় নানা সংকটের মাঝে দিনযাপন করছেন। খবর সমকাল।

ফুলবাড়ী খনিতে প্রায় ৫৭০ মিলিয়ন টন কয়লা রয়েছে। ১৯৯৪ সালে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়ার সংস্থা বিএইচপির সঙ্গে সরকারের চুক্তি হয়। পরে এশিয়া এনার্জির সঙ্গে সরকার ৩০ বছর মেয়াদি একটি অসম চুক্তি করে। প্রস্তাবিত ওই চুক্তি অনুযায়ী, উত্তোলিত কয়লার মাত্র ছয় শতাংশ পাবে বাংলাদেশ, ৯৪ শতাংশ পাবে এশিয়া এনার্জি। যার ৮০ শতাংশ এশিয়া এনার্জি রপ্তানি করবে। প্রস্তাবিত কয়লাখনি হলে পুরো ফুলবাড়ী শহরসহ আশপাশের কয়েকটি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পানির স্তর নিচে নেমে গেলে কৃষিতে প্রভাব পড়বে, হুমকির মুখে পড়বে পরিবেশ। এসব বিবেচনায় পরিবেশবাদীরা সোচ্চার হন। গঠন করা হয় ‘ফুলবাড়ী রক্ষা কমিটি’। শুরু হয় আন্দোলন। দাবি ছিল ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জির সব কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। সরকারকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, ফুলবাড়ীতে কোনো উন্মুক্ত পদ্ধতির কয়লাখনি হবে না।

২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট তেল-গ্যাস, খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি বহুজাতিক কোম্পানি এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী অফিস ঘেরাও কর্মসূচি দেয়। ফুলবাড়ী, বিরামপুর, পার্বতীপুর ও নবাবগঞ্জ উপজেলার হাজার হাজার মানুষ এ কর্মসূচিতে অংশ নেয়। ছোট যমুনা সেতুর পূর্ব পাশে পুলিশ ও বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) ওই মিছিলে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আমিনুল ইসলাম আমিন ও মো. সালেকিন এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তরিকুল ইসলাম নিহত হন। শুরু হয় অনির্দিষ্টকালের হরতাল-অবরোধ।

৩০ আগস্ট ছয় দফা সমঝোতা চুক্তি সই হয়। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার চুক্তির আংশিক বাস্তবায়ন করে। চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবিতে এখনও ফুলবাড়ী খনি অঞ্চলের মানুষ আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন।

৬ দফা চুক্তির মধ্যে ছিল, এশিয়া এনার্জিকে ফুলবাড়ী ও দেশ থেকে বহিষ্কার, উন্মুক্ত পদ্ধতির কয়লাখনি ফুলবাড়ীসহ দেশের কোথাও না করা, পুলিশ-বিডিআরের গুলিতে নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান ও আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা, গুলি বর্ষণসহ হতাহতের প্রকৃত কারণ উদঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠন, শহীদের স্মৃতিসৌধ নির্মাণসহ এশিয়া এনার্জির দালালদের গ্রেপ্তা‌রসহ শাস্তি প্রদান, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহার এবং নতুন করে মামলা না করা।

ছয় দফা চুক্তি করার পর আন্দোলনের সমাপ্তি হয়। সেই থেকে প্রতি বছর ২৬ আগস্ট দিনটিকে ‘ফুলবাড়ী ট্র্যাজেডি দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।

২৬ আগস্টে নিহত-আহতদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ, শহীদের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের অর্থ প্রদান, তখনকার সময়ে যে মামলাগুলো হয়েছিল তা প্রত্যাহার, সেদিন পুলিশ-বিডিআর যে বাড়ি-ঘরগুলো ভেঙে দিয়েছিল তার ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় পরবর্তীতে।

শিক্ষক ও ফুলবাড়ী আন্দোলনের সংগঠক সঞ্জিত প্রসাদ জিতু বলেন, যেসব চুক্তি সেসময় বাস্তবায়ন হয়েছে তা সময়ের বিশেষ দাবি ছিল। কিন্তু আসল দাবিগুলোই অপূরণীয় আছে। 

সাবেক পৌর মেয়র মাহমুদ আলম লিটন বলেন, ৬ দফা চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চাই। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লাখনিবিরোধী আন্দোলন চলমান আছে। যে খনি মানুষের কল্যাণের থেকে অকল্যাণ বেশি করবে, তা কখনো জনগণ করতে দেবে না। দিবসটি উদযাপনের জন্য আজ শোক র‍্যালি, স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। 

জেলা বিএনপির উপদেষ্টা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. খুরশিদ আলম মতি বলেন, ৬ দফা চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চাই। মানুষের জানমাল বিলীন করে ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে দেবে না ফুলবাড়ীবাসী। ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

সম্মিলিত পেশাজীবী সংগঠনের সমন্বয়ক এবং ফুলবাড়ী পৌরসভার সাবেক মেয়র মুরতুজা সরকার মানিক বলেন, এশিয়া এনার্জি আন্দোলনকারী নেতাকর্মীদের আন্দোলন থেকে দূরে রাখতেই মিথ্যা মামলা দিয়েছে। দুই মামলাতেই (ক্ষতিপূরণ আর ভাংচুরের) আমাকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। কয়লা খনির সুবিধা হচ্ছে সাময়িক আর জনগণ এলাকার জমির ফসলের সুফল পাবে অনন্তকাল। সুতরাং এশিয়া এনার্জিকে কোনোভাবেই মাঠে নামতে দেওয়া হবে না। বর্তমান সরকার অনেক মামলা প্রত্যাহার করছে, আমাদের মামলা প্রত্যাহারের দাবি করছি।

ফুলবাড়ী তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সৈয়দ সাইফুল ইসলাম জুয়েল বলেন, স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে। অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে আমরা দাবি জানাচ্ছি ৬ দফা চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হোক। আগামী দিনের সরকার বিগত সরকারের মত দেশের স্বৈরাচারী যে মনোভাব দেখিয়েছে তা থেকে সরে আসবে। এ সম্পদ জাতির স্বার্থ ছাড়া কোনো বহুজাতিক লুটেরাদের ভোগ করতে দেওয়া যাবে না।

Link copied!