এপ্রিল ৩, ২০২৩, ১০:৫৪ পিএম
কর প্রশাসনের অযোগ্যতায় রাজস্ব আদায়ে সরকারের ক্ষতি হচ্ছে বছরে সর্বনিন্ম ৫৫ হাজার ৮'শ কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২ লাখ ৯২ হাজার ৫'শ কোটি টাকা।বাংলাদেশের সামস্টিক অর্থনীতির মোট আকারের ৩০ দশমিক ২ ভাগ অনানুষ্ঠানিক বা ছায়া অর্থনীতি। এই সুবিশাল লেনদেন কর প্রশাসনের আওতার বাইরে থাকায় সরকার ওই পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।
এছাড়া, শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর এমএনসি বা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো উন্নয়নশীল দেশে ব্যবসা করে একটি বিশাল অংকের অর্থ ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে পাচার করে নিচ্ছে। বাংলাদেশেও এমন কর ফাঁকির পরিমাণ কম নয়।
বছরে রাজস্ব ক্ষতির এ পরিমাণ বাংলাদেশের বাজেটে বাৎসরিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ও স্বাস্থ্য খাতে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি)'র এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণা প্রতিবেদনের ফলাফল প্রকাশ উপলক্ষে সিপিডির ধানমন্ডি কার্যালয়ে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সিপিডি জানায় ১২টি প্রতিষ্ঠান, ১০ জন সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ, এনবিআরের ২ জন সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মতামত এবং কর এড়ানো ও কর ফাঁকির পরিমাণ নির্ধারণের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে গবেষণাটি করা হয়েছে। উন্নয়ন সংস্থা 'ক্রিশ্চিয়ান এইড' সিপিডির এ গবেষণার আর্থিক সহায়তা দেয়।
গবেষণার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে সিপিডি'র পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, "আমরা অনুমান করছি, কর ফাঁকির একটি অংশ পাচার হয়। কিছু অংশ বিনিয়োগ হয়। আবার কিছু অংশ প্রতিষ্ঠানের সম্পদের মধ্যে থাকে।"
গবেষণায় বলা হয়, রাজস্ব ক্ষতির অন্যতম প্রধান কারণ অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিক খাত। এটি ‘ছায়া অর্থনীতি’যার প্রকৃত হিসাব করা কঠিন। এসব খাত থেকে এনবিআর কর আদায় করতে পারে না। অনানুষ্ঠানিক খাতের কারণে ২০১০ সালে কর ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এরপর প্রতিবছরই এই ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। ২০২১ সালে এসে তা ৪ গুণ বেড়ে ৮৪ হাজার ২২৩ কোটি টাকা হয়েছে।
সিপিডি জানায়, দেশে বর্তমানে ২ লাখ ৫০ হাজার রেজিস্টার্ড কোম্পানীর মধ্যে মাত্র ৩০ হাজার কোম্পানী আয়কর রিটার্ন দাখিল করে। ৬৮ শতাংশ নাগরিক আয়কর দেয় না। নিবন্ধিত মোট ২ লাখ ১৩ হাজার ৫০৫ যৌথ মূলধনী কোম্পানীর মধ্যে মাত্র ৪৫ হাজার কোম্পানী ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করে। এছাড়া পাট, বস্র, পোল্ট্রি ও প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন ৩ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কর রেয়াত পায়।
সিপিডি জানায়, এসব কারনে দেশে রাজস্ব আদায়ের হার কমে প্রতি বছর সরকার একটি বিরাট অংকের অভ্যন্তরীণ তহবিল হারাচ্ছে যা বাজেটে আকারকে শক্তিশালী করতে পারে।
গবেষণায় বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এ অনুপাত ১৫ শতাংশে উন্নীত করতে হলে বছরে সরকার আড়াই লাখ কোটি টাকা বাড়তি আয় করতে সক্ষম হবে। আরও বলা হয়, কর এড়ানো ও কর ফাঁকির কারণে যে পরিমাণ কর ক্ষতি হয়, তা ঠেকানো সম্ভব হলে কর-জিডিপি অনুপাত ১৫ শতাংশে পৌছে যেত।
সিপিডি বলেছে, দেশে সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ বা ২৫ লাখ মানুষ রিটার্ন জমা দিয়ে আয়কর পরিশোধ করেন।
কর ক্ষতি কমাতে সিপিডি'র সুপারিশ হলো কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করা, কর অব্যাহতি কমানো, নগদ অর্থের পরিবর্তে স্বয়ংক্রিয় লেনদেন প্রবর্তন করা।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, "এই গবেষণা করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনে কর ফাঁকির তেমন একটা তথ্য মেলে না। আর্থিক প্রতিবেদনের বাইরে লেনদেনের হদিস করতে হবে। এ ছাড়া কর কর্মকর্তাদের মধ্যেও অটোমেশন নিয়ে অনীহা আছে। কর ছাড়ের বিষয়ে একটি মূল্যায়ন হওয়া উচিত। যেসব খাত কর ছাড় পেয়ে দাঁড়িয়ে গেছে, তাদের এই সুবিধা প্রত্যাহার করে উদীয়মান খাতে এই সুবিধা দেওয়া দরকার।"
রাজস্ব খাত সংস্কারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তাবলী পূরণ করাকে গুরুত্ব দিয়েছেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
আইএমএফ এর শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশকে ২০২৬ সালের মধ্যে কর-জিডিপি অনুপাত ৯ শতাংশে নিতে হবে।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে রাজস্ব খাতে সংস্কারের শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। তাদের শর্ত পূরণ করলেই রাজস্ব খাতের সংকট কেটে যাবে।
তিনি আরও বলেন, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হবে বাংলাদেশ। তখন অভ্যন্তরীণ খাত থেকে রাজস্ব আদায়ে নির্ভরশীল হতে হবে। কারণ, তখন বিদেশি সহায়তা কমে যাবে।