বেক্সিমকোর ৩২ কোম্পানি বিক্রির পরিকল্পনা সরকারের

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ডিসেম্বর ৬, ২০২৪, ০৩:৫৫ পিএম

বেক্সিমকোর ৩২ কোম্পানি বিক্রির পরিকল্পনা সরকারের

ফাইল ছবি

বকেয়া বেতন, ভাতার দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষের প্রেক্ষিতে, দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে বেক্সিমকো গ্রুপের ৩২টি কোম্পানির স্বত্ব বিক্রির পরিকল্পনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার।

বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল (শিল্প) পার্কের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রম ও ব্যবসা পরিস্থিতি পর্যালোচনাপূর্বক সুপারিশ করতে সরকার উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি গঠন করেছে। গত ২৮ নভেম্বর কমিটির প্রথম বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ড বাংলা অনলালাইনের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেয়া হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈঠকে জনতা ব্যাংককে ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে বেক্সিমকোর ‘বি’ ক্যাটাগরির কোম্পানিগুলো বিক্রির জন্য একটি এক্সপ্রেশন অফ ইন্টারেস্ট (ইওআই) চূড়ান্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) মন্ত্রণালয়ের কাছে এবিষয়ে অগ্রগতি সম্পর্কে সাপ্তাহিক আপডেট জানাবে।

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মজিবর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এক্সপ্রেশন অফ ইন্টারেস্ট প্রস্তুত করার জন্য কাজ করছি।’

নৌপরিবহন ও শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা শ্রমিকদের বকেয়া দ্রুত পরিশোধের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করেন, তারপরে পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেক্সিমকোর কিছু কোম্পানি বিক্রি করে দেয়ার পরামর্শ দেন।

সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সুপারিশকে সমর্থন করেন এম সাখাওয়াত হোসেন।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে শ্রম অসন্তোষে জর্জরিত বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, ফলে কোম্পানিটি কর্মীদের বেতন দিতে পারছে না।

গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান। রাজধানী থেকে নৌপথে পালানোর চেষ্টাকালে গত ১৩ আগস্ট তাকে সদরঘাট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

বেক্সিমকোর কোম্পানিগুলোকে শ্রেণিকরণের পরামর্শ

সভায় বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বেক্সিমকো গ্রুপের ১৬৯টি প্রতিষ্ঠানকে তিনটি ক্যাটাগরি বা শ্রেণিতে ভাগ করার পরামর্শ দেন।

লাভজনক হওয়ায় তিনি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসকে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে রাখার পরামর্শ দেন। একইসঙ্গে কোম্পানির শেয়ারধারীদের হাতে থাকা শেয়ার হস্তান্তর বন্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেন।

১৬টি পোশাক ও টেক্সটাইল কারখানাসহ বর্তমানে বেক্সিমকো গ্রুপের ৩২টি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলছে, এগুলোকে ‘বি’ ক্যাটাগরি-ভুক্ত করা হবে। বাকি ১৩৬টি কোম্পানিকে ‘সি’ ক্যাটাগরি-ভুক্ত হবে।

‘বি’ ক্যাটাগরিভুক্ত কোম্পানিগুলোর স্বত্ব জনতা ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংকের মাধ্যমে এক্সপ্রেশন অফ ইন্টারেস্ট জারি করে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির প্রস্তাব দেন আশিক চৌধুরী।

শ্রমিকদের তিন মাসের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধপূর্বক ‘সি’ ক্যাটাগরিতে থাকা কোম্পানিগুলো বন্ধ করার সুপারিশ করেন তিনি।

এসব আলোচনার প্রেক্ষিতে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে অবস্থিত কোম্পানিগুলোর কর্মীদের তিন মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এজন্য দরকারি তহবিল প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয় জনতা ব্যাংককে।

সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, এসব সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করবে বিডা ও শ্রম মন্ত্রণালয়।

জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকোর ঋণ

এর আগে জনতা ব্যাংক থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বেক্সিমকোর কাছে জনতা ব্যাংক পাবে ২৩ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা, যারমধ্যে ১৯ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা মন্দ ঋণ হিসেবে শ্রেণীকৃত। বাকি প্রায় ৩ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা ওভারডিউ অবস্থায় রয়েছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে যা মন্দ ঋণে (খেলাপি) পরিণত হবে।

কোনো ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি কোনো একক গ্রাহককে ঋণ না দেওয়ার বিধান রয়েছে ব্যাংক কোম্পানি আইনে। কিন্তু, এই সীমাকে ৪১০ শতাংশ ছাড়িয়ে আশঙ্কাজনক মাত্রায় ঋণগুলো দেওয়া হয়েছে। আইনের এই সুস্পষ্ট লঙ্ঘন সত্ত্বেও সেসময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ হিসেবে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের রিসিভারকে বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ হিসাবে মনোনীত করে এক সপ্তাহের মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানিগুলোর শেয়ার স্থানান্তরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

অধিগ্রহণে আগ্রহী পক্ষ

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের একটি কনসোর্টিয়াম গত অক্টোবরে বেক্সিমকো ফার্মা ও বেক্সিমকো লিমিটেডের অধীন লাভজনক চারটি কোম্পানি অধিগ্রহণের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে একটি প্রস্তাব দিয়েছে।

দুবাই-ভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান আদসুম ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট এই কনসোর্টিয়ামের পক্ষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে এই প্রস্তাবনার চিঠি দেয়। তবে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের পরিচয় জানায়নি আদসুম।

অধিগ্রহণ প্রস্তাবে উল্লেখ করা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো– বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, তিস্তা সোলার, বেক্সিমকো কমিউনিকেশন্স (স্যাটেলাইন অ্যান্ড ডিটিএইচ লাইসেন্স) এবং বেক্সিমকো লিমিটেড (টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক বিভাগ)।

বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণের ফাইলগুলোর দায়িত্বে থাকা জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে টিবিএস জানতে পেরেছে যে, দুবাই-ভিত্তিক কনসোর্টিয়ামটির সাথে বেক্সিমকো গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

নাম না প্রকাশের শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে দুবাই হয়ে বেক্সিমকো নিজেদের কোম্পানিগুলো পুনরায় কিনে নেয়ার চেষ্টা করছে।’

বেক্সিমকোর তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর পারফরম্যান্স

বর্তমানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তালিকাভুক্ত বেক্সিমকো গ্রুপের চারটি কোম্পানি, এগুলো হলো – বেক্সিমকো ফার্মা, বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো সিন্থেটিক্স এবং শাইনপুকুর সিরামিকস। বেক্সিমকো ফার্মা লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জেরও তালিকাভুক্ত।

বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৮৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকার সমন্বিত মুনাফা হওয়ার কথা জানিয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ২৯ শতাংশ বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সমন্বিত মুনাফা ছিল ৪৫২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য কোম্পানিটি ৪০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে নগদ লভ্যাংশ দেয় ৩৫ শতাংশ। গত কার্যদিবসে কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারদর ছিল ৮০ টাকার উপরে।

সে তুলনায়, আর্থিক দুর্দশায় রয়েছে বেক্সিমকো লিমিটেড। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কোম্পানি ৩৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা লোকসান করেছে, অথচ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭১০ কোটি টাকা মুনাফা ঘোষণা করেছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তাদের শেয়ারপ্রতি লোকসান ৪১ পয়সা। সে তুলনায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ৭ টাকা ৯২ পয়সা।

লোকসানের পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কোম্পানিটি সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের ৫ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দেওয়ার সুপারিশ করে। সে তুলনায়, আগের অর্থবছরে ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল। গত কার্যদিবসের লেনদেনে, কোম্পানিটির শেয়ারদর ১১০ টাকার উপরে ছিল।

শেয়ারপ্রতি আয় ৬১ শতাংশ কম হওয়ার কথা জানিয়েছে শাইনপুকুর সিরামিকস। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪১ পয়সা থাকলেও – ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি আয় ১৬ পয়সায় নেমেছে। স্পন্সর-ডিরেক্টরদের বাদ দিয়ে কোম্পানিটি শুধুমাত্র সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। গত কার্যদিবসে তাদের শেয়ারদর ছিল ১৩ টাকার উপরে।

এর আগে গত ১৯ সেপ্টেম্বর, বেক্সিমকো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা এবং গ্রুপের সব সম্পত্তি সংযুক্ত (অ্যাটাচ) করতে ‘রিসিভার’ নিয়োগ করার আদেশ দেন হাইকোর্ট। এই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. রুহুল আমিনকে রিসিভার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া বেক্সিমকো গ্রুপের জন্য সহকারী রিসিভার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন- ড. সুমন্ত সাহা, সিএফএ অতিরিক্ত পরিচালক; মো. নাহিম উদ্দিন, সিএফএ, যুগ্ম পরিচালক এবং মো. আতিউর রহমান, উপ-পরিচালক।

Link copied!