বাজেটে কর্পোরেট কর উপেক্ষা হতাশাজনক : এমসিসিআই

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুন ১, ২০২৩, ০৯:১৫ পিএম

বাজেটে কর্পোরেট কর উপেক্ষা হতাশাজনক : এমসিসিআই

কর্পোরেট কর হারের ক্ষেত্রে নগদ লেনদেনের শর্তাবলী পুনর্বিবেচনা বিষয়ে কোনো প্রস্তাবনা না থাকায় এমসিসিআই হতাশা ব্যক্ত করছে। বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির (Informal Economy) বিবেচনায় এই ধরনের শর্তাবলী সামঞ্জ্যপূর্ণ নয়। অপরদিকে, চেম্বার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এমন নির্মাণ, অবকাঠামো, ইত্যাদি পরিষেবাতে উৎসে কর কর্তনের (টিডিএস) হার কমানোর পরামর্শ দিচ্ছে। তদুপরি বাংলাদেশে কার্যকরী করহার অত্যন্ত বেশী। উৎসে কর কর্তনের (টিডিএস) হারকে যৌক্তিকীকরণের মাধ্যমে কার্যকরী করহার কমানোর জন্য যুগোপযোগী একটি পদক্ষেপ চেম্বার আশা করে। বৃহস্পতিবার বাজেটের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মেট্রোপলিটন চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইণ্ড্রাষ্ট্রি একথা জানায়।

করমুক্ত আয়কর সীমা ব্যতিরেকে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম কর দুই হাজার টাকা প্রদান করে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া, আয়কর দাতাদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একই সাথে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতকে (এসএমই) প্রাতিষ্ঠানিক খাতে রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে এই করহার বাধাগ্রস্ত করবে বলে চেম্বার মনে করে। সুতরাং, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতসমূহে এই করহার পুনঃবিবেচনা করার জন্য এমসিসিআই পরামর্শ দিচ্ছে। অপরপক্ষে, কর আদায়করণকে সহজীকরণের লক্ষ্যে “কর প্রতিনিধি” নিয়োগ আয়কর আইনে সন্নিবেশিত বিধান বাস্তবায়নের পূর্বে বিস্তারিত বিশ্লেষণ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে করার জন্য এমসিসিআই পরামর্শ প্রদান করছে। কর প্রতিনিধিগণকে স্বচ্ছতার সাথে প্রয়োজনীয় ব্রিফিং, প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন বলেও এমসিসিআই মনে করছে। অন্যথায় করপ্রদানকারী ও করআদায়কারীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটার আশংকা রয়েছে।

এমসিসিআই রপ্তানিমুখী শিল্পের বিকাশে সরকারের পদক্ষেপসমূহের প্রশংসা করছে। সকল রপ্তানীমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎসে কর কর্তনের (টিডিএস) হার ১% থেকে কমিয়ে ০.৫০% করলে রপ্তানীমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ অনেকাংশে লাভবান হতো বলে চেম্বার বিশ্বাস করে। বর্তমান বিশ্বঅর্থনীতিতে বাংলাদেশের রপ্তানি বিবেচনায় টিডিএস-এর হার যৌক্তিকীকরণ করা প্রয়োজন বলে এমসিসিআই মনে করে।

কর হার কমানো সত্ত্বেও আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী এনবিআর কর্তৃক অ-অনুমোদিত/অনুমোদিত নয় এমন ব্যবসায়িক খরচ (আয়কর অধ্যাদেশের ৩০ ধারা) ও প্রস্তাবিত টিডিএস উভয়ই এখনো উচ্চ পর্যায়ের, যা ন্যূনতম আয়করকে প্রভাবিত করে (আয়কর অধ্যাদেশের ৮২সি ধারা) এবং কার্যকরী করহারকে ৪০-৪৫% এ উন্নীত করে। সুতরাং যথাযথভাবে নথিভুক্ত সকল প্রকৃত খরচ সম্পূর্ণরূপে অনুমোদিত হওয়া উচিত। এ বিষয়গুলি যৌক্তিকভাবে বিবেচনা করা অথবা বাদ দেওয়া উচিত।

এমসিসিআই সবসময় বলে আসছে যে, প্রতিষ্ঠানের টার্নওভারের উপর ন্যূনতম কর (মিনিমাম ট্যাক্স) করনীতির পরিপন্থী এবং তাই এটি বাদ দেওয়া প্রয়োজন। ব্যবসায় যদি লাভ হয় তবে কর শুধুমাত্র করযোগ্য আয়ের উপর প্রযোজ্য হবে এবং রাজস্ব বা অন্যকোনো তহবিলের উপর প্রযোজ্য হবে না। সেহেতু এমসিসিআই প্রতিষ্ঠানের টার্নওভারের উপর মিনিমাম ট্যাক্স বাতিল করার জন্য অনুরোধ করছে। প্রতিষ্ঠানের টার্নওভারের উপর মিনিমাম ট্যাক্স এর ক্ষেত্রে মূল যুক্তি হলো কর পরিহার রোধ করা, এবং অন্যান্য সমস্ত রাজস্ব সংগ্রহ করা। সেই সাথে কর প্রশাসনের মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহের সময় যার কোনো করযোগ্য আয় নেই এমন ব্যবসায়ীরা যেন শাস্তি না পায়, সেটি নিশ্চিত করা। যদি প্রতিষ্ঠানের টার্নওভারের উপর উচ্চমাত্রায় মিনিমাম ট্যাক্স, টিডিএস ও মূল্যায়নের মাধ্যমে নিয়মিত কর নির্ধারণ করা হয়, তবে অন্য দুটি অপরিবর্তিত রেখে শুধুমাত্র একটি ক্ষেত্রে কর হ্রাস করলেও তা কার্যকর ফল বয়ে আনবে না। এক্ষেত্রে এমসিসিআই’র পরামর্শ হলো নিয়মিত মূল্যায়নকৃত আয়কর সবক্ষেত্রে টিডিএস ও এআইটির উপর প্রাধান্য পাবে।

 বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্যের মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রস্ফীতি বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধিসহ করনেট সম্প্রসারণ সরকারের জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। এই বাস্তবতায় বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা ৩৫০,০০০ টাকা বৃদ্ধি সত্যিই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তৃতীয় লিঙ্গের করদাতাদের জন্য করমুক্ত সীমা ৩৫০,০০০ থেকে বাড়িয়ে ৪৭৫,০০০ করার প্রস্তাব প্রশংসনীয়। বর্তমানে ব্যক্তি করদাতাদের ৩ কোটি পর্যন্ত সম্পদের উপর কোনরূপ সারচার্জ প্রযোজ্য নয়। বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির বাজারে এই সীমা ৪ কোটি পর্যন্ত করায় চেম্বার প্রসংশা করছে।

এমসিসিআই ভ্যাটের জন্য কেন্দ্রীয় নিবন্ধনের বিধান স্পষ্টীকরণের জন্য প্রশংসা করছে। এছাড়াও, উপকরণ, উৎপাদ করের সংজ্ঞায় সংশোধনী ব্যবসাকে সহজীকরণে ভুমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইলেকট্রনিক ফিসকাল ডিভাইস (ইএফডি) পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করলে সামগ্রিক ভ্যাট সংগ্রহ প্রক্রিয়া ত্বরাণ্বিত হবে। যতদ্রুত সম্ভব সম্পূর্ণ ভ্যাট ব্যবস্থাকে অটোমেশনের আওতায় নিয়ে ইএফডি-এর পর্যাপ্ততার জন্য এমসিসিআই পরামর্শ দিচ্ছে। আমাদের দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির দৃশ্যমান আধিপত্য রয়েছে, সেক্ষেত্রে তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে ভ্যাট আদায়ে কতটুকু সফলতা আসবে সেটি বিবেচনার বিষয়। তবে তৃতীয়পক্ষের ভ্যাট আদায়কারীদের স্বচ্ছতার সাথে প্রয়োজনীয় ব্রিফিং, প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন। যাতে করে ভ্যাটদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি না ঘটে। ভ্যাট আইনের কাঠামোগত সংস্কারের জন্য (মূল ভ্যাট আইন, ২০১২-তে অন্তর্ভুক্তি) কোনো উল্লেখযোগ্য পরামর্শ না থাকায় এমসিসিআই হতাশা ব্যক্ত করছে। চেম্বার বিশ্বাস করে যে, কার্যকর অটোমেশন থাকা (ইন্টিগ্রেটেড ভ্যাট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সিস্টেম (আইভিএএস) ও অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (এপিআই) এর মধ্যে ইন্টারফেসসহ) ভ্যাট সিস্টেমকে কার্যকর করে তুলবে। এটি অধিক ভ্যাট সংগ্রহ নিশ্চিত করতে এবং আরো প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতায় আনতে সাহায্য করবে। এছাড়াও, এমসিসিআই জোরালোভাবে প্রস্তাব করছে : ১) ইনপুট-আউটপুট সহগ বাদ দেওয়া, ২) ইনপুটের উপর রেয়াতের সীমাবদ্ধতা সহজ করা, এবং ৩) উৎসে ভ্যাট অব্যাহতির সুযোগ হ্রাস করা।

 আমদানিকৃত পণ্যসামগ্রীর সম্পূরক শুল্কের হার বৃদ্ধি জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে পারে বলে চেম্বার আশংকা করছে। উচ্চ দ্রব্যমূল্যের কারণে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হবে। বর্তমান অর্থবছরের মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫.৬ শতাংশ। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মূদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ শতাংশ। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরে এপ্রিল মাসের মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৯.২৪ শতাংশ। বর্তমান পরিস্থিতিতে এমসিসিআই মনে করে এই লক্ষ্য বাস্তবসম্মত নয়। এছাড়াও ফ্ল্যাট ও স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে করহার বৃদ্ধি ব্যক্তি ও কোম্পানীর উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এমসিসিআই এই করহার বৃদ্ধির পরিবর্তে মৌজাভিত্তিক মূল্য পুনঃনির্ধারণের পরামর্শ দিচ্ছে।

রাজস্ব বহির্ভূত আয় (নন-ট্যাক্স রেভিনিউ) এবং এনবিআর বহির্ভুত খাতে মোট ৭০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত সরকারী লাইসেন্সিং প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন- বিএসটিআই; আরজেএসসি; আমদানী-রপ্তানী নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, ইত্যাদি। ফলশ্রুতিতে ব্যবসায়িক ব্যয় বৃদ্ধি পাবে বলে এমসিসিআই মনে করে। এছাড়াও উক্ত মাশুল বৃদ্ধি সরাসরি জনগণের উপর প্রভাব ফেলবে বলে চেম্বার আশংকা প্রকাশ করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুৎচালিত ও হাইব্রিড যানবাহনসমূহের শুল্ক কমানোর প্রস্তাবনাকে এমসিসিআই স্বাগত জানাচ্ছে। তবে কোম্পানী/প্রতিষ্ঠান কর্তৃক একাধিক মোটর যান ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই ধারার বাস্তবায়ন সমস্যাসংকুল করতে পারে। কেননা এ সকল পরিবহন কর্মকর্তা ও কর্মচারী বিশেষ করে নারীদের পরিবহনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাছাড়া এই পরিবেশ সারচার্জ প্রচলিত বাস ও ট্রাক অর্থাৎ পরিবেশ দুষণকারী যানবাহনের উপর প্রযোজ্য নয়। এক্ষেত্রে চেম্বারের পরামর্শ হলো কোম্পানীসমূহের যানবাহনের ক্ষেত্রে এই সারচার্জ প্রযোজ্য হওয়া উচিত নয়। একই সাথে ইলেক্ট্রিক যানবাহনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ব্যাটারিসমূহের অপসারণ ব্যবস্থাপনার একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা আবশ্যক।

স্মার্ট বাংলাদেশের নিরীখে “ক্যাশলেস বাংলাদেশ”, “ডিজিটাল ব্যাংক ও ক্রেডিট স্কোরিং সিস্টেম” এবং “ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা” বিষয়গুলো সম্পর্কে জাতীয় বাজেট প্রস্তাবনায় আলোচনা করা হয়েছে। যা অটোমেশন প্রক্রিয়ায় বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে এমসিসিআই বিশ্বাস করে।

স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও পর্যায়ক্রমিক পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন সাপেক্ষে বাজেটের বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। বর্তমান বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে বাজেট বাস্তবায়নের মূল্যায়ন আবশ্যক। অতএব, এমসিসিআই মনে করে যে, তিন (৩) মাস পরে বাজেটের একটি অন্তর্বর্তী মূল্যায়ন হওয়া উচিত। পরবর্তী বছর থেকে প্রতি তিন (৩) মাসে অন্তর্বর্তী মূল্যায়ন করা উচিত। প্রয়োজনে এটি পুনর্গঠন ও সেই অনুযায়ী সংশোধন করা যেতে পারে। সমাজ ও অর্থনীতিতে যে সব সমস্যার প্রভাব রয়েছে, সে সব উদ্ভুত সমস্যা মোকাবেলা করার প্রয়োজন হতে পারে।

এমসিসিআই দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বরাবরের মতোই তার পরামর্শ ও সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে।

Link copied!