ইউএনইপি’র কৌশলগত প্রতিবেদন

প্লাস্টিক পণ্যে শনাক্ত হলো ৩,২০০ বিষাক্ত রাসায়নিক

মেহেদী আল আমিন

আগস্ট ৩১, ২০২৩, ১২:১৫ এএম

প্লাস্টিক পণ্যে শনাক্ত হলো ৩,২০০ বিষাক্ত রাসায়নিক

সংগৃহীত ছবি

সম্প্রতি এক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকের তৈরি পণ্যে ৩ হাজার ২০০ বিষাক্ত রাসায়নিক শনাক্ত করা হয়েছে যেগুলোর মধ্যে বিদ্যমান এক বা একাধিক উপাদান শরীরে ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের জন্য দায়ী।

গত মে মাসে প্রকাশিত জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি’র (ইউএনইপি) এক কৌশলগত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে। ৩ মে প্রকাশিত “প্লাস্টিকে রাসায়নিক: একটি কৌশলগত প্রতিবেদন” শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, “প্লাস্টিক উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় অথবা প্লাস্টিকে থাকে এমন রাসায়নিক ১৩ হাজারেরও বেশি।

এমন ৭ হাজার রাসায়নিক নিয়ে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৩ হাজার ২০০ টি বিষাক্ত রাসায়নিক পাওয়া গেছে, এর প্রতিটিতে এক বা একাধিক উদ্বেগজনক উপাদান শনাক্ত করা হয়েছে যেগুলোর সাথে ক্যান্সার, জীনগত, প্রজনন, শ্বাসনালীতে সমস্যাসহ আরো কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্পর্ক রয়েছে। এসব রাসায়নিক সহজেই পরিবেশ ও মানবদেহের সাথে মিশে যায় এবং মানবদেহে হরমোনে পরিবর্তন, উর্বরতা শক্তি ও নার্ভাস সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত করে।

পলিথিন, চায়ের কাপ থেকে শুরু করে পানির বোতল- একবার ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিক পণ্য, তৈজসপত্র এবং আসবাব এমন বিভিন্ন পণ্যে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে জীবনযাত্রা।

গৃহ কিংবা অফিস সবক্ষেত্রে এর ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। আবার এসব পণ্যের মধ্যে শিশুদের ব্যবহার উপযোগী পণ্যও রয়েছে অনেক।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয় “নারীদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম এসব রাসায়নিক পরবর্তী জেনারেশনেরও ক্ষতি করতে পারে।”

শিশুদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে বিভিন্ন খেলনা ও ব্যবহৃত পণ্য থেকে শিশুরা সহজেই মুখ ও নিশ্বাসের সাথে এসব রাসায়নিক গ্রহণ করে এবং মস্তিষ্কের উন্নয়ন, বৃদ্ধি ও এর ফলে আচরণগত সমস্যাগুলো হয়।

প্লাস্টিকের খেলনা, পুতুল ও অন্যান্য শিশুদের ব্যবহার উপযোগী পণ্যে থাকা রাসায়নিক শিশুরা মুখে নিয়ে আর নিশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করছে। তারা খুব অসহায় ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে বলে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইউএনইপির প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “এসব রাসায়নিক শুধু প্লাস্টিকের কাঁচামাল, পলিমার তৈরি, প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের সময়ই নিঃসৃত হয় না, বরং যতদিন পণ্যটি ব্যবহার হবে রাসায়নিক নির্গত করতেই থাকবে। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে না পারলে সেগুলো পানি, মাটি এমনকি বাতাসের সাথে গিয়ে মিশবে এবং সম্পূর্ণ ক্ষয়ে যাওয়া পর্যন্ত রাসায়নিক নির্গত করতেই থাকবে।”

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ধরনভেদে প্লাস্টিক  কয়েকশত বছর থেকে কয়েক মিলিয়ন বছর পর্যন্ত সময় লাগে মাটিতে মিশে যেতে।

খেলনা ও অন্যান্য শিশুপণ্য, প্যাকেজিং, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, যানবাহন, সিনথেটিক টেক্সটাইল ও সম্পর্কিত পণ্য, আসবাবপত্র, নির্মাণ সামগ্রী, মেডিকেল ডিভাইস, ব্যক্তিগত পরিচর্যা ও তৈজসপত্র, কৃষি, মৎস্যসহ বিভিন্ন খাত ও ভ্যালু চেইনে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের নমুনায় এসব রাসায়নিকগুলো ‍পাওয়া গেছে।  

উল্লেখ্য, জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচী ২০২২ সালে এক রেজুলেশন গ্রহণ করে যার মাধ্যমে ২০২৪ সালের মধ্যে প্লাস্টিক দূষণ বন্ধে একটি বৈশ্বিক চুক্তিতে উপনীত হওয়ার ব্যপারে সিদ্ধান্ত হয়, যে চুক্তির অধীনে ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণ বন্ধ হবে। বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো এ চুক্তির খসড়া তৈরি করবে কোন ৪টি সেশনে বৈঠক করে। এর দ্বিতীয় সেশনটি হয় গত ২৯ মে থেতে ২ জুন ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। পরবর্তী সেশন অনুষ্ঠিত হবে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে ১৩-১৯ নভেম্বর।

পর্যবেক্ষক হিসাবে বৈঠকে অংশ নেয়া এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোসাল ডেভেলপম্যান্ট অর্গানাইজেলমন (এসডো) মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, “আগেই যে কাজটি করতে হবে একবার ব্যবহার উপযোগী সকল ধরনের পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা। এর পরে অন্যান্য পণ্যের ব্যবহার কীভাবে কমিয়ে আনা যায় ধীরে ধীরে সেদিকে আমাদের যেতে হবে।”

২০২১ সালের “ট্রান্সবাউন্ডারি মুভমেন্ট অব প্লাস্টিক ওয়েস্ট: সিচুয়েশন অব বাংলাদেশ” শীর্ষক এসডোর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশ প্রতিদিন ৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি করে। কিন্তু পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা- এ তিনটি নদী প্রতিদিন ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য বাংলাদেশের উপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে নিয়ে যায়।

এ তিনটি নদীর মোট ১৭ লাখ ২০ হাজার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে যার মাত্র ৭ শতাংশ বাংলাদেশের উপর দিয়ে।

“আমাদের দেশের ভৌগলিক অবস্থান অনুযায়ী আন্তঃসীমান্ত প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রবেশ নিষেধের ব্যাপারে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি একটি আইনগত বাধ্যতামূলক বৈশ্বিক চুক্তিতে উপনীত হতে হবে, বলেন শাহরিয়ার।

কোরিয়ান সোসাইটি অব এনভায়রনম্যান্টাল ইঞ্জিনিয়ার্স-এর ২০২১ এর আরেকটি গবেষণায়  বলা হয়েছ, “বাংলাদেশে প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্লাস্টিক পণ্যের বাজার রয়েছে। যার মধ্যে ২.২ বিলিয়ন আভ্যন্তরীণ আর ৮০০ মিলিয়ন ডলার রফতানি বাজার। বাজার ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে।”

বাংলাদেশে ছোট বড় মিলিয়ে ৫ হাজার প্লাস্টিক কারখানা রয়েছে।

নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক মার্টিন ওয়াগনার বলেন, “কিভাবে আমরা বিষাক্ত রাসায়নিকগুলো সরিয়ে সেখানে ক্ষতিকর নয় এমন রাসায়নিক প্রতিস্থাপন করতে পারি, এটাই বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য। প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এক আমূল পরিবর্তন দরকার। এতে অধিক অর্থ বিনিয়োগ ও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

“বিষাক্ত অথবা বিষাক্ত না, এর মধ্যবর্তী সীমারেখা নির্ধারণও গুরুত্বপূর্ণ,” বলেন তিনি।

আইএনসি-২ এর ভাইস চেয়ার ও জর্ডানের পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জেনারেল সেক্রেটারি মোহাম্মাদ আল-খাশাশনেহ্ এ প্রতিবেদককে বলেন, “আমরা খুব খুশি ছিলাম যখন জেনারেল  এসেম্লিতে রেজুলেশনটি গ্রহণ করা হয়। তবে প্রসিডিউয়াল আলোচনায় অনেকটা বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। সবাইকে উদার মনোভাব নিয়ে আগাতে হবে। উন্নত, অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল- সবাই আমরা এ পৃথিবীতেই বাস করি।

“আমরা প্লাস্টিককে আক্রমণ করছি না। আমরা প্লাস্টিক উৎপাদনকেও অতোটা না। আমরা দেখছি এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে কিভাবে প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করা যায়। উৎপাদন কিছুটা প্রভাবিত হবে তবে ততোটা না। আমরা চাচ্ছি সার্কুলার ইকোনমি আর সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা,” তিনি বলেন।

চলতি বছর ১৬ মে প্রকাশিত ইউএনইপি’র আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৪০ সাল নাগাদ সার্কূলার অর্থনীতিতে পুনর্ব্যবহার বৃদ্ধি করে ৩০ শতাংশ দূষণ কমানো সম্ভব। রিসাইকেল কমাতে পারে ২০ শতাংশ এবং টেকসই বিকল্প ১৭ শতাংশ দূষণ কমাতে পারে। ৩০ শতাংশ সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার সম্পূর্ণ বর্জন করা সম্ভব।

আইএনসি-২ শুরুর প্রাক্কালে গত মে’তে বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক এসোসিয়েশনের সভাপতি সামিম আহমেদ বলেছিলেন, “বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্লাস্টিক এসোসিয়েশনগুলোতে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা জারি রেখেছি। বৈশ্বিক প্লাস্টিক চুক্তি আলোচনায় যুক্ত সরকারি ডেলিগেশন দলের সাথেও যোগাযোগ করে আমরা জানিয়েছি ব্যবসায়ের জন্য কোন কোন বিষয়গুলো আলোচনায় থাকা দরকার।”  

Link copied!