জলবায়ু পরিবর্তন : স্বাস্থ্যঝুঁকিতে দেশের লাখ লাখ মানুষ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

অক্টোবর ১৮, ২০২৩, ১১:০৫ পিএম

জলবায়ু পরিবর্তন : স্বাস্থ্যঝুঁকিতে দেশের লাখ লাখ মানুষ

দেশের মত স্বাস্থ্যসেবা এবং উন্নয়নের অগ্রগতির জন্য পরিচিত একটি দেশের অর্জনসমূহ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটি জনগণের কল্যাণকে প্রভাবিত করছে। দারিদ্র্য দূরীকরণে প্রতিবন্ধকতা এবং নেট-জিরো আগামীর পথে অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।

সম্প্রতি গ্রান্থাম রিসার্চ ইন্সটিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিক্সের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে মিসেস লরেন ও’লিরি, শৌরো দাশগুপ্ত, পিএইচডি, এবং অধ্যাপক এলিজাবেথ জেজেড রবিনসন উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশে চরম আবহাওয়ার ঘটনা ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালের গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ০.৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছিল, যার ফলে অতিরিক্ত ১২টি তাপপ্রবাহ এবং উচ্চ তাপজনিত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে শিশুরা।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের মধ্যে তাপজনিত মৃত্যু ১৪৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং ২০১৭-২০২১ সালে এ কারণে ১৪৩০ জন মানুষের মৃত্যু ঘটে।

ডক্টর শৌরো দাশগুপ্ত, গ্রান্থাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট, এলএসই-এর ভিজিটিং সিনিয়র ফেলো এবং প্রতিবেদনের লেখক বলেছেন, “জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য, বিশেষ করে শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কয়েক দশকের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ফিরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে৷ স্থানীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেওয়া প্রমাণ- ভিত্তিক নীতিগুলি এই নেতিবাচক প্রভাবগুলির অনেকগুলিকে কমাতে পারে।"

প্রতিবেদনটিতে তুলে ধরা হয়েছে যে খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মত দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা তরুণ বা বয়স্ক জনগোষ্ঠী উচ্চতাপ ও তাপপ্রবাহের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বায়ু দূষণের মাত্রায় বাংলাদেশ নিয়মিতই শীর্ষে অবস্থান করছে।

স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে ফুসফুসের সংক্রমণ, ক্যান্সার ও হৃদরোগজনিত মৃত্যুর হার অনেক বেশি। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হল, পরিবেশে দূষিত বায়ুর কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ২০১৯ সালে ১০, ১৫০০ জন এবং ২০২০ সালে ১১, ২৭০০ জনে এসে ঠেকেছে । তাছাড়াও গ্রাম এবং শহরাঞ্চল উভয় জায়গাতেই বায়ু দূষণের পরিমাণ বেড়েছে। পরিসংখ্যান মতে, ২০০৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র ঢাকাতেই বায়ু দূষণের ফলে ২৪, ০০০ জন অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাছাড়াও, নারী ও শিশুদের মধ্যেও ঘরের অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেড়েছে। কারণ মাত্র ২৩ শতাংশ জনগোষ্ঠীর কাছে পরিষ্কার জ্বালানি ব্যাবহার করে রান্নার সুযোগ রয়েছে।

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়-এর বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, “স্থানীয় তাপপ্রবাহের পেছনের চালিকাশক্তিগুলো বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতাকেও প্রভাবিত করছে। এ কারণে তাপপ্রবাহের পরিমাণ, তীব্রতা ও মাত্রা বাড়ছে, অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানির ক্রমবর্ধমান ব্যবহারে তাপমাত্রা ও বায়ু দূষণ উভয়ই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য সেটি একটি বহুমুখী ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”

বন্যা, খরা, এবং বৃষ্টিপাতের ধরন ব্যাহত হবার ফলে বাস্তুসংস্থান ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে করে বাংলাদেশের খাদ্য, পুষ্টি এবং জীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশংকা করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হার বাংলাদেশে আরও বাড়তে থাকবে। ২০৪১-২০৬০ সালের মধ্যে এটি ৭.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা যায়। তাছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উচ্চ বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রাজনিত কারণে ডেঙ্গুর মত রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়বে পারে। কারণ এধরনের জলবায়ু মশার বংশবিস্তারের জন্য অনুকূল। এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তন মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলছে, উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতার মতো সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা সেক্টর প্রোগ্রাম (এইচপিএসপি) এর এই প্রতিবেদনে শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ করা হয়নি, বরং স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির লক্ষে পূর্ববর্তী নীতিমালার উপর আরও বেশি মনোযোগ দেয়া হয়েছে। ২০০০ সালের জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির(এনএইচপি) প্রাথমিক নীতিমালায় জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী রোগসমূহের উপর যথেষ্ট জোর দেওয়া হয়নি। এর ফলে জলবায়ুসৃষ্ট তাপপ্রবাহজনিত সমস্যার বিরুদ্ধে সহনশীলতা হ্রাস পেয়েছে।

২০১২ সালে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি সংশোধনের পরেও কোন বড় ধরনের পরিবর্তন আসেনি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। ধনী ও সুবিধাবঞ্চিত পরিবারগুলোর মধ্যে অসমতা এবং স্বাস্থ্য সূচকে বৈষম্য তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়। হেলথ কেয়ার ফাইন্যান্সিং স্ট্র্যাটেজির (২০২১-২০৩২ ) লক্ষ্য হল স্বাস্থ্যখাতে অর্থায়ন বাড়ানো। কিন্তু বাজেট সংকোচনের কারণে ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ (ইউএইচসি) তথা সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে অগ্রগতি হয়নি এবং এজন্য উদ্যোগটি সমালোচনার মুখে পড়েছে।

সাম্প্রতিককালের কিছু পদক্ষেপ জলবায়ু-সচেতন স্বাস্থ্য নীতির দিকে যাত্রার আভাস দিচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ব্ল্যাক কার্বন নিঃসরণ ৪০ শতাংশ এবং মিথেন নিঃসরণ ১৭ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যে শর্ট লিভড কার্বন পলিউট্যান্ট (এসএলসিপি) শীর্ষক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। শক্তিশালী সমাজ ও বাস্তুতন্ত্র অর্জনের লক্ষ্যে জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতার জন্য ন্যাশনাল এডাপ্টেশন প্ল্যান (এনএপি) ২০২৩-৫০-এর স্বাস্থ্য খাতকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাছাড়াও, স্বাস্থ্য, পানি সম্পদ, কৃষি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলা করার জন্য ২০১০ সালে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখছে।

সাম্প্রতিক সকল উদ্যোগেই জলবায়ু-সচেতন স্বাস্থ্যনীতি অবলম্বনের চেষ্টা করা হচ্ছে। লো-কার্বন ইকোনমি অবলম্বন করলে পরিবর্তনশীল জলবায়ুর বিপরীতে সহনশীলতা অর্জন এবং স্বাস্থ্য খাতে সুবিধাসমূহ অর্জন করতে পারবে বাংলাদেশ। বায়ু দূষণ হ্রাস পেলে, জনগণের শারীরিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেলে এবং তাদের খাদ্যতালিকায় ইতিবাচক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানা সহ-সুবিধাসমূহ অর্জিত হবে। গতানুগতিক রান্নার চুলায় ইটের ভাটা, ধান সেদ্ধ করার মেশিন, কঠিন বর্জ্য পোড়ানো এবং যানবাহনের মত স্থানীয় উৎস হতে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণ কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করার লক্ষ্যে প্রণীত এসমস্ত নীতিমালা ব্যয় সাশ্রয় এবং স্বাস্থ্যের উন্নতি নিশ্চিত করতে পারে। এটি স্বাস্থ্য এবং জলবায়ু পরিস্থিতি—উভয়ের উন্নতির জন্যই একটি ‘উইন উইন’ কৌশল। এরকম কার্যকরী ব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে না পারলে আগামী দশকগুলোতে জলবায়ু জনিত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো বাড়তেই থাকবে। সামনে এগিয়ে যেতে চাইলে দ্রুত এমন নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে হবে যার ফলে সকলকে সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনা যায় এবং জলবায়ু সহনশীল জাতি গঠন করা যায়। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিকভাবে স্বাধীনতার পর থেকেই জলবায়ু পরিবর্তনের স্বাস্থ্যগত প্রভাবসমূহকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার জন্য জনস্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে। তাই একটি সমন্বিত নীতিমালা গঠন জরুরি। এখানে কিছু ভাবনার বিষয় রয়েছে, যেমন শহর অঞ্চলে গাছপালার অভাব, দ্রুত নগরায়ন, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং ভারী যানবাহন ইত্যাদি।

 এনএপি ২০২৩-২০৫০ অনুযায়ী, সবুজ অবকাঠামো গঠন এবং পরিবেশবান্ধব সমাধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যদিও এই সমস্ত প্রস্তাবকে টেকসই উদ্যোগে রূপান্তর করার জন্য আরও অধিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে। শ্রমিকদেরকে অধিক তাপ জনিত অসুস্থতা থেকে রক্ষা করতে শ্রম সুরক্ষা নীতি বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরি, যেন নিম্ন-কার্বন অর্থনীতির দিকে আমাদের এগিয়ে যাওয়া সহজতর হয়।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন এবং স্বাস্থ্য প্রচার ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল কবির (পিএইচডি) বলেছেন, “জলবায়ু সংকট বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল জনস্বাস্থ্য সংকটের কারণও বটে। জলবায়ু পরিবর্তন ইতিমধ্যেই বিশ্ব জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। চরম আবহাওয়ার কারণে বায়ু দূষণ এবং জলবায়ু-সংবেদনশীল রোগের প্রকোপ বাড়ছে। আমরা জানি, বাংলাদেশ একটি জলবায়ু-সহনশীল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছে। তাই এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে, স্বল্প কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হতে দ্রুততার সাথে এই সমস্ত নীতিমালা বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি যাতে করে আজকের ও আগামী প্রজন্মের সকলের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।”

এছাড়াও প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের স্বাস্থ্যগত প্রভাব মোকাবেলায় একটি মাল্টি সেক্টরাল পদ্ধতির দাবি জানানো হয়েছে। এখানে জনস্বাস্থ্য সেবা জোরদার করতে হবে, বিশেষ করে বয়স্ক এবং শিশুদের মতো নাজুক জনগোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। জলবায়ু-সংবেদনশীল রোগবালাইগুলো ট্র্যাকিং করার জন্য আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা এবং নজরদারি ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখা অত্যন্ত জরুরি। তাছাড়া, জলবায়ু বান্ধব স্মার্ট-কৃষি, শস্য বৈচিত্র্যকরণ, এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মতো উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে কৃষি খাতকে অগ্রসর করতে হবে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা পর্যাপ্ত শক্তি এবং সামর্থ্য নিশ্চিত করতে যা অত্যন্ত অপরিহার্য।

Link copied!