“সবচেয়ে ভালো অভিযোজন হচ্ছে প্রশমন”

মেহেদী আল আমিন

নভেম্বর ১৬, ২০২৩, ০২:০১ পিএম

“সবচেয়ে ভালো অভিযোজন হচ্ছে প্রশমন”

জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ একেবারে সম্মুখ সারিতে আছে: সাবের হোসেন চৌধুরী। ছবি: তাহির জামান প্রিয়/দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

সাবের হোসেন চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রীর জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত। গতবছর কপ২৭ এ নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে। একইসাথে তিনি “পার্লামেন্টিরিয়নস কল ফর ফসিল ফুয়েল ফ্রি ফিউচার”র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, যার সদস্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় এক হাজার সংসদ সদস্য। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধে কাজ করছেন তারা। এ বছর ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর দুবাইয়ে অনুষ্ঠিতব্য কপ২৮ নিয়ে কথা বলেছেন দ্য রিপোর্ট-এর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেদী আল আমিনের সঙ্গে। 

প্রশ্ন: এবারই প্রথম কোনো জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর দেশ বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন আয়োজন করতে যাচ্ছে, এ বিষয়ে বিভিন্ন ফোরামে বিতর্ক উঠেছে। আপনি কী মনে করেন?

সাবের হোসেন: সংযুক্ত আরব আমিরাত অনেকটা নির্ভর করে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর। কপ প্রেসিডেন্ট যিনি সেদেশের একজন মন্ত্রী। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি একটি জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর দেশ থেকে এসেছেন, যেখানে সম্মেলনের পুরো স্পৃহাটাই জীবাশ্ম জ্বালানির বিপরীতে। অনেকেই তো মনে করে শিয়ালের কাছে মুরগি পাহারা দেয়ার মতো অবস্থা।

উনি হেসে বলেছিলেন, ২৭টি সম্মেলন হয়ে গেল। কোনো আয়োজক দেশই তো ফসিল ফুয়েলের পক্ষে ছিল না। এ পর্যন্ত যা অর্জন, তাতে কি আপনারা সন্তুষ্ট? এবারই প্রথম এ লবি থেকে কেউ এসেছে। আপনারা দেখেন কতটুকু করতে পারি।

উনার ঐ জবাবের পর আমার ধারণা, প্রত্যাশা অনেকটাই বদলে গেছে। তিনি আন্তরিক। আমার মনে হয় না এ বিষয়ে চিন্তা করার কিছু আছে।

অন্য ২৭টি কপের তুলনায় এবারের কপে আমরা কী অর্জন করতে পারলাম এটি হবে তাঁর যোগ্যতা ও আন্তরিকতার মাপকাঠি। আমি আশাবাদী আগের সম্মেলনগুলোর চেয়ে এবার অগ্রগতির মাত্রাটা বেশি হবে।

প্রশ্ন: এবার কোন বিষয়গুলো বড় ইস্যু হয়ে থাকবে আলোচনার টেবিলে?

সাবের হোসেন: আমাদের ভাবতে হবে দুই কপের মাঝখানের সময়টাতে বিশ্বব্যাপী কী কী ঘটলো। এ বছর জুলাই হলো ‍পৃথিবীর উষ্ণতম মাস। এর তীব্রতা আরও বাড়বে। বলা হতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ভবিষ্যতে পড়বে। এখন এটি বাস্তব, আর ভবিষ্যতের বিষয় নেই। এবারের প্রেক্ষাপট এটি।

এটি আমাদের শেষ সুযোগ। সুযোগ সীমিত সময়ের জন্য থাকে। এবার কাজে না লাগালে পারলে, যাই করবো যথেষ্ট হবে না। অনেক দেরি হয়ে যাবে।

এনডিসি (জাতীয় কার্বন নিঃসরণ কমাতে দেশগুলো যে লক্ষ্য নির্ধারণ করে) বাড়াতে হবে যদি প্রাক-শিল্পায়ন সময় হতে ২১০০ সালের শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।

এটি হচ্ছে একটি অ্যাকশনের জায়গা। সবচেয়ে ভালো অভিযোজন হচ্ছে প্রশমন। গতবার শার্ম আল-শেখে চাচ্ছিল তাপমাত্রা বৃদ্ধি সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যমাত্রা ২ ডিগ্রিতে নিয়ে যাওয়ার। ইন্টারগভর্নম্যান্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) ষষ্ঠ পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির বেশি হয়ে গেলে উন্নয়নকে আর টেকসই রাখা যাবে না। এটি বড় একটি বিবৃতি। এটি বিজ্ঞান। সব দেশই প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেছে, তারা সম্মেলনে এসে তো বিপরীত অবস্থান নিতে পারে না। তাহলে এটি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড হয়ে যায়।

এখানে কোনো কার্যপ্রণালী বিধি নেই। কার্যপ্রণালী বিধি ২৭ বছর ধরে ঝুলন্ত অবস্থায় আছে, চূড়ান্ত করা হয়নি। প্রথম কপেই এটা হওয়ার কথা ছিল। ঐ বিধিতে লেখা ছিল যদি সবাই একমত হতে না পারে তাহলে ভোটাভুটির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে। এখন এটি না হওয়ার কারণে ঐকমত্যের ভিত্তিতে হতে হচ্ছে।

ঐকমত্য মানে প্রতিটি বাক্য, শব্দ, দাঁড়ি, কমার বিষয়ে একমত হওয়া। এটি না হলে কোনো এগ্রিম্যান্ট হবে না।

এখন, একমত হবেন কোন জায়গায়? যেখানে কোনো লক্ষ্য নাই, যেখানে কোনো দেশের জন্য কোনো চ্যালেঞ্জ নাই। যতই এ নীতিতে যাচ্ছি, আমরা সমাধানের পথে যাচ্ছি না। আমরা শুধু প্রক্রিয়াটাকে জিইয়ে রাখছি। কপ থেকে আমাদের যা পাওয়া উচিত ছিল, পাচ্ছি না। দিন দিন আমাদের পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

এই জায়গায় আমাদের অবস্থান হওয়া উচিত, হ্যাঁ, আমরা ঐকমত্য মানলাম যেহেতু কার্যপ্রণালী বিধি বিষয়ে একমত না। কপ সভাপতিকে বলতে হবে ঐকমত্য হতে হবে বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে। আইপিসিসি প্রতিবেদন সবাই গ্রহণ করেছে। ঐকমত্য হতে হবে এ বিজ্ঞানভিত্তিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। এ জায়গাটা নিগোসিয়েশনের কৌশলের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। কার্যপ্রণালী বিধির কথা আমরা বাংলাদেশ থেকে উঠাব।

প্রশ্ন: ১০০ বিলিয়ন ডলার করে প্রতিবছর দেয়ার যে কমিটম্যান্ট আছে,তা রাখছে না তারা। এক্ষেত্রে কোন কৌশলে তা আদায় করা যায়?

সাবের হোসেন: গতবার আমি এলডিসি লিড ছিলাম। অর্থায়নের বিষয়ে আমাদের অবস্থান কী। ১.৫ ডিগ্রির বিষয়ে আমাদের অবস্থান কী। লস এন্ড ড্যামেজ এ কী হবে, তা এলডিসির পক্ষ থেকে অবস্থান তুলে ধরা হবে।

প্রথমে ফাইন্যান্সের কথায় আসলে এর তো কোনো সংজ্ঞাই নেই। উন্নত দেশ বলছে ১০০ বিলিয়নের মধ্যে গতবছর তারা ৮২ বিলিয়ন দিয়েছে। আবার অন্যান্য প্রতিবেদন বলছে এটি ৮-৯ বিলিয়নের বেশি না। ওডিএ কে জলবায়ু অর্থায়ন বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা তো হওয়ার কথা না। এ ১০০ বিলিয়ন ডলার নতুন ও অতিরিক্ত। এ সংজ্ঞা ঠিক করতে না পারলে আলোচনায় অগ্রসর হতে পারব না। দ্বিতীয়ত, ২০২৫ সালে নতুন লক্ষ্য সেট করতে হবে।

শুধু বাংলাদেশেরই ৮-৯ বিলিয়ন ব্যয় হচ্ছে অভিযোজনে। ৭০টি দেশ বড় আকারে অভিযোজনের দিকে যাচ্ছে। এখানেই তো ৭০০ বিলিয়ন ডলার যা ট্রিলিয়নের দিকে যাচ্ছে। সেখানে এখন যা দেয়া হচ্ছে তা তো কিছুই না।

উন্নত দেশ বলছে সরকারি ও বেসরকারি, উভয় খাত থেকে অর্থায়নের কথা। আমরা সেটি বলেছি পাবলিক অর্থায়ন হতে হবে। নয়তো বেসরকারি বা বহুজাতিক আর্থিক সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে দেশগুলো ঋণের জালে আটকে পড়বে।

জলবায়ু অর্থায়নের অর্ধেক প্রশমন আর অর্ধেক অভিযোজনে দেওয়ার কথা। এরও কোনো প্রতিফলন নাই।

প্রশ্ন: লস এন্ড ড্যামেজ ফান্ড গঠন হয়েছে গতবছর। ফান্ড গঠনে সম্মতি দিলেও কানাডা তখনই বলেছে যে চীনকেও এ ফান্ডে অর্থায়ন করতে হবে, যেহেতু চীন বর্তমানে সবচাইতে বেশি কার্বন নিঃসরণ করছে? অন্যদিকে চীন জানিয়ে দিয়েছিল তারা তা করবে না। এই মুখোমুখি এ অবস্থায় এবারের সম্মেলনে কী হতে পারে?

সাবের হোসেন: ফান্ড গঠন হয়ে গেছে। এটা অনেকটা বলা যায় যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। এখন একটি বিষয় আসছে কে ফান্ডটি পরিচালনা করবে। উন্নত দেশগুলো থেকে প্রস্তাবনা আছে বিশ্বব্যাংক পরিচালনা করবে। বিশ্বব্যাংকের বিষয়টি আমরা বিবেচনা করতে পারি তবে পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বব্যাংক আবার কোনো দেশ দ্বারা প্রভাবিত হলে হবে না।

তাহলে কে কত টাকা দিবে এ তহবিলে। সবার দায়িত্ব এক না। সক্ষমতার মধ্যে ভিন্নতা আছে। এ নীতিতেই আসতে হবে। দায়িত্ব সবার কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন।

প্যারিস সম্মেলন সফল হয়েছে কারণ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর চীন এক জায়গায় আসতে পেরেছে। এ তিনটি ব্লক একমত হলে ভালো কিছু হয়। এখানেই ক্লাইমেট ডিপ্লোমেসির জায়গাটা রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আমাদের বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে তাদের এক কাতারে আনা।

জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় আমরা, বাংলাদেশ একেবারে সম্মুখ সারিতে আছি। আজ যা বাংলাদেশে হচ্ছে আগামীতে তা উন্নত দেশগুলোতেও হবে। এক জায়গায় থাকবে না। বাংলাদেশকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে পারি, অভিযোজনে সফল করতে পারি তাহলে অন্য দেশগুলোও সফল হবে। তারা যে সহযোগিতা করবে তা তাদের নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য, এভাবে বিষয়গুলো উপস্থাপন করতে হবে।

তোমরা যখন আমাদের সহায়তা করছো তখন তোমাদের নিজেদের স্বার্থেই সংরক্ষণ করছো। কারণ পৃথিবী একটি গ্লোবাল ভিলেজ। এটি মনে হয় আমরা বুঝাতে পেরেছি। এক্ষেত্রে সাহায্যের মধ্যেও তাদের নিজেদের স্বার্থ রয়েছে।

প্রশ্ন: পার্লামেন্টেরিয়ানস কল ফর ফসিল ফুয়েল ফ্রি ফিউচারের ভূমিকা কপ২৭ দেখতে পেয়েছি। এবার এ সংগঠনের কার্যক্রম কী হবে?

এখনো পৃথিবী ৮০ শতাংশ নির্ভরশীল জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর। এ বিষয়গুলো আমরা নিয়ে আসব। জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, এটি আমাদেরও সুপারিশ ছিল। তিনি বলেছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসতে হবে। এবং আমরা বলছি নতুন কোনো বিনিয়োগ হতে পারবে না। এটি আমাদের জন্য একটি বড় অর্জন।

যুক্তরাষ্ট্রের একজন সিনেটর গতবার এসেছিলেন। আমাদের সাথে সংহতি জানিয়েছেন। এবার কানাডার একজন সিনেটর যোগ হয়েছেন। এটি শুধু গ্লোবাল সাউথই (উন্নয়নশীল দেশগুলো) না আমরা গ্লোবাল নর্থ (উন্নত বিশ্ব) থেকেও সহযোগিতা পাচ্ছি।

আমাদের সংখ্যা ১ হাজারের মতো। সংখ্যার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ডিসকোর্স, ধারণাটাকেও আমরা নতুন একটি রূপ দিতে পারছি।

যদি আমরা কোনো সমস্যা বুঝতে চাই তার মূলে যেতে হবে। এতদিন আমরা লক্ষণ দিয়ে কথা বলেছি। এখন আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে রোগের দিকে। আর রোগটি হলো জীবাশ্ম জ্বালানি আর নিরাময় হচ্ছে এর ব্যবহার বন্ধ করা। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম।

জাতিসংঘের মহাসচিব কপ২৮ এ বলবেন, ২০৩০ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বকে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নতুন আর একটি প্ল্যান্টও না। যদি এটি হয় তাহলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ নিয়ে ভাবতে হবে না।

বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। আমাদের একইভাবে বিবেচনা করলে হবে না। আমাদের হয়তো সময়সীমাটা হবে ২০৪০। কারণ আমাদেরও উন্নয়নের অধিকার আছে। তা আমরা খর্ব করতে চাই না। এ বিষয়গুলো আমাদের সংগঠনের কার্যক্রমের মধ্যে থাকবে এবারের সম্মেলনে।

Link copied!