বাঙালি খাবারে পর্তুগিজ প্রভাব

রায়ান-ই-জান্নাত

আগস্ট ১১, ২০২৩, ০১:৩৩ এএম

বাঙালি খাবারে পর্তুগিজ প্রভাব

সংগৃহীত ছবি

বাঙালি রান্নার অন্যতম অনুষঙ্গ কী? এ প্রশ্নের উত্তরে চোখ বন্ধ করে সবাই হয়তো আলুর কথাই বলবেন। আর বলবেনই না বা কেন এখানে মাছ-মাংস থেকে শুরু করে যেকোনো সবজি কিংবা ভাজি সবকিছুর সাথেই থাকা চাই আলু। 

Portuguese Fried Potatoes (Batatas a Portuguesa) Recipe - Food.com

শুধু অন্য খাবারের সাথেই নয়, শুধু আলু দিয়েও বানানো হয় মুখরোচক ভর্তা ও ভাজি।আমাদের প্রতিদিনের খাবারে তাই আলুর উপস্থিতি থাকেই। তবে অবাক করার ব্যাপার হলো বাঙালির খাদ্য তালিকার এ অবিচ্ছেদ্য অংশটি কয়েকশ বছর আগেও এ অঞ্চলে ছিল না। এ অঞ্চলে আলুর আগমন ঘটে পর্তুগিজদের হাত ধরে। 

শুধু আলুই নয়, আমাদের অনেক পরিচিত খাবারই এ অঞ্চলে এসেছে তাদের মাধ্যমে। শুনে অবাক করা বিষয় মনে হচ্ছে?

২০ মে, সাল ১৪৯৮। এই দিনটিতে ভারতবর্ষের কালিকট বন্দরে পৌঁছান পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামা। আবিষ্কার করেন ভারতবর্ষের সাথে ইউরোপের সরাসরি জলপথ। পর্তুগিজরা ভারতবর্ষে এসেছিল ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। 

এখানকার মশলা ও রেশমের বেশ কদর ছিল ইউরোপে। কিন্তু সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় তাদের এসব কিনতে হতো আরব বণিকদের মাধ্যমে। এ মশলার বাজার ধরতেই পর্তুগিজদের আগমন ঘটে ভারতবর্ষে। 

ধীরে ধীরে তাদের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলায় তাদের আগমন ঘটে ষোল শতকের মাঝামাঝিতে, মাহমুদ শাহের আমলে। সাথে আগমন ঘটে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও রীতিনীতির। তবে অন্য যে কিছুর তুলনায় আমাদের খাবারের পর্তুগিজ প্রভাব পড়ে সবচেয়ে বেশি।

পূর্বেই বলা হয়েছে আলুর কথা। আলুর আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকায়, ইউরোপে এর আগমন ঘটে স্প্যানিশদের মাধ্যমে। সেখান থেকে পর্তুগীজদের হাত ধরে আসে এ অঞ্চলে।

শুধু আলুই নয়, বাঙালি রান্নার আরেকটি অন্যতম অপরিহার্য উপাদান মরিচ। মরিচের আদি নিবাস আবার আমেরিকায়। কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করার পর তা ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তবে এ অঞ্চলের মানুষকে মরিচের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন পর্তুগিজরা। মরিচ আসার আগে এখানে খাবারে ঝালের জন্য ব্যবহার করা হতো গোল মরিচ। মরিচের আগমনের পর এর জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে এত বেড়ে যায় যে, খাবারে ঝালের জন্য অপরিহার্য হয়ে হয়ে ওঠে এটি। 

ধারণা করা হয়, শীতকালীন জনপ্রিয় সবজি ফুলকপি, বাঁধাকপি আর টমেটোও এখানে এসেছে পর্তুগিজদের মাধ্যমে।

এছাড়া আমাদের কিছু অতি পরিচিত কিছু ফলও পর্তুগিজরাই নিয়ে আসেন ভারতবর্ষে। এ ফলগুলোর একটি হলো আনারস, পর্তুগিজরা একে বলে আনানাস। প্রচুর রসের জন্যই বোধ হয় বাংলায় এর নাম হয়ে যায় আনারস। 

Vietnamese Papaya Fruits: Types and Benefits

আনারস ছাড়াও আতা, সফেদা, পেঁপে, কাজু, পেয়ারা, কামরাঙা ইত্যাদি ফল এখানে আসে তাদের হাত ধরে।

আমাদের-সকাল বিকালের নাস্তার অন্যতম দুটি অনুষঙ্গ পাউরুটি আর বিস্কুট। নাস্তার এই অতি পরিচিত আইটেমগুলোও এ অঞ্চলে পরিচিতি পায় পর্তুগিজদের মাধ্যমে।

বাঙালি শুধু পর্তুগিজদের আনা এসব খাবারই আপন করে নেয়নি, সাথে আয়ত্ত করেছে খাবারের সাথে সংশ্লিষ্ট পর্তুগিজদের বিভিন্ন কৌশলও। 

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দুধ কাটিয়ে ছানা ও দই বানানোর কৌশল। এছাড়া তাদের মাধ্যমে মোরব্বা বানানোর কৌশলও রপ্ত করে এখানকার অধিবাসীরা। খাবার সংরক্ষণের বেশ কিছু পদ্ধতিও শিখিয়ে গিয়েছেন তারা।

পর্তুগিজরা মাছ-মাংস রান্নার আগে ভিনিগারসহ নানা রকম মশলা দিয়ে মাখিয়ে রাখত। যাকে আজকাল আমরা মেরিনেশন নামেই জানি। এ মেরিনেশন পদ্ধতিটিও এক সময়ে আত্মস্থ করে নেই আমরা।

পর্তুগিজরা এক সময়ে এ অঞ্চলে এসেছিল বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। এক সময়ে ব্যবসা গুটিয়ে চলেও গিয়েছে, কিন্তু থেকে গিয়েছে তাদের আনা বিভিন্ন সবজি, ফল ও অন্যান্য খাবার আর সাথে তাদের বিভিন্ন কৌশল। ভোজন রসিক বাঙালি এগুলোকে এত আপন করে নিয়েছে যে, এখন এগুলো হয়ে উঠেছে রোজকার খাবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

Link copied!