আয়ান থেকে আয়হান। সুন্নতে খৎনা করতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে দুই শিশুর। তবে এক্ষেত্রে শরীরের প্রয়োজনীয় অংশ অসাড়-অজ্ঞান করতে গিয়েই এমন ঘটনা ঘটার অভিযোগ আসে। দেশে বর্তমানে অ্যানেস্থলজিস্টের সংকট চরমে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে চাহিদার অর্ধেকও নেই, ফলে অনেক সার্জারি করতে রোগীকে একমাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। গড়ে প্রতি দুটি হাসপাতালে একজন করে অ্যানেস্থলজিস্ট কাজ করছে। ক্যারিয়ার ও আর্থিক সুবিধার কথা চিন্তা করে এই পদে বিশেষজ্ঞ হবার প্রবণতাও কম।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট এর মতে, বর্তমানে দেশে ২ হাজার ৪০০ জন অনেস্থলজিস্ট রয়েছে। এর মধ্যে সরকারিতে রয়েছেন প্রায় এক হাজার। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কাঠামোর মধ্যে ৪২৯টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট রয়েছেন ১৪২ জন। এ পর্যায়ের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের পদ খালি ৭০ শতাংশ।‘বাংলাদেশ হেলথ ওয়ার্কফোর্স স্ট্র্যাটেজি ২০২৩’ শীর্ষক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কৌশলপত্রের তথ্য অনুযায়ী, অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ও ল্যাব টেকনিশিয়ানের অভাবে কোনো কোনো সরকারি হাসপাতালে সার্জারি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় একজন সার্জনের বিপরীতে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট আছেন দশমিক ৩৭ জন। আর প্রতি হাসপাতালের বিপরীতে আছেন দশমিক ৪৫ জন। অর্থাৎ প্রতি দুটি হাসপাতালের বিপরীতেও অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট একজনের কম।
দেশে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের সংকট মোকাবেলায় কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই বলে মনে করছেন বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিওলজিস্টসের সভাপতি ডা. দেবব্রত বনিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অ্যানেস্থেসিয়া, অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের এ অধ্যাপক বলেন, অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের বেশির ভাগই কাজ করছেন বেসরকারি হাসপাতালে। সরকারি নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন বেশ জটিল। কোথাও সার্জন আছেন কিন্তু অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট নেই। এক্ষেত্রে ওই সার্জন অস্ত্রোপচার করতে পারছেন না। অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের সংকটের কারণে অস্ত্রোপচারও কম হচ্ছে। সংকট থাকার কারনে দেখা যায় ওটিতে নিয়ে অ্যানেস্থলজিস্টকে ডাকা হয়েছে।
একজন রোগীর অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয় বিশেষজ্ঞ শল্য চিকিৎসকের (সার্জন) তত্ত্বাবধানে। আর শরীরের প্রয়োজনীয় অংশকে অসাড়-অজ্ঞান করার (অ্যানেস্থেসিয়া) মাধ্যমে রোগীকে অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্তুতের কাজটি করে থাকেন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট। এর পাশাপাশি অসাড় অবস্থায় হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর কার্যকারিতা ঠিক রাখা এবং অস্ত্রোপচার-পরবর্তী সময়ে রোগীর জ্ঞান ফেরানো ও ব্যথা প্রশমনের কাজটিও করেন তিনি। জটিল অস্ত্রোপচার সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি সার্জন ও অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট—দুজনের ওপরই নির্ভর করে। এজন্য গোটা বিশ্বেই স্বাস্থ্য খাতে সার্জন ও অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের পর্যাপ্ততার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়।
তবে দেশে এই চিত্র ভিন্ন অ্যানেসথেসিওলজিস্টরা দাবি করেন, তারা বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে বড় আকারে বেতন বৈষম্যের শিকার হন। বেশিরভাগ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলোতে অ্যানেসথেসিওলজিস্টদের অর্থ উপার্জনের জন্য সার্জনদের ওপর নির্ভর করতে হয়। এদিকে কোন সাফল্য আসলে সার্জনদের স্বীকৃতি দেয়া হয়। ফলে এই পদে ক্যারিয়ার গড়তে অনেকেই আগ্রহ হারাচ্ছে। এদিকে সম্প্রতি চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ তাদের অধিকাংশই অ্যানেস্থলজিস্ট।
এমন বিষয় সম্পর্কে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) সাধারণ সম্পাদক ড. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, আমরা তদন্ত কমিশনে অভিযোগগুলো শুনছি। তবে অতীত হিসেব করে দেখা যাচ্ছে এখনও দোষী পাওয়া যায়নি। তবে চলমান বিষয় নিয়ে কথা বলা যাচ্ছে না।
উল্লেখ্য বর্তমানে সহকারী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পর্যায়ে অ্যানেসথেসিওলজিস্টদের জন্য ২১৩টি সরকারি পদ রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১০৭টি পদ বর্তমানে খালি আছে।
সম্মান,স্বীকৃতির পাশাপাশি আর্থিক দিক থেকেও পিছিয়ে থাকায় অ্যানেস্থলজিস্ট হতে অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেনা।স্বাস্থ্য খাতে সার্জন ও অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের অনুপাত কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো আদর্শমান নির্ধারণ করা নেই। এটি নির্ধারণ হয় বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য খাতের প্রয়োজন অনুযায়ী।
যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও স্বাস্থ্য খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) অ্যানেস্থেটিক অ্যান্ড অ্যানালজেসিক ড্রাগ প্রডাক্টস অ্যাডভাইজরি কমিটির (এএডিপিএসি) সাবেক চেয়ার রোনাল্ড লিটম্যানের সুপারিশ অনুযায়ী, স্বাস্থ্য খাতে প্রতিটি অপারেশন থিয়েটারের (ওটি) বিপরীতে অন্তত একজন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট থাকা বাঞ্ছনীয়। আয়ারল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের মতো বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবা খাতের অগ্রসর দেশগুলোয় সার্জন ও অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি।