সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৫, ০৩:৪১ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
ভারতের বিহার রাজ্যের নির্বাচন কর্মকর্তা–কর্মচারীদের এই গ্রীষ্মে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তা ছিল অত্যন্ত কঠিন। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রাজ্যের প্রায় ৮ কোটি যোগ্য ভোটারের পরিচয় যাচাই–বাছাই করতে হবে তাদের।
নির্বাচনী কর্মীদের কাজ বিভিন্ন কারণে আরও জটিল হয়ে উঠেছিল। ওই সময় ছিল রাজ্যে ফসল কাটার সময়, তা ছাড়া তখন রাজ্যে চলছিল প্রবল বন্যা। ভারতের অন্যতম দরিদ্র রাজ্য বিহারের লাখ লাখ মানুষ কাজের সন্ধানে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছিলেন।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ নিয়েও ছিল বিভ্রান্তি। এই পুরো প্রক্রিয়াটি আইনি ও রাজনৈতিক লড়াইয়ের বিষয়ে পরিণত হওয়ায় নির্বাচন কর্মীদের ওপর আরও চাপ তৈরি হয়।
এত সমস্যা থাকার পরও নির্বাচন কমিশন সময়মতো একটি খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করে। ওই তালিকায় রাজ্যের ৬৫ লাখ মানুষের নাম বাদ দেওয়া হয়। কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মৃত এবং বাকিরা অন্য কোথাও চলে গেছেন বা তাদের নাম একাধিকবার তালিকায় ছিল।
কিন্তু নির্বাচন কমিশন মৃত বলে বাদ দেওয়া কিছু মানুষ দিব্যি বেঁচে আছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ভারতের বিরোধী দলগুলো ওই সব ব্যক্তির কয়েকজনকে রাজধানী নয়াদিল্লিতে এনে হাজির করেছিল। তারা এটিকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে বোঝাতে চেয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নির্বাচনকে প্রভাবিত করার কৌশলের অংশ হিসেবেই এই পরিচয় যাচাই–বাছাইয়ের প্রক্রিয়াটি চালাচ্ছে।
কিছু দিন আগে নয়াদিল্লিতে ভারতের কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী মৃত হিসেবে বিহারের ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাওয়া প্রায় অর্ধডজন ভোটারকে ঠাট্টা করে বলেন, ‘আমি তো শুনলাম আপনারা বেঁচে নেই?’
রাহুল গান্ধী এবং অন্যান্য বিরোধী নেতারা তাড়াহুড়া করে চালানো এই যাচাই–বাছাই প্রক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে ভারতের ভোট ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ভারতে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা সংকুচিত হলেও এতদিন পর্যন্ত ভোটব্যবস্থায় অন্তত স্বচ্ছতা ছিল।
১৩ কোটি মানুষের একটি রাজ্য বিহারে গত বছর মোদীর জোটের দুই ডজনের বেশি সদস্য লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর ফলেই প্রধানমন্ত্রী হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের জাতীয় নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হন। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে নির্ধারিত হবে, বিহারে কে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে।
বিরোধী নেতাদের মতে, এত দ্রুত ও ব্যাপকভাবে ভোটার তালিকা সংশোধন করার অর্থ হলো, বিগত দুটি নির্বাচনের কোনোটিই বিশ্বাসযোগ্য নয়। গত নির্বাচন হয় ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকার ওপর ভিত্তি করে হয়েছিল, নতুবা ক্ষমতাসীন দল আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে কিছু ভোটারকে বাদ দিয়ে ফলাফল নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করছে।
বিরোধীরা মোদীর দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে, দলটি মুসলিম ও এমন সব গোষ্ঠীকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করছে, যারা নির্বাচনে তাদের সমর্থন করবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মোদীর দল গত বছরের জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালেও জোটের প্রধান হিসেবে ক্ষমতায় টিকে আছে।
এই প্রক্রিয়ায় বর্তমান ভোটারদের নিজেদের পরিচয় প্রমাণ করার জন্য এমন সব শর্ত দেওয়া হয়েছে, বিশেষজ্ঞরা এটিকে ১৯০০-এর দশকের প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেছেন, যখন সাক্ষরতা পরীক্ষা ও জটিল নথিপত্রের মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হতো।
এই বিতর্ক ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। এটি এখন তীব্র রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ফলস্বরূপ এক দীর্ঘস্থায়ী জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে আলাপকালে নির্বাচনী কর্মী, ভোটার ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পুরো প্রক্রিয়াটি নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত নিয়ম মেনে সম্পন্ন হয়নি। ফলে আরও নির্ভরযোগ্য ভোটার তালিকা তৈরির আশা ম্লান হয়ে গেছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, কীভাবে কমিশন মাত্র কয়েক মাস আগে নিয়মিত তালিকা সংশোধনের সময় ২২ লাখ মৃত মানুষের নাম বাদ দিতে ব্যর্থ হলো।
নির্বাচন কর্মকর্তারা এই প্রক্রিয়া নিয়ে বিরোধীদের তোলা লাখ লাখ অভিযোগ এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের কঠোর সমালোচনার কথা স্বীকার করেছেন। তবে তারা জানিয়েছেন, প্রক্রিয়াটি এগিয়ে চলেছে এবং শিগগিরই শেষ হবে।
মোদির দল বিরোধীদের দাবিকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে নির্বাচনে পরাজিত দলগুলোই ভারতের গণতন্ত্রকে ছোট করার চেষ্টা করছে। তারা এই ভোটার যাচাই–বাছাই প্রক্রিয়াকে দেশব্যাপী ‘অনুপ্রবেশকারী’ খুঁজে বের করার অভিযানের সূচনা হিসেবে বর্ণনা করেছে। এই শব্দটি দিয়ে দৃশ্যত বাংলাদেশি অভিবাসীদের বোঝানো হলেও মোদির দলের সমর্থকেরা প্রায়শই মুসলিমদের বিরুদ্ধে এসব বৈষম্যমূলক শব্দ ব্যবহার করে থাকে।
বিরোধীদের দাবির জবাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বিজেপির নেতা অনুরাগ ঠাকুর ভোটের অনিয়ম নিয়ে উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দেন। তিনি দাবি করেন, ভারতের কয়েকটি বিরোধীশাসিত রাজ্যের মধ্যে অন্যতম পশ্চিমবঙ্গে ‘ব্যাপক হারে’ অতিরিক্ত ভোটারের নাম তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে। বিরোধী নেতারা যেসব অঞ্চলে জিতেছেন, সেখানে হাজার হাজার সন্দেহজনক ও ভুয়া ভোটার রয়েছে।
অনুরাগ ঠাকুর বলেন, বিরোধীরা তাদের অনুপ্রবেশকারীদের ভোটব্যাংক বাঁচাতে চায়।
রাহুল গান্ধী বলেছেন, বেশ কয়েকটি নির্বাচনে তার জোটের শরিকরা ফলাফল দেখে হতবাক হয়েছেন। কারণ, জনমত জরিপে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পূর্বাভাস থাকলেও তারা বিপুল ভোটে হেরে গেছেন। তারা মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের সাম্প্রতিক নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ সংগ্রহ করা শুরু করেছেন। তারা নিজেরাই প্রমাণ সংগ্রহ করছেন। কারণ, নির্বাচন কমিশন তাঁদের সঙ্গে তথ্য ভাগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার বিরোধীদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, বিরোধী নেতাদের হয় শপথ নিয়ে অভিযোগ করতে হবে, নতুবা ক্ষমা চাইতে হবে। তবে তিনি অনুরাগ ঠাকুরের করা নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রশ্ন তুলে বলেন, নির্বাচন কমিশন কি কারও মা, বোন বা পুত্রবধূর সিসিটিভি ভিডিও শেয়ার করবে?
কোন ধরনের নথিপত্র পরিচয়পত্র হিসেবে গণ্য হবে—সেই প্রশ্নটি বিহারের এই সন্দেহ–উদ্বেগের মূলে রয়েছে।
নির্বাচন কমিশন রাজ্যের সব ভোটারকে একটি ফর্ম পূরণ করে এবং তালিকাভুক্ত ১১টি নথির মধ্যে যেকোনো একটি জমা দিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রমাণ করতে বলেছিল। কিন্তু এই তালিকায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পরিচয়পত্রগুলোই বাদ দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া ভোটার আইডি কার্ড এবং আধার কার্ডও ছিল।
অথচ গত দশকে মোদি সরকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে শুরু করে মোবাইল সিম কেনা পর্যন্ত—সবকিছুর জন্য আধার কার্ডকে অপরিহার্য করে তুলেছে।
আরও বিভ্রান্তিকর বিষয় হলো—অনুমোদিত ১১টি নথির মধ্যে অনেকগুলোই আধার কার্ডের ভিত্তিতে তৈরি হয়।
বিহারের একটি নাগরিক সমাজ গোষ্ঠী ‘দলিত বিকাশ অভিযান সমিতি’–এর নির্বাহী পরিচালক ধর্মেন্দ্র কুমার সরকারের প্রতি প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘আপনারা সবকিছুর জন্য আধারকে জরুরি করেছেন; মানুষকে লাইনে দাঁড় করিয়ে আধার কার্ড করিয়েছেন। তাহলে এখন কেন এটি ব্যবহার করা হচ্ছে না?’
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচন কমিশনকে আধারকে বৈধ পরিচয়পত্র হিসেবে যুক্ত করতে নির্দেশনা দিলেও কমিশন বারবার গড়িমসি করেছে এবং নথি জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ার পর এটি মানতে রাজি হয়েছে।
তবে বিহারের মাঠপর্যায়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক স্থানীয় নির্বাচন কর্মী বলেছেন, প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই তাদের আধার কার্ডকে পরিচয়পত্র হিসেবে গ্রহণ করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কারণ, এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, বহু মানুষের কাছে তালিকাভুক্ত অন্য কোনো নথি ছিল না।
এই কাজ শেষ করতে না পারলে বরখাস্ত হওয়া বা বেতন কেটে নেওয়ার হুমকির মুখে পড়ে কিছু নির্বাচন কর্মী অনুমানের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হন। যেমন—কর্মীরা পারিবারিক বৃক্ষ তৈরি করে সেটির ছবিকে পরিচয়পত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তারা ধরে নিয়েছেন, যদি কারও বাবা বা মা আগের ভোটার তালিকায় থাকেন, তাহলে তাদের সন্তানেরাও ভোট দেওয়ার যোগ্য।
সমালোচকরা বলছেন, এই যাচাই–বাছাইয়ে ভোটারদের জন্য ছিল চরম বিভ্রান্তি এবং কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে ছিল স্বচ্ছতার অভাব—যা একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা তৈরির আশাকে নষ্ট করে দিয়েছে।
নির্বাচন কমিশন বলেছে, আগস্টের শেষ নাগাদ এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী ৭ কোটি ২০ লাখ ভোটারের ৯৮ শতাংশ তাদের নথি জমা দিয়েছেন। তবে, যাচাই–বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোন কোন পরিচয়পত্র গ্রহণ করা হয়েছে, সে সম্পর্কিত তথ্যের বিষয়ে ই–মেইলে করা প্রশ্নের কোনো উত্তর কমিশনের কর্মকর্তারা দেননি।
বিহারের বিরোধী নেতা তেজস্বী যাদব অভিযোগ করেছেন, সংশোধিত খসড়া তালিকার ওপর ভিত্তি করে কেবল নির্বাচন কর্মীদের অনুমান অনুযায়ী প্রতিটি বিধানসভা আসনে ২৫ থেকে ৩০ হাজার ভোটারের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। নিরপেক্ষ মূল্যায়ন থেকে দেখা গেছে, রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ আসনে গত নির্বাচনের জয়ের ব্যবধানের চেয়েও গড়ে বেশিসংখ্যক নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।
তেজস্বী যাদব বলেন, ‘আপনি কল্পনা করতে পারেন, জয়ের ব্যবধান খুবই কম ছিল।’
সুপ্রিম কোর্ট কমিশনকে অভিযোগের নিষ্পত্তি চালিয়ে যেতে বলেছে এবং নভেম্বরে প্রত্যাশিত বিধানসভা ভোটের আগে শুনানি প্রক্রিয়া চলতে থাকবে। তবে যাঁরা কাজের জন্য রাজ্যের বাইরে থাকেন বা যাঁদের ডিজিটাল জ্ঞান কম বা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ নেই, তাঁদের জন্য অভিযোগ দায়ের করা সহজ নয়।
পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার বলেন, কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই তার স্ত্রীর নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তিনি একজন নির্বাচন কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। আশা করছেন, তিনি এই ভুল ঠিক করতে পারবেন। কিন্তু তিনি অন্যদের নিয়ে চিন্তিত।
অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার বলেন, ‘কেবল অগ্রসর শ্রেণির শ্রেণির মানুষই এসব ভুল সংশোধন করতে পারবেন।