সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৫, ০৪:৫৪ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানানো হয়, ৩৩ বছর পর আয়োজিত জাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরাট আগ্রহ সৃষ্টি করলেও বাস্তবে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ছিলো ত্রুটিপূর্ণ ও বিতর্কিত। নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই অব্যবস্থাপনা, পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত, জনবল ঘাটতি ও স্বচ্ছতার ঘাটতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে বলে তারা মন্তব্য করেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, নির্বাচন প্রক্রিয়ার পুরো ঘটনাপ্রবাহ থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে একটি নির্দিষ্ট পক্ষকে বিজয়ী করার লক্ষ্যেই নির্বাচন পরিচালিত হয়েছে। এতে শিক্ষার্থী, প্রার্থী, শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের আস্থা নষ্ট হয়েছে।
বিবৃতিতে শিক্ষক নেটওয়ার্ক ধারাবাহিকভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়ার ১৬টি গুরুতর অনিয়ম তুলে ধরে। এর মধ্যে ছিল— ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকা ও ব্যালট পেপার, ভিপি প্রার্থী অমর্ত্য রায়ের প্রার্থিতা বাতিল, ব্যালট বাক্স রাতেই হলে হলে পাঠানো, পোলিং এজেন্ট নিয়োগে জটিলতা, বৈধ শিক্ষার্থীর ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া, অতিরিক্ত ব্যালট সরবরাহ, কারচুপির সুযোগ সৃষ্টি করা, অমোচনীয় কালির দাগ উঠে যাওয়া, ভোট গণনায় অনিয়ম ও ধীরগতি, প্রার্থীদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বাধা, সাংবাদিকদের প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা এবং ভোট প্রদানের সময়সীমা শেষ হওয়ার পরও ভোট গ্রহণ চলতে থাকা।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা ১৬টি অনিয়ম হলো-
১. ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকা এবং ক্রুটিপূর্ণ ব্যালট।
২. একজন ভিপি প্রার্থী অমর্ত্য রায়কে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর, নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে অনিয়মিত ছাত্র হিসেবে দেখিয়ে নির্বাচনের ৪ দিন আগে তার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়। অমর্ত্যের বিরুদ্ধে এই সিদ্ধান্ত উচ্চতর আদালত স্থগিত করলেও চেম্বার আদালতে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যালট পেপার ছাপা হয়ে যাওয়ার যুক্তিতে, সেপ্টেম্বর ৯ তারিখে উচ্চতর আদালতের সিদ্ধান্তটিকে স্থগিত করে দেওয়া হয়। প্রশাসন উচ্চতর আদালতের রায় মেনে নিয়ে অমর্ত্যের প্রার্থিতা ফিরিয়ে দিতে পারত, কিন্তু তারা সেটা করেনি।
৩. গত ৯ সেপ্টেম্বর প্রার্থীদের ডোপ টেস্টের দিন ধার্য করা হয়। ব্যালট পেপার ছাপানো হয়ে যাওয়ার পর ডোপ টেস্টের প্রাসঙ্গিকতা জানতে চাইলে বলা হয় ব্যালট পেপার ছাপানো হয়নি।
৪. নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স হলে হলে পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে। অথচ এই ক্যাম্পাসে ব্যালট বাক্স নির্বাচনের দিন সকালে পাঠানোতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
৫. নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট রাখতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া নেয়। পরে শেষ মুহূর্তে নির্বাচনের আগের রাত ২.৩০ মিনিটে পোলিং এজেন্ট রাখা যাবে বলে ঘোষণা দেয়, যা প্রার্থীদের মধ্যে বড় ধরনের বৈষম্যের সৃষ্টি করে। পাশাপাশি পোলিং এজেন্টদের পরিচয়পত্র দিতে গড়িমসি করা এবং সকালে কয়েক ঘন্টা ধরে ভোট চললেও কোনো কোনো প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট না থাকা, নির্বাচনের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
৬. ভোট কেন্দ্রে প্রার্থীদের ঢুকতে বাধা দেওয়া। এছাড়া ছাত্রীদের হল পরিদর্শনে প্রার্থী ও সাংবাদিকদের বাধা দেওয়া।
৭. নির্ধারিত ভোটারের চাইতে অতিরিক্ত ব্যালট পেপার সরবরাহ করার ঘটনা বড় রকমের সংশয় তৈরি করে। কোনো কোনো হলে মাটিতে ব্যালট পেপার পড়ে থাকতে দেখা যায়।
৮. অমোচনীয় কালির দাগ উঠে যাওয়ার ঘটনাও ভোট কারচুপির সুযোগ সৃষ্টি করে।
৯. ভোটার তালিকায় নাম না থাকায়, বৈধ শিক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও অনেকে ভোট দিতে পারেনি। জাল ভোটের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
১০. কোনো কোনো হলের একাধিক প্রার্থীর নাম ছাপা না হওয়া বা কয়জন সদস্যকে ভোট দিতে হবে সেই নির্দেশনায় ভুল অংক লেখা থাকা।
১১. নির্ধারিত সময়ে সকল হলে ভোট প্রদান শেষ না হওয়া। নির্ধারিত সময়ের আড়াই ঘণ্টা পরেও ভোট গ্রহণ চলতে থাকা।
১২.ওএমআর পদ্ধতিতে ভোট গণনায় প্রশ্ন উঠায়, হাতে ভোট গণনার সিদ্ধান্তের পর বাস্তব পদ্ধতি অনুসরণ না করা। এতে ধীর গতিতে ভোট গণনা চলে এবং ৪৮ ঘণ্টা পর নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এত দীর্ঘ সময় ব্যালট বাক্সগুলো নিশ্ছিদ্র থাকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
১৩. নির্বাচনে নানান দায়িত্বে থাকা ৩ জন সহকর্মী নির্বাচনের অতিরিক্ত ব্যালট পেপার সরবরাহ ও অমোচনীয় কালির দাগ উঠে যাওয়ার অভিযোগ তুলে দায়িত্ব থেকে সরে যান।
১৪. একইভাবে নির্বাচনের দিন দুপুরের পর এইসব অভিযোগ তুলে অংশগ্রহণকারী ৮টি প্যানেলের মধ্যে ৫টি প্যানেল এই নির্বাচন বর্জন করে।
১৫. ক্যাম্পাসে সকল খাবার দোকান ও চা এর দোকান বন্ধ রেখে ক্যাম্পাসের উৎসবমুখর পরিবেশকে দমবদ্ধ দশায় পরিণত করা হয়। অন্যদিকে নির্বাচনের দিন দুপুরের পর থেকে জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গেইটে জড়ো হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষার্থী, নির্বাচন কমিশন তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বাসিন্দার ওপর মানসিক চাপ প্রয়োগ করতে দেখা যায়।
১৬. সর্বশেষ ৫ জনের নির্বাচন কমিশনারের মধ্যে ২ জন নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে পদত্যাগ করেন। এসব কিছু সত্ত্বেও ৩ জন কমিশনারের স্বাক্ষরে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়।
ওএমআর যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করে হাতে ভোট গণনার সিদ্ধান্তকেও প্রশাসনের ব্যর্থতা আখ্যা দেয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। তারা বলেন, বিপুল অর্থ ব্যয় করেও প্রযুক্তি ব্যবহার করতে না পারা লজ্জাজনক। এতে একদিকে নির্বাচনের ফলাফল বিলম্বিত হয়েছে, অন্যদিকে ফলাফলকে ঘিরে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।