"আদিবাসীদের যৌক্তিক দাবিগুলো পূরণ করতে হবে"

বাসস

জুলাই ২৯, ২০২৫, ০৮:১১ পিএম

রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা। ফাইল ছবি

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারী শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত সাহসী ও যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছেন। তারা সম্মুখ সারিতে ছিলেন বলেই এ আন্দোলন সহজে দমন করা যায়নি। জুলাই জাগরণে নারী শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা। আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে তিনি নানা ধরনের হেনস্তা, হামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন।

রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যার গ্রামের বাড়ি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলায়। তিনি পরিবারের সঙ্গে ঢাকার মোহাম্মদপুরে থাকেন। তার বাবা শাক্য মিত্র তঞ্চঙ্গ্যা একজন ব্যবসায়ী। মায়ের নাম ফাহমিদা রুবাইয়া রুমা। পরিবারের বড় সন্তান শ্রেষ্ঠা। তার এক ছোট ভাই রয়েছে, যিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন।

খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি শেষে তিনি রাজধানীর হলি ক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হন। তিনি রোকেয়া হলের অনাবাসিক শিক্ষার্থী। চলতি বছর তিনি স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। দেশের বাইরে থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের ইচ্ছা রয়েছে তার।

শ্রেষ্ঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ছিলেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের যুগ্ম আহ্বায়ক পদে রয়েছেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তার অংশগ্রহণ ও অভিজ্ঞতার নানা দিক তুলে ধরেন। তার এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. রাসেল সরকার।

বাসস: কোটা সংস্কার আন্দোলনে কখন, কোন প্রেক্ষাপটে অংশগ্রহণ করেছিলেন?

রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা: কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমি একদম শুরুর দিকে ছিলাম না। তবে আন্দোলনে আমার সমর্থন ছিল। যেহেতু এটা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন, সেখানে আদিবাসী শিক্ষার্থী হিসেবেও আমার যৌক্তিক সমর্থন ছিল। কেননা কোটা নিয়ে একটা প্রহসন চলছিল। ২০১৮ সালের আন্দোলনের পর কোটা পুরোপুরি বাতিল করে দেওয়া হয় এবং ২০২৪ সালে এসে আবার পুনর্বহাল করা হয়। তখন শিক্ষার্থীরা প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী  ও আদিবাসীসহ যৌক্তিক ক্ষেত্রে কোটা চালু রেখে পুরো কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। 

বৈষম্যমূলক কোটার বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ব্যাপকহারে আন্দোলনে অংশ নিতে শুরু করলে ১২ জুলাই থেকে আমি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে, সে সময় সানজিদা আহমেদ তন্বিসহ আমার বেশ কয়েকজন ফ্রেন্ড আহত হয়। আমরা আমাদের ক্যাম্পাসকে নিরাপদ মনে করতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো আমাদের সেকেন্ড হোম। কিন্তু সেদিন আমরা নিজ ক্যাম্পাসে হামলার শিকার হই। এটা আমরা মেনে নিতে পারিনি। এরপর থেকে আন্দোলনে আরো সক্রিয় হই।

বাসস: আপনি রোকেয়া হলের অনাবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন।  কোথায় থেকে কীভাবে আন্দোলনে অংশ নিতেন?

রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা: আমি মোহাম্মদপুর থেকে ক্যাম্পাসে গিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতাম। ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা আমাদের ক্যাম্পাসে, শাহবাগ মোড়ে, সায়েন্সল্যাব মোড়ে আন্দোলনে অংশ নিত। আমি স্কুল-কলেজের অনেক মেয়ে শিক্ষার্থীকে পেয়েছিলাম, যারা অত্যন্ত সাহস নিয়ে আন্দোলনে অংশ নেয়। আমি তাদেরকে সংগঠিত রাখতে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ করি। ১৫ জুলাই ছাত্রলীগের হামলার পর বিশ্ববিদ্যালয় ও হল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। মেয়েরা হল ফাঁকা করে বাসায় চলে যাচ্ছিল। তখন আমার মনে হয়েছে, এ সময় আন্দোলনে আমার সক্রিয় থাকা উচিত। মেয়েরা সামনে না থাকলে ম্যাসেজটা এরকম হতো যে, আমরা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছি। তাছাড়া মেয়েরা আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে থাকায় ছাত্রলীগ সহজে আন্দোলন দমন করতে পারেনি। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে তখন সবার পরিবারের মধ্যে ভয় ও দুশ্চিন্তা কাজ করত। ফলে হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হয়েছে। তখন আমি আন্দোলনে আরও বেশি সক্রিয় হই। কারণ আমি হলে থাকি না।

বাসস: ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে, তখন আপনি কোথায় ছিলেন?

রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা: ১৫ জুলাই আমি ক্যাম্পাসেই ছিলাম। আমি একটা কাজে নিউমার্কেট গিয়েছিলাম। নীলক্ষেত দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে দেখি শিক্ষার্থীরা দিগ্বিদিক দৌড়াচ্ছে। তখন আমি শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের গেইটের ভেতরে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। পরে আমাকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেওয়া হলো না। ছাত্রলীগ পুরো ক্যাম্পাসে মহড়া দিয়ে পরিস্থিতি নিজেদের কন্ট্রোলে রাখার চেষ্টা করছিল। তখন আমি বাসায় চলে আসি।

বাসস: আপনি হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন না। বাসা থেকে ক্যাম্পাসে গিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল?

রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা: আন্দোলনের সময় মোহাম্মদপুর থেকে ক্যাম্পাসে যেতে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। আমাদের ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা মূলত রাজু ভাস্কর্য, শহীদ মিনার ও শাহবাগে মোড়ে আন্দোলন করত। ওই সময় ঢাকা কলেজ ও অন্যান্য কলেজের শিক্ষার্থীরা সায়েন্সল্যাব ব্লক করে আন্দোলন করত। এ সময় এই রাস্তা দিয়ে বাসে করে ক্যাম্পাসে যেতে পারতাম না। শেষদিকের অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ। কারফিউ চলছিল এবং রাস্তায় অস্ত্র নিয়ে ছাত্রলীগ অবস্থান করছিল।  সবার পরিবারের  মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করত।  কিন্তু ওই সময় আমার বাবা-মা চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে ছিলেন। যার কারণে আন্দোলনে যেতে আমি তেমন বাধা পাইনি। তখন আমি পরিবারকেও তেমন কিছু জানাইনি। ওই সময় আমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, একা একা ক্যাম্পাসে যাওয়া। ঢাকা কলেজের সামনে তখন অনেক গন্ডগোল হতো। আমি দুবার সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। কয়েকবার ইট এসে গায়ে লেগেছিল।

বাসস: ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। পরে আন্দোলন দমনে কারফিউ জারি করা হয়। ওই সময় আপনি কীভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন?

রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা: প্রথম যেদিন কারফিউ দেওয়া হয়, সেদিন আমি সায়েন্সল্যাবে আন্দোলনে অংশ নিই। সেদিন আমাদের সামনে পুলিশ সরাসরি ফায়ার করে। বেশ কয়েকজনের চোখে, মুখে ও মাথায় গুলি লাগে। আমার সঙ্গে আরও তিনজন মেয়ে আন্দোলনে অংশ নিত। একজনের নাম সামিয়া। সে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তখন আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি, পুলিশ এভাবে গুলি ছুড়বে। আমরা দেখলাম, শিক্ষার্থীদের চোখ থেকে রক্ত পড়ছে। এটা খুবই ভয়ংকর একটা দৃশ্য ছিল। এর দুদিন আগে রংপুরে আবু সাঈদ ভাইকে গুলি করে মারা হয়। আমি মনে করেছিলাম, সরকার আর কোনো শিক্ষার্থীরা ওপর গুলি চালাবে না। কিন্তু তারা ব্যাক ফায়ার করল। 

এরপর থেকে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীদের রাস্তায় দেখলেই পুলিশ ও ছাত্রলীগ জেরা করত। নিজেদের প্রতিরক্ষায় আমরা লাঠি ও মরিচের গুঁড়ো নিয়ে আন্দোলনে যেতাম। আমাদের ওপর অ্যাটাক হলে যাতে মরিচের গুঁড়ো ছিটাতে পারি।

বাসস: ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শাটডাউনের পর কীভাবে আন্দোলনের তথ্য পেতেন এবং কীভাবে আন্দোলনে অংশ নিতেন?

রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা: ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার আগে আমরা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আন্দোলনে তথ্য ও নির্দেশনা শেয়ার করতাম। এ গ্রুপে আন্দোলনের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা আন্দোলনে অংশ নিতাম। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরঙ্গ বাসে যাতায়াতকারী শিক্ষার্থীদের গ্রুপ ছিল। আমার সেখানে ম্যাসেজ দিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতাম। কিন্তু নেট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। তখন আমি অফলাইনে ফোন দিয়ে মেয়েদের সংগঠিত করতাম। যাদের নাম্বার ছিল, তাদের কাছে ফোন দিতাম। তখন বাসা থেকে বের হওয়া কঠিন ছিল। মোহাম্মপুরে বাসা থেকে টিয়ারগ্যাসের গন্ধ পেতাম। ওই সময় শুনতে পাই, আমাদের পাশের ভবনের এক ছেলেকে গুলি করে মারা হয়েছে। ইন্টারনেট যখন ধীরে ধীরে সচল হতে শুরু করে তখন আমরা আবার পুরোদমে আন্দোলনে যেতে শুরু করলাম। যেদিন হাইকোর্টের সামনে আসিফ নজরুল স্যারসহ আরো অনেক শিক্ষক জড়ো হলেন, সেদিন আমি আমার মাকে নিয়ে সেখানে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। ইন্টারনেট বন্ধ ও কারফিউ চলাকালে বাবা মা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে চিকিৎসা শেষ না করেই দেশে চলে আসেন। বাবা ব্যবসার কাজে রাঙামাটি চলে যান। মা আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছেন। আমার ছোট ভাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে  গণিত বিভাগে পড়ে। ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে বাসায় চলে আসে। কিন্তু বাসা থেকে সে মোহাম্মদপুর, ঝিগাতলা ও সায়েন্সল্যাবে আন্দোলনে অংশ নিত। ইন্টারনেট চালু হওয়ার পর আমরা হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ বাড়াতে থাকলাম। আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ৫৬ জন থেকে প্রায় ৩০০ জনের মতো মেম্বার হলো। এই গ্রুপটা মূলত মেয়েদের ছিল। এখানে বেশির ভাগই মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া বা আশেপাশে এলাকার নারী শিক্ষার্থীরা ছিল। ওই সময় আমরা কেউ কাউকে চিনতাম না, কিন্তু আন্দোলনের কারণে আমরা কানেক্টেড ছিলাম।

বাসস: আন্দোলনের কোন স্মৃতি বা কোন ঘটনা আপনার খুব বেশি মনে পড়ে? যে স্মৃতি আপনাকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।

রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা: ৪ আগস্ট আমি সবচেয়ে বাজে সিচুয়েশনে পড়েছিলাম। সেদিন শহীদ মিনারে সরকার পতনের এক দফা দাবি ঘোষণার দিন ছিল। আমরা ঠিক বেলা ১১টার দিকে শহীদ মিনারে চলে যাই। আমাদেরকে বলা হয়, শাহবাগ থানায় একটা হামলা হতে পারে। এটা হলে শাহবাগ থানা পুলিশ অঝোরে গুলি ছুড়বে। এটা শোনার পর বিশৃঙ্খলা এড়াতে আমরা শাহবাগ থানার সামনে অবস্থান নিই। ওই সময় অনেকে থানায় ইট নিক্ষেপ করেছিল। আমাদের গায়েও ইট লেগেছে। সেদিন থানায় হামলা হলে পুলিশ অঝোরে গুলি ছুড়ত। পরে এক দফা ঘোষণার পর আমরা রাস্তায় গ্রাফিতি আঁকি। আমাদের অনেক মেয়ে শিক্ষার্থী এতে অংশ নেয়। সেদিন সন্ধ্যা ৬টায় কারফিউ শুরু হওয়ার কথা ছিল। এরই মধ্যে বাংলামোটরে গোলাগুলি শুরু হয়। আমার সঙ্গে সেদিন ৭ জন মেয়ে ছিল। তাদেরকে আমি মোহাম্মদপুর থেকে আন্দোলনে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি তাদের নিয়ে মোহাম্মদপুর যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু শুনি ঝিগাতলায় ইয়েলো শপিংয়ে আগুন লাগানো হয়েছে, সেখানে গন্ডগোল হচ্ছে। তখন আমরা কাঁটাবন, হাতিরপুল হয়ে ভূতের গলি দিয়ে হেঁটে মিরপুর রোডে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।  গ্রিনরোডে আমরা দেখলাম, অনেক মানুষ আহত, অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমরা কোনোরকমে ৭টার দিকে মোহাম্মদপুর পৌঁছাই।

মোহাম্মদপুর আসার পথে শুনি, বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে আমার ভাইয়ের কোনো খোঁজ-খবর নাই। আমাকে মা বিকেলে অনেকবার কল দিয়েছিলেন। কিন্তু ফোন সাইলেন্ট থাকায় ধরতে পারিনি। পরে ফোন ব্যাক করলে শুনি, আমার ভাইকে ঝিগাতলা থেকে আসার পথে তুলে নিয়ে গেছে। মাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনার ছেলে কোন দল করে? মা তাদের পরিচয় জানতে চাইলে, তারা বলল আমরা থানা থেকে ফোন দিয়েছি। কিন্তু কোন থানার লোক সেটা না বলেই ফোন কেটে দেয়।  মা অস্থির হয়ে যান। আমার সাথে তখনও আমার সহযোদ্ধা ২ জন মেয়ে ছিল, তাদের নিয়েই আমি মোহাম্মদপুর থানায় যাই। কিন্তু আমাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরে পুলিশ বলল- আজকে আমরা কোনো ছেলেকে আটক করিনি। আমি বললাম- কাউন্সিলরের কোনো লোক আমার ভাইকে তুলে নিয়ে গেছে শুনেছি। তখন তারা আমাকে তেজগাঁও থানায় যেতে বললেন। আমরা তেজগাঁও থানায় যাচ্ছিলাম, তখন দেখতে পেলাম অন্তত ৫০-৬০ জন ছেলে রাম দা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। অপরদিকে আসাদ গেইটের রোডে বিজিবি-পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ আমাকে চার্জ করতে শুরু করল। পরে পুলিশ আমাকে বাসায় চলে যেতে বলে। তখন আমরা শিয়া মসজিদ যাওয়ার পথে একটা মার্কেটের শাটারের নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখন আমার মা শিয়া মসজিদের দিক থেকে বাস স্ট্যান্ডের দিকে আসছিলেন মূলত আমাদের সাথে থানায় যাবার উদ্দেশ্যে । এমন সময় রাম দা হাতে নিয়ে ছাত্রলীগের ছেলেরা আমার মায়ের কাছ থেকে ফোন কেঁড়ে নিতে চাচ্ছিল। আমি এগিয়ে গেলাম। তখনি আমি এক ফাঁকে আমাদের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র রাফিজ ভাইকে ঘটনাটা জানায় তখন তারা আমার ফোনও কেড়ে নিয়ে বাজেভাবে গালাগালি করল। সেটার প্রতিবাদ করলে আমাকে ও আমার মাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তখন আমার সাথে থাকা দুইজন মেয়ে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। কিন্তু ছাত্রলীগের ছেলেরা রাম দা নিয়ে আমাদেরকে ঘিরে ধরে। তখন তারা আমাকে চড়-থাপ্পড় মারে, আমার চশমা ভেঙে যায়। আমার ওড়না, চুল ধরে টান দেয়। সেদিন খুব বাজেভাবে আমাদের হেনস্তা করেছিল ওরা।

বিষয়টা আমি আমাদের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র রাফিজ খান ভাইকে জানাই। তখন ওনার মাধ্যমে ডিপার্টমেন্টের অনেকেই ঘটনাটা জানতে পারে। পরে  শিক্ষক নেটওয়ার্ক থেকে একজন শিক্ষক মোহাম্মদপুরে আসেন। ওনি আমাদের নিরাপত্তা দিয়ে তেজগাঁও থানার নিয়ে যেতে চাইলেন।  যখন আমরা তেজগাঁও থানার দিকে যাচ্ছিলাম, বাসার গার্ড ফোন দিয়ে জানান- আমার ভাইকে দুজন লোক এসে গেইটে দিয়ে গেছে। তার হাত পা রক্তাক্ত, মাথায় আঘাতের চিহ্ন। তার গায়ের জামা প্যান্ট সব ছেড়া। ছেড়া জামা কাপড়ে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। পরে জানতে পারলাম, কাউন্সিলর আসিফের লোকজন তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করেছে। এরা  আমার ভাইকে রাস্তায় টানা-হেঁচড়া করে কাউন্সিলের অফিসের পাশে গ্যারেজে নিয়ে নির্যাতন করেছে। সেখানে আরো অনেককে নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে রাতে যখন পরিস্থিতি ভালো দেখছিল না, তখন তাদের একজন আমার ভাইকে বের করে দেয়। তখন তারা মনে হয় বুঝেছিল, সরকার আর টিকবে না। তারা অস্থিরভাবে ছোটাছুটি করছিল। এরই মধ্যে একজন আমার ভাইকে বের করে দেয়। পরে হাঁটতে না পেরে রাস্তায় সে পড়ে থাকলে, দুজন লোক তাকে ধরাধরি করে বাসায় পৌঁছে দেন। আমার ভাই জানায়, তাকে ১৫-১৬ জন নির্যাতন করেছে। শুধু তাকে না, আরো অনেককে নির্যাতন করেছে। একটা ছেলেকে ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। আমার ভাইকে নির্যাতনের ঘটনায় ৫ আগস্টের পর থানার কাজ সচল হওয়ার পর আমরা কাউন্সিলর আসিফের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করি। সেই মামলা আমাদের এখনো ডিল করতে হচ্ছে। এই স্মৃতিগুলো খুবই ভয়ংকর। সেদিন কী ভয়াবহ হেনস্তার শিকার হয়েছিলাম!

বাসস: এসব নৃশংস ঘটনা মানসিকভাবে কীভাবে সামলেছিলেন?

রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা: এ ঘটনার পর অনেকদিন ট্রমার মধ্যে ছিলাম। গণঅভ্যুত্থানের পর এ সকল ঘটনা বার বার চোখে ভাসত। আমাদের বাসার সামনে কালো ধোঁয়া, গুলির আওয়াজ কানে বাজতো। ৫ আগস্টের পর মোহাম্মদপুরে আবার যখন সন্ত্রাসী হামলা ও ডাকাতি শুরু হয়, তখন আসলে অস্থিরতায় দিন কেটেছিল।  রাতে ঘুমাতে পারতাম না। এভাবে মানসিকভাবে হয়রানির মধ্যে ছিলাম।

বাসস: কোটা সংস্কার ইস্যুতে পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের অবস্থান কী ছিল? আন্দোলনে তারা কেমন ভূমিকা রেখেছেন?

রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা: কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সমন্বয়করা বলেছেন, আমরা সব কোটা বাতিল চাই না। আমরা কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার চাই। আন্দোলনের সময় নাহিদ ভাইসহ আরো অনেকে আমাদের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা আমাদের আন্দোলনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। তারা আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলিক মৃ দাদার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন। আমি এবং আমার পরিচিত আদিবাসী শিক্ষার্থীরা সংগঠিত হয়ে আন্দোলনে অংশ নিই। হল বন্ধ হয়ে গেলে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা অনেকে বাড়ি চলে যায়। তবে আমরা যারা ঢাকায় ছিলাম সবার সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিয়েছি। আমাদের একজন আদিবাসী শিক্ষার্থী গুলিবিব্ধ হয়েছিল। আসলে এ আন্দোলন এক পর্যায়ে আর কোটার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।

বাসস: কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনের দিকে যাচ্ছে, বিষয়টা কখন বুঝতে পারেন?

রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা: মূলত আবু সাঈদ ভাইকে হত্যার পর থেকে এই আন্দোলন আর কোটা সংস্কার আন্দোলনে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটা সম্পূর্ণ সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। আবু সাঈদ ভাইকে গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যার কয়েকদিন পর  প্রথম আলোর শেষ পাতায় একটা খবর ছাপা হয়। নিউজটা সম্ভবত ২৪ বা ২৫ তারিখে প্রকাশ করা হয়েছে। রিপোর্টটা ছিল এরকম, ‘আবু সাঈদ প্রথমে পুলিশের ওপর আক্রমণ করে, পরে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি করেছে।’ এটা আমরা মেনে নিতে পারিনি। তখন আমি রিয়েলাইজ করলাম, এই সরকারের অধীনে শিক্ষার্থী হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে না। কারণ তারা প্রকাশ্যে আবু সাঈদকে গুলি করার পরও এটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এত মিথ্যাচার দেখার পর এই সরকারের প্রতি আর আস্থা থাকে না। এই বিষয়টা সরকারের পতন অনিবার্য করেছে। যারা শেখ হাসিনাকে পছন্দ করত, তারাও তার বিপক্ষে চলে যায়। তার পক্ষে ছিল কিছু ক্ষমতালোভী মানুষ। আসলে শেখ হাসিনার আমলে মানুষ নিরাপদ ছিল না। তাই অনেক বাবা মা তাদের সন্তানদের নিয়ে আন্দোলনে অংশ নেন। আমাদের মোহাম্মদপুর এলাকার অবস্থা ছিল সবচেয়ে বাজে। আন্দোলনের সময় হেলিকপ্টারে টহল এবং গরম পানি নিক্ষেপ করা হতো। আমাদের চোখের আড়ালে কত নৃশংসতা হয়েছে, তার আসলে হিসাব নেই। মাঝে মাঝে এমন মনে হয়েছে, দুয়েকজন রিকশাওয়ালা ছাড়া কোনো মানুষ রাস্তায় নেই। তখন যদি কেউ আমার ওপর কোনো আক্রমণ বা গুলি করে, তখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো লোক ছিল না। তারা আমার লাশটা গুম করে ফেলত। আমর লাশের চিহ্নই পাওয়া যেত না। রিকশাওয়ালারা হয়তো মুখে মুখে ঘটনার বিবরণ দিত, কিন্তু প্রকৃত ঘটনা কেউই জানত না।

বাসস: ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালানোর পর কীভাবে বিজয় উদ্‌যাপন করেছিলেন?

রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা: ৫ আগস্ট আমি আসলে বিজয় উদ্‌যাপন করতে পারিনি। কারণ ওই দিন মেহেরপুরে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড পারমিতা ভট্টাচার্যের বাসা পুড়িয়ে ফেলা হয়। সেদিন আমি সংসদ ভবনে গিয়েছিলাম, যখন আনন্দ উল্লাস করছিলাম। এসময় জানতে পারি, আমার হলি ক্রসের ফ্রেন্ড পারমিতার বাড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আসলে, রাজনৈতিকভাবে এ ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যেকোনো যুদ্ধ বা সংঘাত পরিস্থিতিতে এ ধরনের ঘটনা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, এগুলো আসলে আমি কখনো দেখিনি। এত সহিংসতা দেখার পর স্বাভাবিক থাকা যায় না।

বাসস: গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান? এক্ষেত্রে আপনাদের কোনো দায়িত্ব রয়েছে কিনা?

রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা: আমরা একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে আন্দোলন করেছিলাম। আমাদের আন্দোলন সফল হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রকে নতুনভাবে গড়তে এখনো অনেক কাজ বাকি আছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারমূলক কাজের বাস্তবায়ন দেখতে চাই। আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি হয়। আমরা দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চাই।  সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিমুক্ত সমাজব্যবস্থা চাই। রাষ্ট্রে কোনো বৈষম্য বা ভেদাভেদ দেখতে চাই না। আদিবাসীদের যৌক্তিক দাবিগুলো পূরণ করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন, ভূমি সমস্যার সমাধানসহ সব ধরনের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

নতুন বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- ন্যায়বিচার। মানুষ যাতে সব ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বিচার যাতে ঝুলিয়ে রাখা না হয়। আমরা চাই, মেয়েরা যাতে স্বাধীনভাবে ও নিরাপদে এ শহরে চলাচল করতে পারে। রাষ্ট্রে এই পরিবর্তনগুলো আনা সহজ কাজ নয়। সেজন্য আমাদের জুলাইয়ের লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়নি। রাষ্ট্রগঠনে আমাদের ভূমিকা রাখতে হবে।

Link copied!