কারাগারে বেড়েছে বন্দিদের ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যু

আহম্মেদ মুন্নী

সেপ্টেম্বর ৩, ২০২৩, ০৩:২৪ এএম

কারাগারে বেড়েছে বন্দিদের ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যু

ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

কারাগারের ভেতরে হঠাৎই বেড়ে গেছে হাজতি ও কয়েদির মৃত্যুর সংখ্যা! গত আট মাসে শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন ৫৭ জন কারাবন্দির মৃত্যু হয়েছে। যেখানে হাজতি ছিলেন ৩১ জন ও কয়েদি ছিলেন ২৬ জন। অথচ গত বছর ১২ মাসে দেশের আটটি বিভাগের কারাগারে মারা গিয়েছিল ৬৫ জন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। 

কারাগারে অভ্যন্তরে চিকিৎসায় অবহেলা, হাজতিদের হতাশা আর পুলিশি রিমান্ডে থেকে বন্দিদের অসুস্থ হওয়ার পর এসব মৃত্যু নিয়ে নানা অভিযোগ উঠেছে। 

গত ২১ আগস্ট ঢাকার কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারাগারে মারা যান মো. আবুল বাশার (৩৬) নামে এক হাজতি। ওই দিন কারাগারে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। পরে দুপুরের দিকে সেখানেই তিনি মারা যান। 

বাশারের স্ত্রী সোমা আক্তারের ভাষ্য, পুলিশি রিমান্ডে নির্যাতনের শিকার হয়ে তাঁর স্বামী মারা গেছেন। সোমা বলেন, কারাগারে সর্বশেষ তিনি তাঁর স্বামীর সাথে দেখা করে এসেছিলেন। তিনি তখন সুস্থ ছিলেন। বাশার তখন বলেছিলেন, ওই মাসের ২৪ তারিখ তিনি জামিন পাবেন। কিন্তু জামিনের দু দিন আগেই জানানো হল, বাশার স্ট্রোক করে মারা গেছেন।

হাজতি আবুল বাশারের মৃতদেহের কিছু ছবি সংগ্রহ করেছে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ। সেসব ছবিতে দেখা গেছে, আবুল বাশারের শরীরে ডান হাতের পেছনের অংশে নীল জখম ও ডান পাশের পেট থেকে শরীর পিঠের অংশে ছোপ ছোপ কালো রক্ত জমাট বাধা। এ ছাড়াও তাঁর বাম হাত থেকে ডান হাত অনেকটাই ফোলা। তাঁর জিহ্বা দুই দাঁতের মাঝখান দিয়ে ফেঁসে আছে। অথচ বাশারের সুরতহাল রিপোর্টে এসবের কিছুই উল্লেখ নেই। 

প্রসঙ্গত, গত ২৬ জুলাই মালিবাগ থেকে পুলিশ আবুল বাশারকে গ্রেফতার করেছিল। তাঁর বাবার নাম আবু বক্কর সিদ্দিক। তাঁর হাজতি নম্বর ৪২৭/২৩। বাশার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

এর আগে গত ২৪ আগস্ট গাজীপুরের টঙ্গীতে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দী মো. রাকিব হোসেন (১৭) মারা যায়। এদিন সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। রাকিবকে গত ২২ জুন একটি মাদক মামলায় র‌্যাব -১ বিমানবন্দর এলাকা থেকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করে। ওই কিশোরের মরদেহে ছিল একাধিক কালো- নীলচে ফোলা দাগ। অথচ তার সুরতহাল রিপোর্টে লেখা ছিল বিষক্রিয়ায় সে মারা গেছে।

রাকিবুলের বাবা সুমন মিয়া ২৬ আগস্ট দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, দুইমাস চারদিন হলো আমার ছেলে নিখোঁজ। দুই দিন আগে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে আমাকে কল দিয়ে জানানো হয়, আমার ছেলের নাকি মৃগী রোগ আছে। সে অসুস্থ। তাকে কেন্দ্র থেকে শহীদ তাজউদ্দিন মেডিকেলে নিয়ে গেছে। আমি আখাউড়া থেকে সেখানে যাই। আমাকে জানানো হয়, আমার ছেলে মারা গেছে। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেলে আছে। 

সুমন আক্ষেপ করে বলেন, একজন শিশু-আসামি জেলখানায় বিষ পাবে কেমনে? আর আমার ছেলের সারা শরীরে এত মারের দাগ, ঘায়ের দাগ, লাশ দেখলেই বুঝা যায় ওকে এই দুই মাস কী পরিমাণ মারধর করা হয়েছে। আমি ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে এ বিষয়ে মামলা করব।

কারাগারে হাজতি বা কয়েদিদের ওপর নির্যাতন বা প্রহারের অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় কারা হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট আসাদুজ্জামান মিয়ার সাথে। তিনি বলেন, রিমান্ড ফেরত আসামিদের বেশিরভাগই অসুস্থ অবস্থায় কারাগারে আসে। এরপর কিছুদিনের মধ্যে তাদের অনেকের মৃত্যু হয়। আর পুলিশের পক্ষ থেকে হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করা হয়। যদিও কারা কর্তৃপক্ষের দাবি কারাগারের ভেতর আসামি বা বন্দীদের ওপর নির্যাতন চালানোর কোনো সুযোগ নেই।

শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক (সহকারী পরিচালক) মোহাম্মদ এহিয়াতুজ্জামান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, রাকিব অসুস্থ ছিল। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা গেছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেলে জানা যাবে কী কারণে সে মারা গেছে। সুরতহাল রিপোর্টের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বিষ সংগ্রহ করার কোনো সুযোগ নেই। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশের বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খান বলেন, রাষ্ট্রীয় হেফাজতে থেকে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসতে দীর্ঘ সময় লাগে। এতে করে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতেও অনেক দেরি হয়ে যায়। এই দীর্ঘ সময়ক্ষেপণকে বিশেষ প্রায়োরিটি দিয়ে ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে নিয়ে আসা উচিত। আস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তো উঠবেই। আমরা অতীতেও শুনেছি, গ্রেফতারের সময় বা আগে-পরে রিমান্ডে নিয়ে আসামীদের ওপর নির্যাতন করা হয়। এর ফলে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর এ কারণে হাজতি ও কয়েদিদের মৃত্যুর ঘটনায় সব সময়ই একটি নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিৎ।

Link copied!