প্রয়াণের ঠিক দুই বছর আগে কালিম্পং থেকে ক্লান্ত শরীর নিয়ে জোড়াসাঁকো আসেন কবিগুরু। ‘ঠাকুরবাড়ির রান্না’ বইয়ে পূর্ণিমা ঠাকুর লেখেন, নানান রান্নার ক্ষেত্রেই প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটিয়েছিল ঠাকুরবাড়ির হেঁশেল।
রবীন্দ্রনাথের প্রিয় খাবারের মধ্যে অন্যতম ছিল কাবাব। আনারস দিয়ে তৈরি রোস্টেড পাঁঠার মাংসও খেতে পছন্দ করতেন বিশ্বকবি।
জোড়াসাঁকোতে আসার পর তার খাদ্যতালিকায় ছিল বিশেষ এই পাঁঠার মাংস। এই মেন্যু বাঙালির খাদ্যতালিকায় অবলুপ্ত। খাবারের বিষয়ে তার অনুরাগ ছিল সুতীব্র। প্রয়াণের আগে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, “Do not blame the food because you have no appetite.”
বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বেশ ভোজনরসিক। অবশ্য এই গুণ তিনি পেয়েছিলেন বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে। স্ত্রী মৃণালিণী দেবীর রান্না করা খাবার ঠাকুর-বাড়ির সবাই পছন্দ করতেন। বিশেষ করে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার তৈরি খাবার খুব তৃপ্তির সঙ্গে খেতেন। শোনা যায়, রবীন্দ্র-পত্নী নাকি টকের সঙ্গে ঝাল মিশিয়ে বেশ নতুন নতুন পদ তৈরি করতেন। যা ঠাকুর-বাড়ির সবার পছন্দের ছিল।
গীতাঞ্জলি লিখে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ যেমন এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিলেন, ঠিক তেমনই খাবারের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন সুরুচির ধারক। তিনি মনে করতেন, খাবার শুধু রান্না করলেই হবে না, খাবার খাওয়ার পরিবেশের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। রবীন্দ্রনাথের ছেলে রথীন্দ্রনাথ ও লেখক বনফুলের লেখনীতে প্রায়ই তার খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্য-দর্শনের বিষয়টি উঠে এসেছে।
১৯১২ সালে লন্ডনে ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের দিন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে লন্ডনের ইন্ডিয়ান সোসাইটি। এদিনের খাদ্যতালিকায় ছিল- গ্রিন ভেজিটেবল স্যুপ, ক্রিম অব টমেটো স্যুপ, স্যামন ইন হল্যান্ডেন সস অ্যান্ড কিউকামবার, প্রি সল্টেড ল্যাম্ব উইথ গ্রিন ভেজিটেবল, রোস্ট চিকেন, ফেঞ্চ ফ্রাই, গ্রিন স্যালাড ও আইসক্রিম। ঠিক এরপরের বছর ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।
রবীন্দ্রনাথের প্রিয় খাবারের তালিকায় অন্যতম ছিল কাবাব। পাশাপাশি আম ও সন্দেশের কথাও বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে আম খাওয়ার প্রতি রবীন্দ্রনাথের ঝোঁক থাকার কথা তুলে ধরা হয়েছে। তার ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বরাত দিয়ে সেখানে উল্লেখ করা হয়, অসুস্থ হয়ে একবার আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র) যাওয়ার সময় মুম্বাই বন্দর থেকে এক বাক্স আলফান্সো আম কিনেছিলেন তারা।
রবীন্দ্রনাথ সন্দেশ খেতেও পছন্দ করতেন বলে হিন্দুস্তান টাইমসে উল্লেখ করা হয়েছে। শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসবের সময় লেখক বনফুলের সপরিবারে একবার গেছিলেন। তখন বনফুলের হাতে সন্দেশের বাক্স দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আনন্দের সঙ্গে বলে উঠলেন- ‘সন্দেশ’। তখন কৌটাটি খুলে তিনি বিশ্বকবির সামনে রাখলেন। এ সময় রবীন্দ্রনাথও একটা সন্দেশ মুখে ভরলেন। এরপর তিনি বললেন, “বাংলাদেশে তো মাত্র দুটি রস-স্রষ্টা আছে, প্রথম দ্বারিক, দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ যে তৃতীয় লোকের আবির্ভাব হলো দেখছি।”
সেদিন বিকেলে বনফুলকে বিকেলে দেখা করতে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাকে বলেছিলেন, “তোমার লেখা পড়ে মনে হয় তুমি ঝাল খেতে ভালোবাসো। বিকেলে বড় কাবলে মটরের ঘুগনি করলে কেমন হয়? ঘুগনির মাঝখানে একটা লাল লঙ্কা গোঁজা থাকবে। কি বলো?”
রবীন্দ্রনাথ কীভাবে জানলেন যে বনফুল ঝাল জাতীয় খাবার খেতে ভালোবাসতেন? তবে কি বনফুলের লেখা পড়েই ঝাল খাওয়ার অভ্যাসের কথা অনুধাবন করেছিলেন তিনি? এছাড়া রবীন্দ্রনাথের সমালোচনাও করেছেন বনফুল। সেই সূত্র ধরেই কি তিনি এ কথা বলেছিলেন? সেদিনই রবীন্দ্রনাথ বনফুলকে নাম দিয়েছিলেন- ‘বিছুটি’। সমালোচনার প্রসঙ্গ তুলে কবিগুরু বলেন, “যা দুই-এক ঘাঁ দিয়েছো, তার জ্বলুনি এখনও কমেনি।”
রবীন্দ্রনাথ কি কি খেতে পছন্দ করতেন সেটা নিয়ে রবীন্দ্র সাহিত্যে কিংবা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিভিন্ন লেখকের স্মৃতিকথায় একটা আভাস পাওয়া যায়। বনফুল একবার লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ খেতে ও খাওয়াতে ভালোবাসতেন। একই সুরে লিখেছেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথও। ইন্দিরা দেবীও প্রায় একই কথা লিখেছেন। তবে রবীন্দ্রনাথ যে কি খেতে পছন্দ করেন, তা একমাত্র রথীন্দ্রনাথই ধরতে পেরেছেন।
বাবা রবীন্দ্রনাথের খামখেয়ালি এক সভার কথা বর্ণনা করে রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বাবার যেবার নিমন্ত্রণের পালা পড়ল, বাড়িতে হুলুস্থূল পড়ে গেল। মাকে (মৃণালিণী দেবী) ফরমাশ দিলেন খাওয়ানোর সম্পূর্ণ নতুন রকম ব্যবস্থা করতে হবে। মামুলি কিছুই থাকবে না। প্রত্যেকটি পদের বৈশিষ্ট্য থাকা চাই।”
রথীন্দ্রনাথের লেখনীতে উঠে এসেছে, বাবা মনে করতেন, খাওয়াটা উপলক্ষ মাত্র। রান্না ভালো হলেই হলো না- খাবার পাত্র, পরিবেশনের প্রণালী, ঘর সাজানো, সবই সুন্দর হওয়া চাই। যেখানে খাওয়ানো হবে তার পরিবেশে শিল্পীর হাতের পরিচয় থাকা চাই।
বনফুলের লেখনীতেও একই কথা উঠে এসেছে। যেদিন রবীন্দ্রনাথ বনফুলকে কাঁচামরিচ মেখে ঘুগনি খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নেন, সেদিন প্রকৃত অর্থে রবীন্দ্রনাথ আনুষ্ঠানিকভাবে বনফুলের পরিবারকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে চেয়েছিলেন। সেদিন উত্তরের একটি বারান্দাকে পর্দা দিয়ে ঘিরে রেখেছিলেন তিনি।