রেংমির্চা কেমন আছে, বেঁচে আছে কি সৌরা!

তুহিন কান্তি দাস

ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২১, ১০:৩৭ পিএম

রেংমির্চা কেমন আছে, বেঁচে আছে কি সৌরা!

মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্যে বাঙালি জাতির দামাল ছেলেরা জীবন উৎসর্গ করেছে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্রদের মিছিল। রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। জাতি ফিরে পায় মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার। পরবর্তীতে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতিও অর্জন করে। বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় বাংলাভাষা। অথচ এই বাংলাদেশেই অনেকগুলো মাতৃভাষা প্রায় বিলুপ্তির পথে। আগামী ত্রিশ-চল্লিশ বছর পরে এইসকল ভাষার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়!

রাঙ্গামাটির সাজেকে বসবাসকারী তেমন এক ভাষাভাষী গোষ্ঠীর নাম সৌরা। পাঁচ থেকে ছয়জন মানুষ কথা বলে এই ভাষায়। একই অঞ্চলের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ আরেকটি ভাষা রেংমির্চা। তিব্বতি ভাষা পরিবারভুক্ত এই ভাষায় কথা বলে গোষ্ঠীর ত্রিশ থেকে চল্লিশজন ব্যক্তি, যাদের বয়স পঞ্চাশের বেশি। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, তাদের মৃত্যুর পরেই হয়তো চিরতরে হারিয়ে যাবে এই দুটি ভাষা। এ হারিয়ে যাওয়া ভাষার তালিকায় কী শুধু সৌরা কিংবা রেংমির্চা? বিলুপ্তি হওয়ার তালিকায় অপেক্ষামান আরও একাধিক ভাষা, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কন্দ, কড়া, বম, চাক, লুসাই,পাংখুয়া ও খুমি ভাষা।

বাংলাদেশের পাহাড় এবং সমতলে কয়েক লাখ আদিবাসী বসবাস রয়েছে। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নিজেদের ভাষা অর্থাৎ মাতৃভাষাতেই কথা বলতে তারা স্বাচ্ছন্দবোধ বোধ করেন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৫৩টি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস এবং ৪১টি ভাষার সন্ধান পাওয়া গেছে। যেখানে বাংলা এবং বিহারী-পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের ভাষার বাইরে ৩৪টি ভাষাই আদিবাসীদের। তবে এসব ভাষার মধ্যে প্রায় ১০টি ভাষার লিখিত বর্ণমালা থাকলেও অন্যান্য ভাষা কেবল স্থানীয়দের মুখেই সীমাবদ্ধ। এরফলে অনেক ভাষাই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।

ভাষা বিলুপ্তির নিয়ে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারাণ সম্পাদক এবং কলামিস্ট সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘ভাষা হারিয়ে গেলে জ্ঞান হারিয়ে যায়, ভাষা হারিয়ে গেলে ইতিহাস-ঐতহ্য হারিয়ে যায়। এই জাতি ভাষার জন্যে জীবন গৌরবময় ইতিহাস আছে, আমরা চাই না আমাদের দেশের আদিবাসী ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাক। তাই ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্যে জাতীয় আদিবাসী একাডেমি গড়ে তোলার জন্য তিনি সরকারের প্রতি দাবি জানান।

২০১০ সালে শিক্ষানীতি অনুযায়ী, এ দেশের আদিবাসী তথা সরকারি ভাষায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। ২০১৩ সালের শুরুতেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হয়ে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে আদিবাসীদের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষার কার্যক্রম শুরু করে। এ বিষয়ে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে গঠিত জাতীয় কমিটির সুপারিশে প্রাথমিকভাবে ছয়টি (চাকমা, মারমা, ককবোরক, মান্দি, সাঁওতালি ও সাদরি) ভাষায় পাঠ্যপুস্তক তৈরি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরবর্তীতে সাঁওতালি ভাষায় হরফ বিতর্কে বর্তমানে ৫টি ভাষাতেই এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

 এই সরকারি উদ্যোগেও সংকটের সীমা নেই। অনেক ভাষারই লিপি নেই, পর্যাপ্ত লোকসাহিত্যের অভাব, দক্ষ শিক্ষক সংকট, যোগাযোগ সীমাবদ্ধতা অন্যতম অন্তরায় । এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে সংকট তা হলো প্রাক-প্রাথমিক মাতৃভাষা শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে সংখ্যায় অধিক ভাষাভাষী গোষ্ঠী থেকে সংখ্যাগুরু প্রক্রিয়ায়। অন্তর্ভুক্ত ভাষাগুলো ৩৪টি জাতিগোষ্ঠীর মাঝে সংখ্যাগুরুর ভাষা। ফলে এই ছয়টি ভাষার বাইরে এখনো ২৮টি ভাষা সংরক্ষণ উদ্যোগের বাইরেই রয়ে গেছে।

এই সম্পর্কে ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. সৌরভ সিকদার বলেন, ‘যে পথটা নেয়া হয়েছে এই বিষয়ে কিছু যুক্তি আছে। কেবল সেই ভাষায় আপনি বই তৈরি করতে পারবেন যার লিখিত বর্ণমালা আছে, যে ভাষায় পর্যাপ্ত রিসোর্স আছে এবং অবশ্যই বিশেষজ্ঞ থাকতে হবে। এখন যদি আমাকে রেংমির্চা কিংবা সৌরা ভাষায় পুস্তক তৈরি করে দিতে বলে কেউ আমি পারবো না। এইরকম অনেক ভাষা আছে যেগুলো বিপন্ন কিন্তু তাতে মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে হলে কমিউনিটি অংশগ্রহণ এবং যথাযথ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ প্রয়োজন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

Link copied!