ডিসেম্বর ২৫, ২০২১, ০৬:২৯ পিএম
আইজ্যাক নিউটনের জন্মের বেশ কয়েকমাস আগেই তার বাবা মারা গিয়েছিলেন। মায়ের পেটে পরিণত শিশু হয়ে ওঠার আগেই তার জন্ম হয়েছিল। ফলে ছোটবেলায় বেশ কৃষকায় এবং দূর্বল ছিলেন তিনি। এতোই দূর্বল ছিলেন যে, ১৬৪২ সালের ২৫ ডিসেম্বর জন্মের পর তাকে এক লিটারের মগের ভেতরে অনায়াসে রাখা যেত।
কৃষকের ঘরে জন্ম নেওয়া এই বিস্ময়বালক প্রাথমিক শিক্ষা জীবনে খুব ভালো ছাত্র ছিলেন না। একবার তো তার মা তাকে কৃষক বানানোর জন্য পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সৌভাগ্য, তাকে স্কুল ছাড়তে হয়নি। পরে ক্রমশ নিউটন নিজেকে শাণিত করতে থাকেন এবং স্কুলের পেছনের সারির শিক্ষার্থী থেকে নিজেকে সেরা ছাত্রে পরিণত করেন।
নিউটনের শৈশব ছিল বেদনায় পরিপূর্ণ। জন্মের আগেই বাবা হারিয়েছিলেন। ৩ বছর বয়েসে তার মা বিয়ে করেছিলেন আরেক ভদ্রলোককে। এই ভদ্রলোক নিউটনকে সহ্য করতে পারতেন না। ছোট বেলায় একারণে নিউটন তার মা ও সৎবাবাকে ঘরসমেত পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এমন কথা নিউটনের ডায়েরি থেকে পাওয়া যায়। ব্যক্তি জীবনে ধার্মিক নিউটন তার ‘ছোট্টবেলার পাপ’ শিরোনামে করা একটি তালিকায় তার এই চিন্তাটিকে রেখেছিলেন। যাইহোক, নিউটন কারও ঘর পোড়াননি।
নিউটন তার শৈশব কাটিয়েছেন তার দাদা-দাদীর সঙ্গে। কিন্তু তা সুখের ছিল না। এই একাকীত্ব পরবর্তী জীবনে তাকে বেশ আগ্রাসী, রাগী, সন্দেহবাতিক এবং নিঃসঙ্গ মানুষে পরিণত করেছিল। এরই সূত্র ধরে জীবনে বিয়ে করেননি। কোন নারীর সঙ্গ লাভ করেছিলেন এমন কোন তথ্যও পাওয়া যায়না। আজীবন নিজের বিজ্ঞান সাধনা নিয়ে মগ্ন থেকে ছিলেন।
১৬৬৫ সালে যখন সারা ইউরোপে ব্ল্যাক ডেথ বা বিউব্যোনিক প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে তখন নিউটনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে, নিউটন তার নিজ বাসভূমি ওলসথর্প ম্যানরে ফিরে আসতে বাধ্য হন। তখন তার বয়স মাত্র ২৩ বছর। সেসময়ই নিউটন তার বিখ্যাত কিছু তত্ত্ব নিয়ে চিন্তাভাবনা করিছলেন। সেরকমই কোন এক চিন্তায় নিউটন তাদের আপেল বাগানে চিন্তামগ্ন ছিলেন। তার পরের ঘটনা তো সবারই জানা। কিন্তু, মজার ব্যাপার হলো আপেল পড়ার ঘটনা থেকে নিউটন তৎক্ষণাৎ তার বিখ্যাত মহাকর্ষ সূত্র আবিস্কার করেননি। এই ঘটনা তাকে মহাকর্ষ সূত্র বিকাশে সাহায্য করে কিন্তু সেটিকে সূত্র আকারে প্রকাশ করতে নিউটনের সময় লাগে আরও ২২ বছর। ১৬৮৭ সালে নিউটন এটিকে সূত্র আকারে প্রকাশ করেন।
নিউটন গবেষক হিসেবে অসাধারণ হলেও শিক্ষক হিসেবে ছিলেন ভয়াবহ। তার নিজেরও যেমন পড়ানোর আগ্রহ ছিল না, তেমনি শিক্ষার্থীরাও তার ক্লাসে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। তার ক্লাসে দেখা যেত, তিনি গিয়ে হাজির কিন্তু কোন শিক্ষার্থী নেই। কিংবা শিক্ষার্থী আছে দুচারজন কিন্তু নিউটনের দেখা নেই।
কেবল শিক্ষক হিসেবে না গবেষক হিসেবেও নিউটন ছিলেন ভীষণ অন্তর্মুখী। আগেই বলেছি তার, বিপর্যস্ত শৈশব তাকে ব্যক্তি জীবনে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। নিউটন যখন ব্রিটিশ রয়াল সোইটির চেয়ারম্যান ছিলেন তখন প্রথম জীব কোষ আবিস্কারক স্বদেশী বিজ্ঞানী-দার্শনিক রবার্ট হুকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। সেসময় রবার্ট হুক নিউটনের আলোক তত্ত্ব এবং তার পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত কাজের তীব্র সমালোচনা করেন এবং সেগুলো ভুঁয়া বলে উড়িয়ে দেন। এমনকি রবার্ট হুক তো নিউটনের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও করেছেন যে, নিউটন তার বেশ কিছু কাজ চুরি করে ‘ফিলোসোফিয়া ন্যাচারালিস ম্যাথমেটিকা প্রিন্সিপিয়া’-তে যুক্ত করে দিয়েছেন। যদিও এই অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি।
এছাড়াও, নিউটন জার্মান গণিতবিদন গটফ্রিড ভন লিবেনিজের সঙ্গেও কে প্রথম ক্যালকুলাস আবিস্কার করেছেন তা নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিলেন। লিবেনিজের দাবী তিনিই প্রথম ক্যালকুলাস আবিস্কার করেছেন। কিন্তু ঘটনা হলো, ১৬৬০ এর দশকেই নিউটন তার ক্যালকুলাস ফর্মুলা আবিস্কার করেছিলেন কিন্তু তা প্রকাশ করেননি। নিজের গবেষণাকর্ম প্রকাশে তিনি বেশ খুঁতখুঁতে এবং অনীহ ছিলেন। ফলে তিনি চূড়ান্তভাবে যাচাই না করে তার ক্যালকুলাসের ফর্মুলা প্রকাশে রাজি ছিলেন না। এদিকে, লিবেনিজ ১৬৭০ সালের দিকে তার নিজের মতো করে ক্যালকুলাসের আরেকটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এবং তা তিনি প্রকাশও করেন। সেটি প্রকাশের পর নিউটন দাবী করেন, লিবেনিজ তার আইডিয়া চুরি করেছেন। নিউটন আরও দাবী করেন, লিবেনিজ তার আইডিয়া এবং ডকুমেন্টস নিয়ে সেগুলো রয়্যাল সোসাইটির মাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ করেছেন। লিবেনিজও পাল্টা অভিযোগ আনেন নিউটনের বিরুদ্ধে।
পরে লিবেনিজ রয়্যাল সোসাইটিতে এই বিষয় নিষ্পত্তির জন্য আপীল করেন। মজার ব্যাপার হলো নিউটন তখন রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। এজন্য, লিবেনিজ দাবী করেন, একটি নিরপেক্ষ কমিটি দিয়ে বিষয়টির সুরাহা করতে। কমিটি দুজনের কারও অভিযোগের কোন সারবত্তা খুঁজে পায়নি। কিন্তু তারা দেখতে পায় যে. নিউটনই ক্যালকুলাস বিষয়ে প্রথম কাজ করেন। তখন থেকেই নিউটনকে ক্যালকুলাসের জনক বলা হয়। তবে ক্যালকুলাসের উন্নয়নে লিবেনিজের অবদানকেও মৌলিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
নিউটন কেবল গণিতবিদ, পদার্থবিদ এবং দার্শনিকই ছিলেন না। ছিলেন অর্থনীতিবিদও। জীবনের শেষবেলায় তাকে ইংল্যান্ডের টাকশালের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্ব পেয়ে সংস্কার করেছিলেন মুদ্রা ব্যবস্থার। পুরনো মুদ্রা তুলে নিয়ে নামিয়েছিলেন নতুন মুদ্রা। একসময় তাকে ইংলিশ টাকাশালের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে, তিনি ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে ইংলিশ পার্লামেন্টের সদস্যও নির্বাচিত হন। তবে, মজার ব্যাপার হলো, পার্লামেন্টে নিউটন একবার মাত্র বক্তব্য রেখেছিলেন। তাও আবার পার্লামেন্টের ক্যান্টিন থেকে মরিচের ঝাঁজ আসছিল বলে, পার্লামেন্ট হলের দরজা বন্ধ করতে বলেছিলেন।
শূন্য থেকে শুরু করে এক নিরক্ষর কৃষকপুত্র রীতিমতো ধনী হয়ে ইংল্যান্ডের সম্মানসূচক উপাধি নাইটে ভূষিত হয়েছিলেন। পেছনের সারির ছাত্র থেকে হয়ে উঠেছেন সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানীদের একজন।