বেগম রোকেয়া: আলো হাতে আঁধার ঘুচানো অগ্নিমশাল

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ডিসেম্বর ৯, ২০২১, ০৫:১৭ পিএম

বেগম রোকেয়া: আলো হাতে আঁধার ঘুচানো অগ্নিমশাল

‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কীরূপ? কোনো ব্যক্তি এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্য তাহাই।’

গাড়ির দুই চাকার একটি যদি ছোট হয় তাহলে সেই গাড়ি যেমন চলতে পারে না তেমনি সমাজেরও দুটি সত্ত্বা নারী ও পুরুষকে আলাদা করলে চলবে না। অর্থাৎ নারীকে অবদমিত করে কখনই সমাজ এগিয়ে যেতে পারে না। বহু আগে বেগম রোকেয়া এ প্রসঙ্গটি টেনেছিলেন।

এই উপমহাদেশের নারীমুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টাদের অন্যতম বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২) একজন সমাজসংস্কারক, নারীশিক্ষা প্রচারক এবং সাহিত্যিক রূপে বাংলাদেশের নবজাগরণের সূত্রপাতের অগ্রদূত হিসেবে জাতীয় ভিত্তিতে সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি পেয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব বরেণ্য মহান ব্যক্তিত্ব মানবজাতিকে যথার্থ অর্থে সভ্যতার আলোর পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, তাদের প্রত্যেককেই সমকালীন সামাজিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামির তমসাচ্ছন্নতা থেকে দুঃসাহসী পদক্ষেপে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। 

বেগম রোকেয়ার স্মৃতিবিজরিত ভাষ্কর্য

বেগম রোকেয়ার জীবনী পাঠেও জানা যায়, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার সাহায্যে ও সর্বজনীন কল্যাণের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পথ চলতে গিয়ে তাকেও নানা প্রকারের বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সমাজসংস্কারক ও সাহিত্যিক বেগম রোকেয়া তার কর্মক্ষমতা ও তিতিক্ষা, আদর্শের মহত্ত্ব, স্পষ্টতর আত্মত্যাগ ও পরার্থপরতা, সহনশীলতা ও দৃঢ়তা, সর্বোপরি তার অসীম সাহসিকতা এবং অন্তর্দৃষ্টির স্বচ্ছতা ও প্রজ্ঞার গভীরতা প্রভৃতির বিবেচনায় একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

ছোটবেলাতেই রোকেয়া স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করে মানুষের মতো মাথা উঁচু করে বাঁচবেন। কিন্তু পারিবারিক পরিবেশ অনুকূলে ছিল না। বাবা জহির উদদীন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের প্রকৃত অর্থেই নারী শিক্ষার পক্ষপাতি ছিলেন না। অনেকের মতো তিনিও মনে করতেন পুথিগত বিদ্যা মেয়েদের চক্ষুলজ্জা কমিয়ে দেয়, যা সংসারের অশান্তির কারণ। পায়রাবন্দ গ্রামে সাড়ে তিন শ লাখেরাজ জমির মাঝখানে সাবের পরিবারের বসতবাড়ি ছিল। অনেকের মতে তার বাবা ছিলেন অনেকটাই বিলাসী প্রকৃতির, অমিতব্যয়ী ও রক্ষণশীল।

মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো তার। এই বিয়ের মাত্র নয় বছরের মধ্যে বিধবা হয়েছিলেন তিনি। এরপর বোনের শ্বশুরবাড়ি ময়মনসিংহের দেলদুয়ারে বেড়াতে গিয়ে ইউরোপিয়ান গভর্ন্যান্সের কাছে ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ পান রোকেয়া। পরে এই শিক্ষাটা খুব কাজে লেগেছিল তার।

সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর বেগম রোকেয়া তার এই বোনকে ‘মতিচুর’ গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন। এই বোন ছাড়াও বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের সহযোগিতার কথা তিনি বারবার করে বলেছেন বিভিন্ন লেখায়।

১৯০৪ সালে রোকেয়ার প্রথম গ্রন্থ ‘মতিচুর’ প্রকাশিত হলো। পরের বছর প্রকাশিত হলো ‘সুলতানার স্বপ্ন’। একটি ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশিত হলো বিখ্যাত এই লেখাটি। ১৯০৮ সালে তার স্বামী জীবিত থাকাবস্থায়ই এটি বই আকারে বের হয়েছিল।

বেগম রোকেয়া

নারীশিক্ষা, নারীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতায়নের বিষয়গুলো বেগম রোকেয়ার রচনার মূল বক্তব্য হিসেবে লক্ষণীয়। অবরোধ প্রথা ও ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে নারী যুগে যুগে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আর শিক্ষার অভাবে আমাদের নারীসমাজ জ্ঞানের আলোর সন্ধান পায়নি। এই জ্ঞানের অভাবে নারী আত্মমর্যাদা ও আত্মপ্রত্যয় অর্জন করতে সক্ষম না হওয়ায় নারীকে পুরুষের মুখাপেক্ষী হয়ে পুতুলের মতো জীবন যাপন করতে হয়। তাই নারীকে শিক্ষা অর্জন করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার কথাই বেগম রোকেয়া বলেন।

বেগম রোকেয়া দিবসে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, বেগম রোকেয়া নারীদের নিয়ে যে স্বপ্ন দেখতেন তা কি বাস্তবায়িত হয়েছে? এখনো ঘরে-বাইরে চলে নারী নির্যাতন। নারী, শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন (ভিএডব্লিউ) সার্ভে ২০১১’ শীর্ষক জরিপ বলছে, বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো সময়, কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার।

বেগম রোকেয়া যৌতুকের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। অথচ ২০১১ সালে বিবিএসের জরিপ বলছে, এক-তৃতীয়াংশ নারীরই যৌতুকের বিনিময়ে বিয়ে হয়েছে।

নারীমুক্তির যে আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছিলেন রোকেয়া সেই সমাজ প্রতিষ্ঠা এখনও অনেক দূরে। নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সেটাই প্রমাণ করে। 

আজ বৃহস্পতিবার দেশে পালিত হচ্ছে বেগম রোকেয়া দিবস। ৯ ডিসেম্বর তার জন্ম ও মৃত্যুদিবস। ১৮৮০ সালে জন্ম নেন তিনি। নারীশিক্ষা বিস্তারের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া মারা যান ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর। বেগম রোকেয়ার প্রকাশিত গ্রন্থ পাঁচটি। এ ছাড়া সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং আনজুমানে-খাওয়াতীনে ইসলাম নামে সংগঠনের প্রতিষ্ঠা তার উল্লেখযোগ্য কাজ।

পরিতাপের বিষয় হলো, তবে পায়রাবন্দে রোকেয়ার পৈতৃক ভিটা ও বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি অবহেলায় জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। রোকেয়ারা স্বজনেরা নিজ উদ্যোগে রোকেয়ার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখছেন।

শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং উপমহাদেশের নারী জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে বেগম রোকেয়া থাকুক চির অম্লান। নারীদের প্রেরণায় যুগ যুগ ধরে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন বেগম রোকেয়া। তার শিক্ষা বুকে ধারণ করেই নারীরা এগিয়ে যাবে সামনের দিকে।

Link copied!