সঞ্জীব চৌধুরী: যাঁর গানে মিলতো নাগরিক জীবনের গভীর অনুভব

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

নভেম্বর ১৯, ২০২২, ১১:০৪ পিএম

সঞ্জীব চৌধুরী: যাঁর গানে মিলতো নাগরিক জীবনের গভীর অনুভব

মানুষ চলে যায় রেখে যায় স্মৃতি। লেখক-সাহিত্যিক রেখে যান গল্প-কবিতা-নাটক। সংগীতশিল্পী রেখে যান গান। সাহিত্য বা গানই তাঁদের মহামূল্যবান স্মৃতিসম্ভার। কীর্তিমানদের তাই মৃত্যু হয় না। তাঁদের কীর্তি যুগ যুগ ধরে গেঁথে থাকে মানুষের হৃদয়ে। আমাদেরও ছিলেন একজন। সঙ্গীতের। যাঁকে আমরা বলি আমাদের বব ডিলান। অবিস্মরণীয় সেই কণ্ঠশিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী। ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর তিনি অকালে চলে গেছেন। সবে তাঁর গান সুবাস ছড়াতে শুরু করেছিল।

তাঁর গাওয়া 'তোমার ভাঁজ খোলো আনন্দ দেখাও করি প্রেমের তর্জমা', ‘গাড়ি চলে না চলে না চলে না রে’, ‘বায়োস্কোপ’, ‘আমি তোমাকেই বলে দেবো’, ‘কোন মিস্তিরি বানাইয়াছে নাও’, ‘আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ’, ‘সাদা ময়লা রঙিলা পালে’, ‘কথা বলবো না’, ‘এই নষ্ট শহরে’, ‘রিকশা’, ‘চোখটা এতো পোড়ায় কেন’ গানগুলো এখনো হৃদয়ে তোলপাড় ফেলে।

'আমি তোমাকেই বলে দেব, কী যে একা দীর্ঘ রাত, আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে’ এই গান গাইতে গাইতেই যেন তিনি বিরান পথে হেঁটে চলে গেলেন ওপারে। যে অগণিত শ্রোতার হৃদয় তিনি দখল করেছিলেন, সেই শ্রোতারা হঠাৎ করে তাঁর এমন প্রস্থানে সঞ্জীব বিনে হাহাকার করে উঠল। বাজার কাটতি গানের ভিড়ে তিনি সেই সময় সৃষ্টি করেছিলেন কিছু ব্যতিক্রমী গান। যেগুলোতে প্রাধান্য পেয়েছিল নাগরিক জীবনের গভীর অনুভব-অনুরণন।

তিনি বেঁচে থাকাকালে ‘দলছুট’ ব্যান্ড থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ‘আহ্’ (১৯৯৭), ‘হৃদয়পুর’ (২০০০), ‘আকাশচুরি’ (২০০২) ও ‘জোছনা বিহার’ (২০০৭) অ্যালবামগুলো। একেকটি অ্যালবাম যেন যত্নের সর্বোচ্চটা দিয়ে করা। গানগুলোর প্রতিটিই শ্রোতাপ্রিয়।

সঞ্জীব চৌধুরী আপাদমস্তক উদাসী এক কবি ছিলেন। ছিলেন সাংবাদিকও। কিন্তু দ্রোহের মুখোমুখি হয়ে পিছুটান দেওয়ার ইতিহাস তাঁর নেই। প্রতিকূল ডায়াসে দাঁড়িয়ে টান টান উত্তেজনার সামনে সত্যবচনে একবিন্দুও পিছপা হননি কখনো, গাইতে গিয়ে কখনো গলাও কাঁপেনি তাঁর।

সঞ্জীবের প্রতি মানুষের ভালোবাসার টান কখনো কমবে না। সোশ্যাল মিডিয়ার এ যুগে ভক্তদের টাইমলাইনগুলো তাঁর জন্মদিন ও প্রয়াণ দিবসে তাই সঞ্জীব-সজীব-সচল হয়ে উঠে তাঁরই বন্দনায়। তাঁর গানের লাইন কিংবা ছবি শেয়ার করে স্মৃতিকাতর হন তাঁরা।

সঞ্জীব চৌধুরী পড়াশোনা করেছিলেন সাংবাদিকতা বিষয়ে। কর্মজীবনেও ছিলেন সাংবাদিক। দেশের নামকরা গণমাধ্যমে লিখতেন। কিন্তু এই গণ্ডি ছাপিয়ে তিনি অনন্য হয়ে উঠেছিলেন সংগীতশিল্পী হিসেবে। গানের সাথে যদিও তাঁর সখ্য ছাত্রজীবন থেকেই। ‘শঙ্খচিল’ নামে একটি ব্যান্ডের সাথে যুক্ত হয়ে পথচলার শুরু। এরপর ১৯৯৬ সালে বাপ্পা মজুমদার ও আরও কয়েকজনকে নিয়ে গঠন করেন ‘দলছুট’ ব্যান্ড। এরপর থেকে সঞ্জীবের গান হয়ে ওঠে রুচিশীল তরুণদের মনের হৃদয়ের খোরাক। প্রেম-বিরহ কিংবা জীবনবোধ সবই উঠে এসেছে তাঁর প্রতিটি গানে।

শুধু সাংবাদিকতা আর গান নয়, লেখক হিসেবেও তিনি বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন অতি অল্প বয়সেই। তাঁর লেখা কবিতা নিয়ে প্রকাশ হয়েছে ‘রাশপ্রিন্ট’ নামের একটি কাব্যগ্রন্থ। এছাড়া ছোট গল্প, নাটকও লিখতেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। 

২০০৭ সালের  বাইলেটারেল সেরিব্রাল স্কিমিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হন সঞ্জীব চৌধুরী। সে বছরের ১৫ নভেম্বর আকস্মিক অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এরপর অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাঁকে। কিন্তু চারদিন পর ১৯ নভেম্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করে তাঁর গাওয়া সেই ‘বিরাণ পথের ‘ উদ্দেশ্যেই চলে যান তিনি। যেখান থেকে কেউ আর কোনোদিন ফেরে না।

Link copied!