সুরের পাখি লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণে তাদের শোকগাঁথা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২২, ০৬:২৬ পিএম

সুরের পাখি লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণে তাদের শোকগাঁথা

চলে গেলেন সুরের সম্রাজ্ঞী, ভারতরত্ন লতা মঙ্গেশকর৷ তার বিদায়ে শোকগ্রস্ত গোটা ভারত। ভারতবাসীর কাছে তিনি ছিলেন গানের পাখি নাইটিংগেল, কেউবা তাকে বলতেন ‘স্বরা কোকিল’। কিংবদন্তির প্রয়াণে শোকে স্তব্ধ ভারতীয় সংগীত-ক্রীড়া-রাজনীতি অঙ্গন। সোশ্যাল মিডিয়ায় শোকগাঁথার বন্যা।

Lata Cover

শোক প্রকাশ করে সোমবার অর্ধদিবস ছুটি ঘোষণা করেছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। আগামী ১৫ দিন রাজ্যে বাজবে লতার গাওয়া গান। 

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে হাজারের বেশি সিনেমায় গান করেছেন লতা। ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি বিদেশি ভাষাতেও তিনি গান করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ছবি দিয়ে, তার সঙ্গে স্মৃতির কথা লিখে, কিংবা তার কাছে অনুপ্রেরণা পাওয়ার কথা জানিয়ে শোক প্রকাশ করছেন ভারতের বিভিন্ন অঙ্গনের প্রতিনিধিরা।

‘‘এতোটাই বিশুদ্ধ এবং পরিষ্কার যেন স্ফটিকের সবচেয়ে সেরা মুক্তো''— গীতিকার এবং চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতার লতা মঙ্গেশকরের সুরেলা কণ্ঠ এবং আন্তরিক গান গাওয়াকে বর্ণনা করেছেন এভাবেই।

টুইটারে লতার সঙ্গে নিজের একটি ছবি প্রকাশ করে সুরকার এ আর রহমান লিখেছেন, “ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং প্রার্থনা।”

টুইট বার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, ‘আমি আমার ব্যথার কথা বলে প্রকাশ করতে পারব না। দয়ালু এবং যত্নশীল লতা দিদি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তিনি আমাদের দেশে এমন এক শূন্যতা রেখে দিয়ে চলে গেলেন যা কখনও পূরণ করা যাবে না। ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁকে ভারতীয় সংস্কৃতি জগতের একজন অকুতোভয় মানুষ হিসেবে মনে রাখবে। তাঁর সুরেলা কণ্ঠে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করার এক অতুলনীয় ক্ষমতা ছিল।’

Lata Modi

ভারতরত্ন লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণে শোক প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বাংলা গান ও শিল্পীদের ভালোবাসার জন্য প্রয়াত শিল্পীকে বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তিনি। সিরিজ টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘ভারতের প্রয়াত আইকন, ভারতরত্ন লতা মঙ্গেশকরকে আমার হৃদয় থেকে শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর পরিবার এবং বিশ্বের কোটি কোটি ভক্তের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি। ভারতের নাইটিঙ্গেলের মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত। তাঁর আর সব ভক্তের মতো আমিও তাঁর কণ্ঠ ও পরিবেশনায় মুগ্ধ ছিলাম। বাংলা এবং প্রাচ্যের শিল্পীদের হৃদয়ে ঠাঁই দেওয়া ও আমাদের সংগীতজগতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠার জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’

লতা মঙ্গেশকর যেমন শচীনকে নিজের ছেলের মতো দেখতেন, শচীনও লতাকে ডাকতেম ‘মা’ বলে। শচীন প্রসঙ্গে লতা সব সময়ই বলতেন, সব খেলোয়াড়ই ভাল, কিন্তু শচীন আমার খুব প্রিয়।’ শচীন লতার প্রয়াণে তাই শোকবিহ্বল। তিনি লিখেছেন, তিনি ক্রিকেটকে যেমন ভালবাসতেন, ঠিক তেমনই স্নেহ করতেন শচীনকে। নিজের ছেলের মতো মনে করতেন কিংবদন্তি ক্রিকেটারকে। শচীনও তাঁকে 'আই' বলে ডাকতেন। বাংলায় যার অর্থ মা। তাই সকালে দুঃসংবাদ পাওয়ার পর এক মুহূর্ত দেরী করেননি। 'আই' কে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে হাসপাতালে ছুটে যান শচীন। নীল মাস্কে ঢাকা মুখেও বিষাদের ছায়া। সেখান থেকে লতা মঙ্গেশকরের বাড়ি প্রভু কুঞ্জেও যান। বিকেলে স্ত্রী অঞ্জলি তেন্ডুলকরকে নিয়ে শিবাজী পার্কে শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিলেন শচীন।

Lata Shachin

আপনজনকে হারানোর শোকের মধ্যেই রবিবার বিকেলে টুইট করেন শচীন তেন্ডুলকর। সেখানে লেখেন, 'লতা দিদির জীবনের অঙ্গ হতে পেরে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। ওনার থেকে প্রচুর ভালোবাসা এবং আশীর্বাদ পেয়েছি। ওনার প্রয়াণে মনে হচ্ছে যেন আমার নিজের একটা অংশ হারিয়ে ফেললাম। গানের মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ে আজীবন বেঁচে থাকবেন।' ক্রিকেট ছাড়ার পরও লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল শচীনের। নিয়মিত তাঁর খবর নিতেন। সুরসম্রাজ্ঞীর বাড়িও যেতেন দেখা করতে। পরিবারের অঙ্গ হয়ে গিয়েছিলেন। সেই সুর এবার কেটে গেল। তবে প্রয়াত শিল্পীর গানের মাধ্যমে আজীবন শচীনের স্মৃতিতে অমর হয়ে থাকবেন লতা মঙ্গেশকর।  

লোপামুদ্রা মিত্রের কাছে যেন জীবন্ত দেবীর বিসর্জন ঘটল। তিনি বলেছেন, “বরাবরের আফসোস, কোনও দিন সামনে থেকে কিশোর কুমারকে দেখতে পাইনি। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নেওয়ার অভিজ্ঞতা সেই আক্ষেপ যেন কিছুটা মিটিয়েছিল।”

ইমন চক্রবর্তী বলেছেন, “লতা মঙ্গেশকরের শরীরের বিনাশ হল। আত্মা পাড়ি দিল সুরলোকে। সুর সম্রাজ্ঞী বিদায় নিয়েছেন। বদলে রেখে গিয়েছেন তার অসংখ্য গান। ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অবিস্মরণীয় কাজ করেছেন। আজ তাকে, তার গানকে, তার কাজকে নতুন ভাবে ফিরে দেখার দিন। তার অবদান উদযাপনের দিন।”

Lata Shahrukh

শাহরুখ খান কেরিয়ারে একের পর এক বড় ছবি করে দর্শকদের উপহার দিয়েছেন, জীবনে অনেক প্রাপ্তী তার, তবে নেই কোনও আক্ষেপ! আছে, তারই মধ্যে অন্যতম হল লতা মঙ্গেশকরকে ঘিরে। এক পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে একবার শাহরুখ খান জানিয়েছিলেন তার ছবির জন্য গান গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর, এটা তার কাছে সৌভাগ্যে। মেরে খাবো মে যো আয়ে... গানটি ছিল সুপারহিট, ছবিটিও ছিল ব্লকবাস্টার। কিন্তু সেদিনই এক আক্ষেপের কথা সামনে আনেন কিং খান। জানান, তার জীবনের বড় আক্ষেপ তাঁর কণ্ঠে কোনওদিন লতা মঙ্গেশকর গান উপহার দিতে পারবেন না। পুরুষ না হয়ে মহিলা হলে লতা মঙ্গেশকরের গানে তিনি লিপ দিতে পারতেন। তবে তার গানে পারফর্ম করার সুযোগটুকু পেয়েই ধন্য তিনি। কিংবদন্তির প্রয়াণে একাধিক পোস্ট দিয়েছেন তিনি। থাকছেন লতার অন্তেক্রিয়ায়। 

লতার সঙ্গে নিজের জীবনের নানা ঘটনা গণমাধ্যমে লিখেছেন ওস্তাদ রশিদ খান। শোক প্রকাশ করে এই শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী বলেছেন, “কালের নিয়মে লতাজি প্রয়াত হলেন ঠিকই। কিন্তু লতাজির মতো শিল্পীর তো প্রয়াণ হয় না। তিনি থেকে যাবেন তার সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে।

“আমার তখন ২৭-২৮ বছর বয়স। ‘বৈষ্ণব জন তো’ ভজনটি রেকর্ড করা হবে। সরকারি অনুষ্ঠানের জন্য। কে শেখাবেন গানটি? লতা মঙ্গেশকর। ফোনে সেই গানটি আমাকে তুলিয়ে দেন লতাদিদি। সেই স্মৃতি আমি কখনওই ভুলতে পারব না। ওর কাছে অন্তত একটা তো শিখেছি!”

Lata-hoimonti

শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা বলেছেন, “লতা দিদির বাংলা গান আমার কণ্ঠস্থ, সেই শুনেই হেমন্তদা গাইতে ডেকেছিলেন।”

লতার সঙ্গে প্রথম দেখার স্মৃতিচারণ করেন হৈমন্তী, “…লতা দিদির প্রথম মুখোমুখি হওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। একবার উনি কলকাতায় এসেছেন অনুষ্ঠান করতে। গ্র্যান্ড হোটেলে উঠেছেন। সেই সময়ে সুপ্রকাশ গড়গড়ি ফোন করে জানালেন, লতাজি আমায় ডেকেছেন। উনি কিছু বাংলা গানের কথা ভুলে গিয়েছেন। আমার সব গান মুখস্থ থাকে জেনে সহযোগিতার জন্য ডেকেছেন।

“সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়েছিলাম তার কাছে। তখনই দেখেছিলাম, ওর একটি ব্রিফকেস ভর্তি গানের মোটা মোটা খাতা! সেখানে সব গান যত্নে লেখা। তার মধ্যে কয়েকটি বাংলা গান হারিয়ে ফেলেছেন। আমাকে বসিয়ে সে সব শুনে নতুন করে তুলে নিলেন খাতায়।”

আরও পড়তে পারেন

লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে ভারতে দুই দিনের জাতীয় শোক

লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শোক

একবার বিষ খাইয়ে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল লতাকে

শোক প্রকাশ করে গায়ক-সুরকার রূপঙ্কর বাগচী বলেছেন, “যেন সদ্য মাতৃহারা হলাম। যে কোনও সন্তান সদ্য মাকে হারালে যে ভাবে যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে ওঠে, আমার সেই অবস্থা। ভাষায় বোঝাতে পারছি না।”

শিল্পী মনোময় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘ছোট থেকে গুনগুন করতাম সলিল চৌধুরীর সুরে ওর ‘আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমে’ গানটি। হিন্দির পাশাপাশি তার বাংলা গানগুলোও আমার বড় প্রিয়। হারমোনিয়াম বাজিয়ে প্রায়ই গেয়েছি, ‘কী লিখি তোমায়, প্রিয়তমা’।”

সংগীতকার দেবজ্যোতি মিশ্র লিখেছেন, “এই পৃথিবীর মায়া-স্মৃতি-প্রেম-প্রণয়, এই পৃথিবীর অভিমান-আদর-বিতৃষ্ণা-রাগ সব ফেলে চলে যাচ্ছেন আমাদের সম্রাজ্ঞী, না কি ভালবেসে আমরা তাকে বরণ করে নিচ্ছি মহাকালে। সুরের ভারতবর্ষ সঙ্গীতের ভারতবর্ষ সাধারণ ও অসাধারণ সমস্ত ভারতবর্ষ আজ নতমুখে দাঁড়িয়ে...।”

ভারতের জাতীয় পুরস্কারজয়ী শিল্পী অনুপম রায় আক্ষেপ করে বলেছেন, “ওর সময়ে জন্মালে ওর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেতাম। আমাদের দুর্ভাগ্য, এ জন্মে সেই সাধ পূরণ হল না। লতাজিকে তাই তার গানেই বিদায় জানানো ছাড়া উপায় নেই। অনেকটাই গঙ্গাজলে গঙ্গা পুজোর মতো।”

Lata Shreya

এই প্রজন্মের জনপ্রিয় শিল্পী শ্রেয়া ঘোষাল ইন্সটাগ্রামে লিখেছেন, “অসাড় বোধ করছি। বিধ্বস্ত। গতকাল সরস্বতী পূজা ছিল এবং আজ মা তার আশীর্বাদকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। মনে হচ্ছে পাখি,গাছ,বাতাসও আজ নীরব। লতা মঙ্গেশকরজি আপনার ঐশ্বরিক কণ্ঠ চিরকাল প্রতিধ্বনিত হবে। শান্তিতে বিশ্রাম করুন। ওম শান্তি।”

শিল্পী আদনান সামি লিখেছেন, সংগীত আজ এতিম হয়ে গেল। আমাদের ‘নাইটিঙ্গেল’ উড়ে গেছে। আমরা কণ্ঠহীন হয়ে পড়েছি। আমরা তার জীবদ্দশায় বেঁচে ছিলাম এবং সেই বাতাসে শ্বাস বাতাসে শ্বাস নেওয়ার বিশেষ অধিকার পেয়েছি, যাতে তিনি শ্বাস নিয়েছিলেন। সবকিছুর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ প্রিয় দিদি।”

Kumar-Sanu-Lata-Mangeshkar

জনপ্রিয় শিল্পী কুমার সানু বলেছেন, “অনেক গান গেয়েছি লতাজির সঙ্গে। মানুষের মন জয় করতে পেরেছে সেই গানগুলি। আমার মতে, ওর মতো অভিজ্ঞতা গোটা বিশ্বে আর কারও নেই। ওর চলে যাওয়ায় শুধু আমাদের ইন্ডাস্ট্রিরই ক্ষতি হল না, গোটা দুনিয়া এক কিংবদন্তি কণ্ঠস্বর হারাল।”

মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিবার সকালে মারা যান লতা মঙ্গেশকর। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে প্রায় চার সপ্তাহ সেখানে ভর্তি ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুতে ভারতে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। সর্বকালের অন্যতম সেরা এই সংগীত শিল্পীর সম্মানে ভারতের জাতীয় পতাকা দুই দিন অর্ধনমিত রাখা হবে।

Link copied!