নানা বাঁধায় ভাষা নিয়ে চলচ্চিত্রটি করতে পারল না জহির রায়হান : সুচন্দা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২, ০৩:০৯ এএম

নানা বাঁধায় ভাষা নিয়ে চলচ্চিত্রটি করতে পারল না জহির রায়হান : সুচন্দা

জহির রায়হান আমার সাথে গল্প করে বলতেন দেশ স্বাধীন হলে দেখো আমি কি ধরনের ছবি তৈরি করি। তখন আর কোনো বাঁধা বিপত্তি থাকবে না। তখন আমাদের দেশে অনেক ছবি নির্মাণ হবে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র ’২১ শে ফেব্রুয়ারি’ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সময় পেলো না, তাকে সময় দেওয়া হলো না। স্বাধীনতার পরপরই তাকে হত্যা করা হলো, ভাষা আন্দোলন নিয়ে ছবি নির্মাণের স্মৃতিচারণে জহির রায়হানকে নিয়ে এসব কথা বলেন স্ত্রী সুচন্দা। 

ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে দ্য রিপোর্টের সাথে বিশেষ সাক্ষাৎকারে কথা বলেন কোহিনূর আক্তার সুচন্দা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিফাত সুলতানা মৃধা।

দ্য রিপোর্ট : জহির রায়হানের চিত্রনাট্যে '২১শে ফেব্রুয়ারি' নামে চলচ্চিত্র নির্মাণে আপনার বাঁধা কোথায় ছিল ?

সুচন্দা : জহির রায়হান কি আর আমি কি, তার সাথে আমার তুলনা হয় না। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে জহির রায়হানের মতো এমন লোককে শেষ করে দেওয়া হলো। অনেক সময় ইচ্ছে থাকলেও যে সব কাজ করা যায় তা কিন্তু নয়। মানুষ ভাবে অনেক কিছু, কল্পনা করে অনেক কিছু কিন্তু বাস্তবে তার রূপ দেয়া যায় না। চিত্রনাট্যটি আর খুঁজে না পাওয়া, নানান প্রতিবন্ধকতা থেকেই করা হয়নি।  

দ্য রিপোর্ট : ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রটি হয়নি কেন?

সুচন্দা : জহির রায়হান উদ্যোগ নিয়েছিলেন কিন্তু তখন তা হয়নি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে এখন পর্যন্ত কালজয়ী চলচ্চিত্র 'জীবন থেকে নেয়া'। জহির রায়হান শুধু ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেক সুন্দর ছবি তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন। তখন সময় ছিল না 'লেট দেয়ার বি লাইট' ছবি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। দেশকে স্বাধীন করার চিন্তা, আন্দোলনের চিন্তাভাবনা নিয়ে কাজ করছিলেন।

দ্য রিপোর্ট : বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র কম কেন ? 

সুচন্দা : ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরের ইতিহাসে চলচ্চিত্রের সংখ্যা মাত্র তিনটি। চলচ্চিত্রে এমনিতেই এখন দূরাবস্থা। ভালো কোনো ছবিই তৈরি হচ্ছে না। সাহিত্য নিয়ে ছবি করা, ভাষা আন্দোলন নিয়ে ছবি করা এটা একটি বিশাল ব্যাপার। সেটা সবার পক্ষে সম্ভব না আমি মনে করি। তবে যাদের পক্ষে সম্ভব তাদের চেষ্টা করতে হবে। সেই মনমানসিকতা আনতে হবে।  ভাষা আন্দোলন কে নিয়ে ছবি করার মন মানসিকতা নেই। দুই একজন পরিচালক ছিলেন যারা ভাষা আন্দোলনের পটভূমি নিয়ে ছবি নির্মাণ করেছেন। জহির রায়হান চলে যাওয়ার পর বাকিরা তো এর উদ্যোগ নেয়নি। সেসময় তো ২/৪ জন পরিচালক ছিলেন। তারা কেন এসব ছবি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়নি। তারা কেন ইতিহাস রক্ষায় এগিয়ে আসেন নি। এ নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। 

দ্য রিপোর্ট : দেশের দর্শক মহলও কি দায়ী নয়?

সুচন্দা : দেশকে দেওয়ার, জাতিকে দেওয়ার সে ধরনের লোকের ও অভাব রয়েছে। যাদের আছে তাদের ও বয়স হয়ে গেছে, চলচ্চিত্রের অবস্থা দেখে তারা ও হাত পা গুটিয়ে নিচ্ছে। তাছাড়া এখন হলে ছবি চলেনা, যে টাকা লব্ধি করা সে টাকা ফেরত আসে না। ভাষা আন্দোলনের উপর ছবি করলে যে ধরনের লোক দেখবে সে ধরনের দর্শক ও এখনো নেই। হলে ছবি দেখতে কেউ যায় না।

দ্য রিপোর্ট : দেশের অনেক পুরাতন ছবি দর্শকরা দেখতে পাচ্ছে না কেন ?

সুচন্দা : মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ছবিগুলো চালিয়ে চালিয়ে সমস্ত ফিল্ম গুলোকে ধ্বংস করছে। নেগেটিভ গুলো সংরক্ষণ না করে সেগুলো ও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কয়েক বছর পর এগুলোও পাওয়া যাবে না। ভারতে পুরান সাদা কালো ছবিগুলো এখনো ঝকঝক করছে। কিন্তু আমাদের দেশে তো এমন উদ্যোগ নেয় না। এগুলো সরকারি ভাবে করতে হয়৷ চলচ্চিত্র সংরক্ষণের স্বার্থে করতে হয়। এ ধরনের মনমানসিকতা যতদিন তৈরি না হবে ততদিন ইতিহাসের ছবি গুলো আর থাকবে না। তৈরি হবে না।

সিনেমা সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, অতীতের সিনেমা গুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলো সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। সংরক্ষণ কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে করা খুব কঠিন। করা যায় না।  এগুলো একমাত্র সরকারিভাবে উদ্যোগ নিলেই সম্ভব।

দ্য রিপোর্ট : শিল্পী সমিতির সমসাময়িক অবস্থা কতটা আশাব্যঞ্জক

সুচন্দা : মারামারি, গন্ডগোল, স্বার্থপরতা, সংগঠন নিয়ে কাঁদা ছুড়াছুড়ি এগুলো কোনো কাজ না। এগুলো শিল্পের,  সাহিত্যের পর্যায়েই পড়ে না। এগুলো আমরা স্বপ্নেও দেখিনি৷ আগেও শিল্পী, কলাকৌশলী ছিলো, সংগঠন ছিলো। তখনকার মানুষ জন লেখাপড়া, শিক্ষা দীক্ষায় বড় ছিলো। মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি ছিলো। মানুষ ভদ্র ছিলো, ভালো কিছু করার প্রচেষ্টা ছিলো। এখনকার দিনে এগুলো নেই। সংগঠন নিয়ে লড়ালড়ি হয় তাই ভালো কিছু হচ্ছে না। ইচ্ছে থাকতে হবে তবেই ভালো কিছু হবে।

তিনি বলেন, আগামী চলচ্চিত্র, ভবিষ্যত চলচ্চিত্র, ইতিহাস নিয়ে চলচ্চিত্র সবই নতুন প্রজন্মের হাতে তাদের করতে হবে। সরকার এখন অনেক সাহায্য করছে অনেক অনুদান দিচ্ছে। তাদের করা উচিত। অতীতের  ছবি গুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে অতীতের ছবিগুলো কিভাবে নির্মিত হয়েছে। তা দেখে নতুন ছবি নির্মাণ করা উচিত।

Link copied!