বিজয়ী সরকারের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

শারমিন আহমদ

ডিসেম্বর ২৩, ২০২২, ০৫:৫০ এএম

বিজয়ী সরকারের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর। ৫১ বছর  আগের এই সোনালী দিনটিতে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী  ও বিজয়ী গণপ্রজাতন্ত্রী প্রথম বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্যরা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁদেরকে বিদায় জানাতে কলকাতার দমদম বিমান বন্দরে এসেছিলেন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর  ( বিএসএফ) মহা পরিচালক কে এফ রুস্তামজী এবং বিএস এফের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের ইনস্পেক্টর জেনারেল  গোলোক মজুমদার। রুস্তামজী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে বলেন, “আমরা আশা করব ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রীর বন্ধন চিরকাল অটুট থাকবে।“ প্রধানমন্ত্রী তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, “ হ্যাঁ, তা হবে সমানে সমানে। স্বাধীন বাংলাদেশের উপর যদি চাপ সৃষ্টি না করা হয়, বাংলাদেশের কাজকর্মে যদি কোন প্রভাব বিস্তার না করা হয় তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশ ও স্বাধীন ভারতের মৈত্রী চিরকাল অক্ষুণ্ণ থাকবে।“ গোলোক মজুমদার এ প্রসঙ্গে বলেন ,” যে রুস্তামজীর চেষ্টায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অগ্রনী ভূমিকা গ্রহন এবং যার সঙ্গে তাঁর এত মধুর সম্পর্ক, স্বদেশের স্বার্থে তাঁকেও স্পষ্ট ভাষায় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে দৃঢ় মনোভাব জানাতে তাজউদ্দীন সাহেব বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না। “

হ্যাঁ, ব্যাক্তি, পরিবার, দল-উপদলের সংকীর্ণ স্বার্থরক্ষার  উরধে উঠে স্বদেশের স্বার্থ ও কল্যানে এমন তেজস্বী মনোভাব , চারিত্রিক দৃঢ়তা, দূরদর্শিতা ও ত্যাগী নেতৃত্বর কারনেই মাত্র  নয়মাসে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন সম্ভবপর হয়েছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও  পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ ও স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন সম্ভবপর হয় এই  আন্তরিক নেতৃত্বর কারনেই।

অথচ কি অদ্ভুত কারনে আজ পর্যন্ত জাতীয়ভাবে এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যগে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রথম বাংলাদেশ সরকার, যা “মুজিব নগর” ( বাংলাদেশের প্রথম রাজধানীর  মুজিবনগর নামকরন টি করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ)  সরকার নামেই বহুল পরিচিত, তার গঠন, কার্যাবলী, বক্তব্য, গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, সিদ্ধান্ত, এবং ভয়ংকর সব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে  প্রিয়  মাতৃভূমিকে বিজয়ের দ্বারে পৌঁছে দেবার গৌরবদীপ্ত ইতিহাসকে সংরক্ষিত করা হয়নি। যতটুকু তথ্য  পাওয়া যায় তা  ছড়িয়ে ছিটিয়ে, দায়সারা ও  খণ্ডিত ভাবে এবং যতোটা সম্ভব এই মুজিব নগর সরকারের অবদান ও  কৃতিত্বকে আড়াল করে।  বলা বাহুল্য যে সামরিক, বেসামরিক, কৃষক, মজুর, ছাত্র ও জনতা কে নিয়ে আপামর গনমানুষের  মুক্তিযুদ্ধ এবং  জাতির ক্রান্তিলগ্নে নেতৃত্বদানকারী  প্রথম বাংলাদেশ সরকারের  অভ্যুদয়  নিবিড়  ভাবে জড়িত। এই দুইকে খণ্ডন  করে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস উপস্থাপন করা সম্ভবপর নয়। ঠিক যেমন সম্ভবপর নয় ইতিহাসের ধারাবাহিতাকে বিপন্ন করে সত্যকে তুলে ধরা।

বঙ্গবন্ধু, লাখো কোটি মানুষকে উজ্জীবিত করেছিলেন স্বাধীনতা অর্জনে । আর তাঁর অবর্তমানে তাজউদ্দীন আহমদ একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীনতা যুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে শরীক হওয়া অগুনিত সাধারন মানুষের আত্বত্যাগের  অমর কাহিনীতে ভরপুর ইতিহাসের এই শ্রেষ্ঠ পর্বটি ধারাবাহিক ভাবে উঠে আসেনি ।  ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধর নয়মাসকে গুটিকতক শব্দজালে আবদ্ধ করে তারপর এক লাফে ১৯৭২ এ পদার্পণের কারনে ইতিহাসে যে ফাঁক সৃষ্টি হয়েছে তাতে ঢুকে পড়েছে জঞ্জাল; খল নায়কেরা জায়গা করে নিচ্ছে  ইতিহাসের শূন্যস্থান গুলিতে। ওদিকে  ইতিহাসের বাতিঘর সম মানুষদের স্থান হচ্ছে ফুটনোটে । এর ফলে তরুন সমাজ বিভ্রান্ত হচ্ছে;  জাতি  বঞ্চিত হচ্ছে তার দেশের সবচাইতে গৌরবময়  অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধর পর্বটি সম্পর্কে জানা থেকে।

পৃথিবীতে এমন ঘটনা নজীর বিহীন যে বিজয়ের ৫১ বছর পরেও জনগণ  জানেনা তার জন্মর ও তার  দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরবউজ্জ্বল ইতিহাসকে। এর লজ্জাজনক দৃষ্টান্ত হোল যে  বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেআরস ( বিলিয়া) পরিচালিত সাম্প্রতিক  গবেষণা ভিত্তিক সমীক্ষায়  বিভিন্ন  স্কুলের  চার শতাধিক শিক্ষার্থীদের  একজনও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত  কোন প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে  পারেনি!  কিন্তু দোষতো তাদের নয়।  দোষ আমাদের দেশের ভঙ্গুর শিক্ষা ব্যবস্থার এবং যারা এমন আঁধার পরিবেশের জন্ম দিয়েছে, তাদের।

এখন দৃষ্টিপাত করা যাক বিজয়ী প্রথম সরকারের মূল অবদান ও বৈশিষ্ট্যর দিকে, যা জানলে জাতি উপকৃত হবে এবং খুঁজে পাবে ভবিষ্যতে পথ চলার দিকদর্শন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

১। ১০ এপ্রিল, ১৯৭১,  স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ইতিহাসের মোড়  পরিবর্তনকারী  একটি আইনানুগ সরকার এবং সার্বভৌম  রাষ্ট্রর  প্রতিষ্ঠা। এর ফলে  আগ্রাসী গনহত্যাকারী পাকিস্থান সরকারের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী অপতৎ্পরতা এই আখ্যার বিরুদ্ধে  বিশাল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়;  আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের পথ উন্মুক্ত হয়।

২। স্বাধীন সার্বভৌম  রাষ্ট্রের সংজ্ঞাকে সুস্পষ্ট ভাবে এবং প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সাথে তুলে ধরা।

এ প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের ১০ এপ্রিলের  বেতার ভাষণটি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, “ বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্র সমূহের কাছে যে অস্ত্র সাহায্য আমরা চাইছি, তা আমরা চাইছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে,-একটি স্বাধীন দেশের মানুষ আর একটি স্বাধীন মানুষের কাছে……এই সাহায্য আমরা চাই শর্তহীনভাবে এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তাদের শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির প্রতীক হিসেবে,-হানাদারদের রুখে দাড়াবার এবং আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে---স্বাধীনতার জন্যে আমরা যে মুল্য দিয়েছি তা কোন বিদেশী রাস্ট্রের উপ-রাস্ট্র হবার জন্যে নয়। “

৩।  প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশ পলিসি সেল গঠন এবং তার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে   বাংলাদেশের পক্ষে যুক্তিমালা দক্ষতার সাথে তুলে ধরা। এই সরকারের নেতৃত্বর প্রাজ্ঞতা ভারত এবং বিশ্বশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্জন করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যা ছিল ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির একটি বড় কারন তা অপর বিশ্বশক্তি  যুক্তরাষ্ট্রর নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রসাশনের পাকিস্তানের  গনহত্যায় সহায়তার পথকে দুর্বল করে দেয় এবং  সার্বভৌম রাস্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কে ভারতের স্বীকৃতি প্রদানের  পথকে প্রসারিত করে।

৪।  মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন।  আওয়ামীলীগের নির্বাচিত নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালিত হলেও, দল-মতের উরধে  স্বাধীনতা কামী ভিন্ন দল সমূহকে  নিয়ে জাতীয় উপদেষ্টা  কমিটি গঠন এই সরকারের  সাফল্যকে বেগবান করে।

৫।   স্বাধীনতাযুদ্ধের ঐক্য বিনষ্টকারী তৎপরতা  ও  ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ।  পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের পাকিস্তান ও সিআইয়ের পক্ষ হয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের ষড়যন্ত্র এবং যুবদলের একাংশের সরকার ও সরকার পরিচালিত মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে হিংসাত্মক অপকান্ডকে প্রতিহত করে এই সরকার।  খন্দকার মোশতাকের জাতিসংঘে যোগ দান করে  পাকিস্তানের পক্ষে কনফেডারেশনের প্রস্তাব দেওয়ার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদটিও তাঁকে ছাড়তে হয়।

৬। বাংলাদেশের ইতিহাসের বলা চলে সবচাইতে মর্যাদাশীল চুক্তির প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। বিজয়ের আগেই প্রণীত এই চুক্তিগুলি  থেকে বোঝা যায় যে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে কতখানি নিবেদিত ছিল এই  সরকার।

 স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের স্বীকৃতি অর্জন এবং স্বীকৃতি প্রদানের পরেই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় মিত্র বাহিনী বাংলাদেশে  যৌথ কমান্ডে প্রবেশ করবে, যেদিন বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করতে বলবে, সেদিন তারা সৈন্য উঠিয়ে নেবে – এই যুগান্তকারী  শর্তগুলোকে সংযুক্ত করা ।  এ প্রসঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর পররাষ্ট্র সচিব জে এন দীক্ষিত যিনি বাংলাদেশ- ভারতের ঐ আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন, উল্লেখ করেছিলেন যে “ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মর্যাদার ব্যাপারে তারা

ছিলেন খুবই সজাগ। প্রাথমিক আলোচনায় আমাদের সেনা সদস্যরা একক ( নেতৃত্বর অধীনে থাকতে  চেয়েছিলেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, ‘ না, সেনা অভিযান হবে যৌথ কমান্ডে’।“

৭. আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রেখে জাতির জনকের নিঃশর্ত মুক্তি নিশ্চিত করে তাঁকে মুক্ত  স্বদেশে ফিরিয়ে আনা।

একটি স্বাধীন, জনগনের প্রতিনিধিত্বকারী, দক্ষ ও রাষ্ট্রচিন্তা সম্পন্ন সফল সরকারের উজ্জ্বল উদাহরন হোল  বাংলাদেশের প্রথম সরকার। তার কীর্তি ও অবদানকে গৌণ করে ভবিষ্যতের সঠিক পথের ঠিকানা  কি খুঁজে পাওয়া যাবে?

তথ্য সুত্র

 মুলধারা ৭১। মঈদুল হাসান। দ্যা ইউনিভার্সিটি পাবলিশার্স লিমিটেড

 উপধারা ৭১। মঈদুল হাসান। প্রথমা প্রকাশন

 সহস্তে লিখিত  আই জি গোলক  মজুমদারের নিবন্ধ। প্রকাশিত মুক্তির কান্ডারী    তাজউদ্দীন কন্যার অভিবাদন। শারমিন আহমদ। ঐতিহ্য।

গোলক মজুমদারের সাক্ষাৎকারঃ তাজউদ্দীন আহমদ আলোকের অনন্তধারা। সম্পাদনা সিমিন হোসেন রিমি। প্রতিভাস।

ইতিহাসের সত্য সন্ধানেঃ বিশিষ্টজনদের মুখোমুখি।  মতিউর রহমান। প্রথমা প্রকাশন

Link copied!