মার্চ ১৪, ২০২২, ১১:৫৫ পিএম
যুদ্ধের সময় প্রপাগান্ডা ছড়ানোর জন্য পশ্চিমা মিডিয়ার দুর্নাম সর্বমহলে সমাদৃত এক বিষয়। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে আবারও এর প্রমাণ মিলল। যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই পশ্চিমা মিডিয়া একেবারে উঠেপড়ে লেগেছে। প্রচার-অপপ্রচারে কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে, চলছে তার প্রতিযোগিতা। পুরো বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে নিয়েই বেশি মেতেছে তারা। তাদের সাম্প্রতিক আবিষ্কার, মিস্টার পুতিন নাকি কি অসুস্থ! কয়েকটি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম এ প্রশ্ন তুলে একের পর এক খবর প্রকাশ করে যাচ্ছে।
কেউ কেউ রীতিমত পয়েন্ট ধরে বিশ্লেষণ করে পুতিনের অসুস্থ হওয়ার দাবির সত্যতা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছে। আবার কেউ বলছে, তিনি দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত। রাশিয়া বরাবরই অভিযোগ করে বলে আসছে, পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম তাদের বিরুদ্ধে ভুয়া খবর ছাপায়। তার তথ্যযুদ্ধে নেমেছে।
রাশিয়ার এ দাবি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর আগে ২০২০ সালের নভেম্বরে ‘দ্য সান’ সহ কয়েকটি ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডে পুতিনের পারকিনসন রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং অসুস্থতার কারণে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনার খবর প্রকাশ করেছিল।
পরে ২০২০ সালের ৬ নভেম্বরে ক্রেমলিন থেকে এক বিবৃতিতে পুতিনের অসুস্থতা নিয়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যমের খবর ভুয়া বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। সেবার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছিলেন, ‘‘এটি সম্পূর্ণ ভুয়া কথা। প্রেসিডেন্ট একদম ঠিকঠাক আছেন এবং তার পদত্যাগের কোনও পরিকল্পনা নেই।”
এখন আবার পুতিনের অসুস্থতার খবর ছড়িয়েছে। আবারও সেই ব্রিটিশ মিডিয়ায়। পুতিনের বদলে যাওয়া অবয়ব এবং এর নেপথ্য কারণ কী হতে পারে তা নিয়ে খবর প্রকাশ করা হচ্ছে।
কোনও কোনও খবরে বলা হচ্ছে, পারকিনসনস রোগের সঙ্গে লড়তে পুতিন স্টেরয়েড খাওয়াটা তার ‘অস্থির আচরণের’ কারণ হয়ে থাকতে পারে। সব খবরই প্রকাশ করা হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে। কয়েকটি খবরে আবার পুতিনের ফোলা ফোলা চেহারা, ডিম্বাকৃতির মুখমণ্ডল এবং অতিথিদের কাছ থেকে তার অস্বাভাবিকরকম দূরত্ব বজায় রাখার দিকটিতেও আলোকপাত করা হয়েছে।
পুতিনের অসুস্থতা নিয়ে ব্রিটিশ মিডিয়ার এত মাতামাতির কারণ কী?
যখন কোথাও যুদ্ধ চলে তখন দুই পক্ষের মধ্যে শুধু অস্ত্র দিয়েই লড়াই হয় না। বরং কথার লড়াই, গুজব, অপপ্রচার, প্রকৃত ঘটনা বা সংখ্যাকে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন, সত্য গোপন, সবই চলে। এ সবই যুদ্ধের অংশ। বলা হয়ে থাকে, প্রেম ও যুদ্ধে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই।
তবে কী ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে পুতিনের অসুস্থতার খবর আসলে প্রপাগান্ডা?
ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সরকারি কর্মকর্তাদের কথার লড়াই চলছে। এমনকি রাশিয়া অভিযোগ করে বলেছে, ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাসের মন্তব্যের কারণেই পুতিন তার সেনাবাহিনীকে তাদের পরমাণু অস্ত্র ‘সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায়’ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
পুতিনের অসুস্থতা নিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে যেসব খবর প্রকাশ পেয়েছে তার কয়েকটি শিরোনাম:
‘দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ‘ফাইভ রিজনস টু সাজেস্ট ‘পাফি-ফেসড’ পুতিন কুড বি সিরিয়াসলি ইল’। অর্থাৎ তারা পুতিনের ‘ফোলা মুখ’ দেখে কেন মনে হচ্ছে পুতিন গুরুতর অসুস্থ তার পাঁচটি কারণ ব্যাখ্যা করেছে।
প্রেসিডেন্ট পুতিনের এই ‘ফোলামুখ’ নিয়েই বেশি মেতেছে ব্রিটিশ মিডিয়া। ছবি: সংগৃহীত
‘দ্য ডেইলি স্টার’ এর শিরোনাম ‘ম্যাড ভ্লাদ ‘ডাইং অব ক্যান্সার’- পাগল ভ্লাদিমির ক্যান্সারে মারা যাচ্ছেন। অন্যদিকে, ‘দ্য সান’ এর জিজ্ঞাসা ‘ইজ ভ্লাদিমির পুতিন ইল?’ ভ্লাদিমির পুতিন কী অসুস্থ?
কোথা থেকে এসব গুঞ্জন ছড়াচ্ছে এবং সেগুলোর কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা আছে কী?
পুতিনের কি ক্যান্সার হয়েছে?
পুতিন ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং এ কারণেই তিনি তাড়াহুড়ো করে ইউক্রেইনে আক্রমণ চালিয়েছেন। একজন রয়্যাল নেভি অ্যাডমিরাল এ সপ্তাহে এ দাবি করেছেন।
পোর্টসমাউথ গ্রামার স্কুলে গত ৪ মার্চ শিশুদের সঙ্গে কথা বলার সময় ওই স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী রেয়ার অ্যাডমিরাল ক্রিস প্যারি বলেন, ‘‘তিনি (পুতিন) অনেক দিন ধরেই কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সময় অনেক লম্বা টেবিল ব্যবহার করছেন।
‘‘আমার ধারণা তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হয়ত ঠিক মত কাজ করছে না। তাই তার এত তাড়া।”
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে পুতিনকে আটকাতে মস্কো সফরে গিয়েছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। দুই নেতার বৈঠকের একটি ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে দেখা যায় অনেক লম্বা একটি টেবিলের দুই প্রান্তে দুজন বসে কথা বলছেন।
কেন লোকে ভাবছে পুতিন অসুস্থ?
ব্রিটেনের ‘দ্য ডেইলি স্টার’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে লিখেছে, পুতিনের সাম্প্রতিক ছবিগুলোতে তার ‘মুখ ফোলা’ দেখানোর কারণ কেমোথেরাপির ওষুধ বা স্টেরয়েডের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
সাবেক ওই সেনা গোয়েন্দা এখন পেন্টাগনের হয়ে কাজ করেন। তিনি আরও বলেন, পুতিনকে নিয়ে গবেষণা করছেন এমন ব্যক্তিদেরও ধারণা তিনি গুরুতর অসুস্থ।
‘‘অতীতের ছবিগুলোতে তাকে সব সময় হাসতে দেখা যেত। কিন্তু ২০২২ সালে তাকে খুব কম ছবিতেই খুশি দেখা যাচ্ছে। পুতিনের ছবি বলছে তার যন্ত্রণা হচ্ছে এবং আমাদের ধারণা ওই যন্ত্রণার কারণেই বেশিরভাগ ছবিতে তাকে রাগান্বিত দেখা যাচ্ছে।”
‘দ্য সান’ পুতিনের সম্প্রতি প্রকাশ করা একটি ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পর্যবেক্ষণও তুলে ধরেছে। ছবিটি গত ১ মার্চের।
ক্রেমলিন থেকে প্রকাশিত ওই ছবিতে দেখা গেছে, পুতিন সেন্ট পিটার্সবুর্গের গভর্নর আলেকজান্ডার বেগলোভের সঙ্গে কথা বলছেন। ছবিতে পুতিনের মুখ কিছুটা ‘ফ্যাকাশে এবং ফোলা’ দেখা যাচ্ছে।
অথচ, সাধারণত ক্রেমলিন থেকে পুতিনের যেসব ছবি প্রকাশ করা হয়, সেগুলোতে তাকে বেশ শক্তপোক্ত দেখায়। হয়ত তারা বোঝাতে চায়, রাশিয়ার শাসনভার একজন শক্তিশালী লোকের হাতে আছে। সেসব ছবিতে দেখা যায়, হয় তিনি জুডো করছেন বা খালি গায়ে পিটা শরীরে ঘোড়ার পিঠে চড়ছেন।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
‘সেন্টার অন দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অ্যান্ড ইউরোপ ইন দ্য ফরেইন পলিসি প্রকল্পের’ সিনিয়র ফেলো ফিওনা হিল বলেন, ‘‘পুতিনকে ঠিক সুস্থ দেখাচ্ছে না, তার মুখ ফোলা।
‘‘আমরা জানি, তিনি তার পিঠের ব্যাথা বেড়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। এখন যদি সেটা আরও খারাপ না হয়ে থাকে, তবে হতে পারে তিনি উচ্চ মাত্রায় স্টেরয়েড নিচ্ছেন। অথবা এর থেকেও বেশি কিছু। তার মধ্যে এক ধরনের তাড়াহুড়ো দেখা যাচ্ছে এবং সেটির কারণ ব্যক্তিগতও হতে পারে।”
২২ বছর ধরে রাশিয়ার ক্ষমতায় আছেন পুতিন। পুতিনের স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা আরেকজন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান সিনেটর মারকো রুবিও। তিনি বলেন, ‘‘প্রেসিডেন্ট পুতিনের কিছু তো একটা হয়েছে।”
‘‘যদি আমি আরও কিছু বলতে পারতাম। কিন্তু এখনকার জন্য আমি এটুকুই বলতে পারি, নিশ্চিতভাবেই পুতিনের সঙ্গে কিছু হয়েছে। তিনি সবসময়ই একজন হত্যাকারী ছিলেন। কিন্তু এখন তার সমস্যা ভিন্ন এবং সুনির্দিষ্ট।”
‘দ্য ডেইলি মেইল’ কে রুবিও বলেন, ‘‘এখন তার (পুতিন) বয়স বড়েছে। এই পৃথিবীতে তার সময় ফুরিয়ে আসছে। তিনি সেটা জানেন।”
পুতিন বা ক্রেমলিন কী প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে?
কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
সূত্র: বিবিসি, এপি, এএফপি ও রয়টার্স