চীনের ঋণ ফাঁদ: কতটা ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২২, ১০:০১ পিএম

চীনের ঋণ ফাঁদ: কতটা ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

চীনের ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে গিয়ে অর্থনৈতিক চাপে পড়েছে এশিয়া ও ইউরোপের অনেক দেশ। কূটনীতির পরিভাষায়, চীনের এ নীতিকে বলা হচ্ছে ‘ডেবট ট্র্যাপ ডিপ্লোমেসি’। শ্রীলংকার সমুদ্র বন্দর, লাওসের খনিজ সম্পদ দখলের পাশাপাশি নাইজেরিয়ার সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে চীনের এই ঋণের কারণে। সাম্প্রতিক সময়ে চীন থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ নেওয়ার ফলে বাংলাদেশও কি এই ঋণ ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে? জোর আলোচনা চলছে এ নিয়ে।

শুরুতে বন্ধুত্বসুলভ ঋণ প্রদান

বাংলাদেশকে চীনের ঋণ প্রকল্পের শুরুটা হয়েছে অনেকটেই বন্ধুত্বসুলভভাবে। ২০১০ সালে পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ শুরুর আগেই বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগে বাংলাদেশকে ঋণ প্রদান থেকে বিরত থাকে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও তখন ঋণ দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। তখনই চীন এগিয়ে আসে বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার জন্য। কিন্তু পরবর্তীতে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করলেও কারিগরি সহায়তা নেওয়া হয়েছে চীনের কাছ থেকে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও মেট্রোরেল ছাড়া সকল মেগা প্রকল্পে কোন না কোনভাবে চীন যুক্ত আছে। রাস্তা, ব্রীজ,বন্দর,টার্মিনাল ও বিদ্যুৎ প্রকল্প সকল ক্ষেত্রে চীনের আধিপত্য।

যে যে প্রকল্পে চীনের ঋণ রয়েছে

পায়রা বন্দর নির্মাণে চীনের সহায়তার পাশাপাশি ১০ হাজার কোটি টাকা বাজেটে সাড়ে তিন কিলোমিটারে কর্ণফুলীর নদীর পাদদেশে টানেল নির্মাণেও অর্থ বিনিয়োগ করেছে চীন। পদ্মা বহুমুখী সেতুতে রেল সংযোগের কাজ করছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনা রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআইসি)। এ প্রকল্পে ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। শ্রীলঙ্কা ও লাওসের প্রকল্পেও ঋণ সহায়তা দিয়েছিল এক্সিম ব্যাংক।

এছাড়া পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিতব্য কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে চীন বিনিয়োগ করেছে ১৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ঢাকায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে ১১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। এছাড়া ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ১০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকার অর্থায়ন করছে চীন। সম্প্রতি ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গোপসাগরে সাবমেরিন বেস তৈরির চুক্তি পেয়েছে চীনের প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া বেশ আগে থেকেই চীন করছে সাভারে ট্যানারির সিইটিপি নিমার্ণের কাজ।

প্রসঙ্গত, ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ঋণ বা অনুদান হিসেবে বাংলাদেশে অর্থায়ন শুরু করে চীন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে শুরুর পর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ৩২০ কোটি ৯৮ লাখ ৪৬ হাজার ডলারের ঋণ, অনুদান বা অর্থসহায়তা দিয়েছে চীন।

ঋণের ফাঁদে পড়ার কোন পর্যায়ে বাংলাদেশ

বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, কোনো দেশের মোট জিডিপির ৪০ শতাংশের ওপর বৈদেশিক ঋণ হলে সেই দেশ ঝুঁকিতে রয়েছে বলা যায়। সেখানে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ মাত্র ১৪ শতাংশ, যার মধ্যে চীনের অংশ সাড়ে ৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ এখনও পর্যন্ত যেসব দেশ বা প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণী তার মধ্যে বিশ্বব্যাংকের কাছে ৩৮ শতাংশ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ২৪.৫ শতাংশ, জাইকা থেকে ১৭ শতাংশ, চীন থেকে ৬.৫২ শতাংশ, রাশিয়া থেকে ৬.১৮ শতাংশ ও ভারত থেকে ১.৩ শতাংশ ঋণ রয়েছে।

সে হিসেবে চিনের ঋণ ফাঁদের বিপদসীমা থেকে দূরেই আছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া সকল ধরনের ঋণের কিস্তি যথাসময়ে পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ।

চীনের ঋণ
ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে চীনের অবস্থান বেশ পেছনে রয়েছে।

 

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশ চীনের ঋণের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে— এমন প্রচারণার পুরোটাই বানোয়াট। বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৪০ শতাংশের ওপর হলে সেটি চিন্তার কারণ। সেখানে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ মাত্র ১৪ শতাংশ, যার মধ্যে চীনের অংশ আনুমানিক ৬ শতাংশ, যা আসলে খুবই কম।

২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় ২৭টি প্রকল্প চূড়ান্ত করা হয়। এসব প্রকল্পে ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয় চীন। তিস্তা নদী খনন, নদীর দুই পাড়ে তীর রক্ষাকাজ, চর খনন, স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ এবং বাড়িঘর রক্ষায় সামনের দিনগুলোয় আরো বেশি অর্থায়নের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে চীন। তবে এরই মধ্যে বেশকিছু প্রকল্প থেকে সরে এসেছে বাংলাদেশ।

এছাড়া পায়রা বন্দরে চীনের বিনিয়োগ থাকলেও কোন একক কর্তৃত্ব নেই। চীনা দুটি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পায়রা বন্দরের অন্যান্য কম্পোনেন্টের জন্য চারটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করেছিল বাংলাদেশ, যার একটি ছিল ইউরোপের ও তিনটি দক্ষিণ কোরিয়ার। পায়রা বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পটিকে ১৯টি কম্পোনেন্টে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি কম্পোনেন্টের জন্য আলাদা অর্থায়ন কৌশল বেছে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে সরকারের (জিটুজি) সহযোগিতার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) মডেলও বিদ্যমান। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের বড় অংশই আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে নেওয়া। এ অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য একটি নির্দিষ্ট দেশ থেকে নেয়া ঋণের চাপে পড়ার আশঙ্কা খুবই কম।

প্রধানমন্ত্রীর নিজ হস্তক্ষেপ

‘আখাউড়া-সিলেট মিটার গেজ লাইনকে মিশ্র গেজে রূপান্তর’ এবং ‘জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী মিশ্র গেজ ডাবল লাইন  নির্মাণ’— এই দুই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩০ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রকল্পের খরচ পুনঃনিরীক্ষার জন্য গঠিত বাড়তি ব্যয় ধরার তথ্য উঠে আসে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় না করার জন্য এই প্রকল্পের নির্দেশনা আসে।

চীন সরকার-টু-সরকার (জি-টু-জি) ঋণ দেওয়ার সময় তারা উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করতে দেয় না। চীন সরকারের নিয়োগ দেওয়া কোম্পানিগুলো (ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান) নিজেদের ইচ্ছামতো প্রকল্পের বিভিন্ন অঙ্গে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে সবকিছুর দাম বাড়তি নির্ধারণ করে। অনেক সময় এই বাড়তি দাম না ধরলেও এসব কোম্পানি ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’র ব্যয় মর্জিমাফিক নির্ধারণ করে বা অতিপ্রাকৃত দাম ধরে।

শ্রীলংকাসহ অন্যান্যদের অবস্থার অবনতির কারণ

চীন নিজস্ব অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে (বিআরআই) কাজে লাগিয়ে বিশ্বের প্রায় ৭৫টি দেশে বিনিয়োগ করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়ানোর মাধ্যম হিসেবে চীন বাংলাদেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে যত বেশি সম্ভব সুফল আদায় করতে চাইবে।

ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে শ্রীলংকা তাদের দক্ষিণ উপকূলের হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের লিজে চীনের কাছে হস্তান্তরে বাধ্য হয়েছে। শ্রীলংকার বৈদেশিক ঋণের পরিমান তাদের জিডিপির তুলনায় ৪০০ শতাংশ। লাওস এবং নাইজেরিয়ারও এই পরিস্থিতি। ইউরোপের দেশ মন্টেনিগ্রোও পড়েছে একই ধরনের সংকটে। দেশটির রাজধানী পডগোরিচার উপকণ্ঠে চীনের অর্থায়নে একটি হাইওয়ে প্রকল্প নির্মাণে চীনের ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার কথা। দেশটিতে এখন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে যে এ মহাসড়কের ব্যয় ও ঋণ নির্বাহ করতে গিয়ে পুরো দেশের অর্থনীতিই পঙ্গু হয়ে পড়তে পারে।

বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ গবেষক মুজাহিদুল হক সৌরভ বলেন, পৃথিবী আন্তর্জাতিক রাজনীতির পটপরিবর্তনের করনে ভবিষ্যতে একটি সংকটময় সময় আসতে পারে। তবে বাংলাদেশ উন্নয়ন প্রকল্পে অতিরিক্ত অর্থ অযৌক্তিকভাবে খরচ করছে না। দুই রেল প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে প্রকল্পের খরচ পুনঃমূল্যায়ন করতে বলাটাই এর বড় উদাহরন।

Link copied!