নভেম্বর ১২, ২০২১, ১২:৪০ পিএম
‘চলন বলন পোষাক রাখো, রাষ্ট্র এবার দায় নাও। দিনে হোক রাতে হোক, সামলিয়ে রাখো চোখ।। হাতে হাতে মশাল জ্বালো, নারী তুমি কথা বলো,নারী থেকে নারীতে বিদ্রোহ ছুঁয়ে যাক। যে আইন নিপীড়ন করে, সেই আইন মানিনা’ এমন নানা স্লোগানে মুখরিত হয় রাজধানীর রাজপথ।
বাসস্থান, কর্মক্ষেত্র ও গণপরিবহনসহ সব জায়গায় নারীর জন্যে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতের দাবিতে রাজধানীতে ‘শেকল ভাঙার পদযাত্রা’ নামে কর্মসূচি পালন করেছেন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার নারীরা।
এই কর্মসূচির আয়োজকরা সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারাকে যৌন নিপীড়ন এবং ধর্ষণবান্ধব উল্লেখ করে এটি বাতিলের দাবিও জানান।
বৃহস্পতিবার রাত ১২টা ১ মিনিটে শাহবাগ থেকে নারীদের এই পদযাত্রা শুরু হয়ে শেষ হয় মানিক মিয়া এভিনিউতে সংসদ ভবনে যেয়ে। তখন রাত ১টা ৪৫ মিনিট। এতে সংহতি জানান বিভিন্ন পেশাজীবী, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিল্পীরা। পদযাত্রার পর প্রতিবাদী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
একইসাথে সাক্ষ্য আইন (১৮৭২) এর ১৫৫(৪) ধারা বাতিলের দাবীতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করা
এ পদযাত্রায় উপস্থিত সঙ্গীতশিল্পী ও গীতিকার কাজী কৃষ্ণকলি ইসলাম রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘আজকের পদযাত্রার মূল কারণ হচ্ছে যে ধারাটা নিয়ে কথা হচ্ছে সেটার পরিষ্কার অবস্থান। দেখুন আমরা বুলিং এর স্বীকার হচ্ছি, আগেও হয়েছি, এখনো হচ্ছি। তাই এই ধারা অর্থাৎ ১৫৫(৪) নিয়ে একটা পরিষ্কার অবস্থান চাই।’
এ পদযাত্রায় সংহতি জানিয়ে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার শিক্ষার্থী-শিক্ষক-শিল্পীরা। আইনজীবী সারাহ হোসেন, রেহনুমা আহমেদ, সায়দিয়া গুলরুখ, আনহা এফ. খান, আশনা হাবিব ভাবনা এবং কৃষ্ণকলিসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
পদযাত্রা ও প্রতিবাদ কর্মসূচির আয়োজকরা জানান, ‘রাষ্ট্র খুবই স্পষ্ট এবং সহজ উপায়ে একটা জঘন্য অপরাধকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতেই অস্বীকার করছে! নিপীড়নের শিকার হওয়ার পর এই আইন বলবৎ থাকার কারণে নারীকে কাঠগড়ায় দেখাতে হয় তার চারিত্রিক সনদপত্র, উত্তর দিতে হয় আসামীপক্ষের আইনজীবীর জঘন্য সব প্রশ্নের! আমাদের "বিজ্ঞ" আদালত এসকল নোংরা নিপীড়নের চর্চা চুপ করে শুনে যান! ’
শেকল ভাঙার পদযাত্রা’র অন্যতম সংগঠক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী প্রাপ্তি তাপসী রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, 'জাতি-ধর্ম-বর্ণ-রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে শুধুমাত্র লৈঙ্গিক পরিচয় 'নারী' হওয়ার কারণে যে জুলুম-অত্যাচার-বৈষম্য সহ্য করতে হয় প্রতিনিয়ত, নিপীড়নের বিচার চাইতে গেলে যেখানে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট খুলে দেখাতে বলে এই রাষ্ট্র– তার বিরুদ্ধে আমাদের এই প্রতিবাদ। অনতিবিলম্বে স্বাক্ষ্য আইন(১৮৭২) এর ১৫৫(৪) ধারাটি বাতিল করার সুস্পষ্ট দাবী নিয়ে নারীদের এই পদযাত্রা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই ধরণের অবমাননাকর এবং বিদ্বেষমূলক চর্চা আমরা দেখতে পাই যেগুলোর মধ্য দিয়ে নারীর প্রতি নিপীড়নের বৈধতা দান করা হয়।’
পদযাত্রায় উপস্থিত নির্মাতা অপরাজিতা সঙ্গীতা দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, ‘তিন বছর আগে একজন নারী সিএনজি চালিত অটোরিকশা করে বাড়ি ফিরছিলেন। এমন সময় রাস্তায় পুলিশ আটকিয়ে তাকে জিজ্ঞেস ক্রেন,এত রাতে কেন আপনি ঘরের বাইরে? এত রাতে ভদ্র মেয়েরা ঘরের বাইরে থাকে না, খারাপ মেয়েরা বাইরে থাকে। তখন আমরা প্রতিবাদ করি প্রথমবারের মত। এ দেশের দিনটা যেমন আমার, রাতটাও আমার। প্রয়োজন পড়লে আমি বাইরে যাবো।রাতে বাইরে যাওয়া মানেই চরিত্র খারাপ এই ট্যাবুটা না থাকুক সেই কারণেই আজকের এই পদযাত্রা।’
ব্রিটিশ আমলে প্রণীত সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যখন বলাৎকার বা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে, অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্র নারী (When a man is prosecuted for rape or an attempt to ravish, it may be shown that the prosecutrix was of generally immoral character)।’
ইতোমধ্যে এই ধারাটি বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ বছরের সেপ্টেম্বরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছিলেন, আইনটি সংশোধনের খসড়া শিগগিরই মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। এরপর এটি অনুমোদনের জন্য তোলা হবে সংসদ অধিবেশনে।
পরে ২৭ অক্টোবর রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সাক্ষ্য আইনকে যুগোপযোগী করতে এক সভার আয়োজন করা হয়।
সেখানে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘১৫৫ (৪) ধারা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। ধারাটি নারীর মানবাধিকারের বিরুদ্ধে। আইন থেকে ধারাটি বাতিল হলে তা নারীর মর্যাদাহানি রোধ হবে।’
এই ধারা বাতিলের দাবিতে পদযাত্রা কর্মসূচির আয়োজকরা জানান, ‘বাংলাদেশে ধর্ষণ হলো একমাত্র অপরাধ যেখানে অপরাধের বিচারের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় অপরাধের শিকার নারীর চলন-বলন ও পোশাকের দিকে। প্রতিটি ধর্ষণের অভিযোগের পর সমাজের আচরণ দেখে মনে হয়, যেন এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বৈষম্যমূলক মানদণ্ড অনুযায়ী নারীর চলন-বলন ঠিক না থাকলে তার সঙ্গে অন্যায় হওয়াটাই স্বাভাবিক।’
উল্লেখ্য, ধর্ষণের ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর পুলিশকে মামলা না নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলার রায়ের পর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার এ পর্যবেক্ষণ দেন।
পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, ‘মামলার দুই ভুক্তভোগী আগে থেকেই সেক্সুয়াল (যৌন) কর্মে অভ্যস্ত। অহেতুক তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছেন। এতে আদালতের ৯৪ কার্যদিবস নষ্ট হয়েছে। এরপর থেকে পুলিশকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছি।’