বৈশাখ-কথা: মঙ্গল শোভযাত্রা ও পান্তা-ইলিশের সমাহার

হাসনাত আসিফ কুশল

এপ্রিল ১৪, ২০২৪, ০১:৪৮ এএম

বৈশাখ-কথা: মঙ্গল শোভযাত্রা ও পান্তা-ইলিশের সমাহার

প্রতীকী ছবি

বাঙালির সার্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব ধর্মের নানা মতের মানুষ বৈশাখকে বরণ করে থাকেন। আজ সেই বৈশাখ বরণের দিন। মলিন মর্ম মুছায়ে আজ নতুনের দিকে ধাবিত হওয়ার দিন।

বৈচিত্র্যময় ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। এই দেশে প্রবাদ আছে- বারো মাসে তেরো পার্বণ। অর্থাৎ বাঙালি উৎসবপ্রিয় জাতি।

যেভাবে এলো পান্তা-ইলিশের রীতি
উৎসবে, পালাপার্বণে বাঙালি হয়েছে মুখর। পহেলা বৈশাখে স্বাদে বৈচিত্র্যে বাঙালিয়ানা বজায় রাখতে এদিন অনেকেই পান্তা-ইলিশ খেয়ে থাকেন। কিন্তু পহেলা বৈশাখেই কেন পান্তা-ইলিশ? বছরের অন্য দিন কেন নয়? আর কীভাবেইবা পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়া প্রচলিত হলো? এসব নিয়েই আজকের আয়োজন।

পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার এই রীতি চালু হয়েছে ১৯৮৩ সালে রমনার বটমূল থেকে। রমনার বর্ষবরণ উৎসব এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার সুবাদে প্রতিবারই ব্যাপক লোক সমাগম হয়। যদিও করোনা পরিস্থিতির কারণে দুই বছর কোনো আয়োজনই হচ্ছে না। তবে সীমিত পরিসরে যে যার মতো বাসায় পান্তা-ইলিশের বৈশাখী আয়োজন ঠিকই করে আসছে।

তবে পান্তা কিংবা ইলিশ কখনোই পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গ ছিল না। এর প্রচলন নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে। দ্রুতই পান্তা-ইলিশ পহেলা বৈশাখের সমার্থক হয়ে ওঠে।

মঙ্গল শোভাযাত্রা
বাংলা বর্ষবরণের ইতিহাস আর মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস এক নয়। বাংলা বর্ষবরণের ইতিহাস বেশ পুরনো। অন্যদিকে মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়।

এরশাদশাহীর স্বৈরাচারের বিরোধিতায় মুখর শিক্ষার্থীদের হাত ধরেই এই শোভাযাত্রার পথ উন্মুক্ত হয়েছিল।

যশোরে ১৩৯২ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখে প্রথমবারের মতো মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয়। সেই শোভাযাত্রার আদলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মূল ফটকের সামনে ১৯৮৯ সাল থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা পালিত হয়ে আসছে।

শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে এই শোভাযাত্রা পুনরায় চারুকলার গেটে এসে সমাপ্ত হয়। পরবর্তী সময়ে ধর্মনিরপেক্ষ একটি উৎসব হিসেবে এটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

তখন অবশ্য এর নাম ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা। ধীরে ধীরে নাম পরিবর্তন হয়ে এটি দাঁড়ায় মঙ্গল শোভাযাত্রায়।

১৯৮৯ সালে হওয়া প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া, হাতি। ১৯৯০ সালের আনন্দ শোভাযাত্রায়ও নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায়। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা লাভ করে। চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিল্পীদের উদ্যোগে হওয়া সেই শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য, বিশিষ্ট লেখক, শিল্পীসহ সাধারণ নাগরিকরা অংশ নেয়। এই শোভাযাত্রা সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। সেখানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা এবং ধর্মাবলম্বীরা অংশ নেয়।

রমনার বটমূলের কালো অধ্যায়
১৪ এপ্রিল ২০০১। ১৪০৮ সনের পহেলা বৈশাখ। সকালে রমনার বটমূলে ছায়ানটের শিল্পীরা সমবেত হয়ে গান গাইছিলেন। শ্রোতারা তখন গান শুনছে। হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিহত হলেন ১০ জন। আহত হলেন আরও বহু লোক। দুর্বৃত্তরা গ্রেনেড হামলা করে দ্রুত পালিয়ে যায়।

বর্বরোচিত এই হামলায় নিহত হন চট্টগ্রামের আবুল কালাম আজাদ (৩৫), বরগুনার মো. জসীম (২৩), ঢাকার হাজারীবাগের এমরান (৩২), পটুয়াখালীর অসীম চন্দ্র সরকার (২৫) ও মো. মামুন, ঢাকার দোহারের আফসার (৩৪), নোয়াখালীর ইসমাইল হোসেন ওরফে স্বপন (২৭), পটুয়াখালীর শিল্পীসহ (২০) অজ্ঞাত দুজন।

হত্যাকাণ্ডের দিনই রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করা হয়। ২০০৮ সালে আদালতে ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে সিআইডি।

বিচারের জন্য মামলা দুটি ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে যায়। ১৬ এপ্রিল মামলা দুটিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ পাঠানো হয়।

এই মামলায় ২০১৪ সালের ২৩ জুন আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেন নিম্ন আদালত। রায়ের পর আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হয়। একইসঙ্গে এই রায়ের বিরুদ্ধে কারাবন্দী আসামিরা আপিল করে। উভয় আবেদনের ওপর ২০১৭ সালের ৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। আদালত বদল হওয়ায় শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে মামলাটি। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলা এখনও নিম্ন আদালতে বিচারাধীন। ২০২২ সালের ২১ মার্চ বিস্ফোরক মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।

Link copied!