পাহাড় ধস থেকে কবে মুক্তি চট্টগ্রামবাসীর?

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুলাই ২৯, ২০২১, ০৫:৪০ পিএম

পাহাড় ধস থেকে কবে মুক্তি চট্টগ্রামবাসীর?

বর্ষা মৌসুম শুরু হলেই পাহাড় ধসে হতাহতের ঘটনা এখন প্রায় নিয়মিত হয়ে উঠেছে। প্রতিবছরই দুর্ঘটনার অনুসন্ধান করতে গঠিত হয় কারিগরি কমিটি। নেওয়া হয় নানান উদ্যোগ।  তবে সেই উদ্যোগ আলোর মুখ আর দেখেনা।  বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাহাড় কাটা বন্ধ করা গেলে, বেশি করে গাছ লাগানো হলে এবং ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠন করে এর আওতায় পাহাড়ের রক্ষণাবেক্ষন করতেপারলে পাহাড় ধস ঠেকানোর পাশপাশি বাচাঁনো যাবে অনেক প্রাণ।

বাংলাদেশে প্রতিবছরই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। চলতি বছর মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) দুপুরে কক্সবাজারের উখিয়া রোহিঙ্গা কাম্পে পাহাড় ধসে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় আরও ২ জন। এসব দুর্ঘটনায় কান্নার আওয়াজ থামতে না থামতেই পরের দিন বুধবার (২৮ জুলাই) দিবাগত রাতে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও মহেশখালীতে পৃথক পাহাড় ধসে একই পরিবারের ৫ জনসহ ৬ জন নিহত হয়েছেন। মাত্র ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে পাহাড় ধসের ঘটনা কেড়ে নেয় ১১ জনের প্রাণ।

এরমধ্যে ২০০৭ ও ২০১৭ সালে ঘটে স্মরণ কালের সবচেয়ে ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনা। 

পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয় থেকে জানা যায়, ২০০৭ সালের ১১ জুন জুন চট্টগ্রামে ২৪ ঘণ্টায় ৪২৫ মিলিমিটারের মতো বৃষ্টিপাত হয়। ওই বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের সেনানিবাস এলাকা, লেডিস ক্লাব, কাছিয়াঘোনা, ওয়ার্কশপঘোনা, শহরের কুসুমবাগ, মতিঝর্ণা, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ প্রায় সাতটি এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। ওইদিন ভোরবেলা সামান্য সময়ের ব্যবধানে এসব পাহাড় ধসে নারী, শিশুসহ ১২৭ জনের মৃত্যু হয়।

গত ১৪ বছরে দেশের বিভিন্ন পাহাড় ধসের ঘটনায় অন্তত ২৫০ জন মারা গেছেন। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজার এলাকায় পাহাড় ধসে পড়লে ১২ জন মারা যায়।

২০১১ সালের ১ জুলাই নগরীর টাইগার পাস এলাকায় পাগাহ ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসের ঘটনায় ১৭ জন প্রাণ  হারায়।২০১২ সালের ২৬-২৭ জুন পাহাড় ধসে চট্টগ্রামে ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৩ সালে মতিঝর্ণায় দেয়াল ধসে ২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকায় পাহাড় ধসে ৩ জন ও ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় পাহাড় ধসে ২ জনের মৃত্যু হয়।

২০১৭ সালে ঘটে বাংলাদেশের পাহাড় ধসের ইতিহাসের সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা। ওই বছেরের ১২ ও ১৩ জুন রাঙামাটিসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৫ জেলায় পাহাড় ধসে ১৫৮ জন মারা যান। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর নগরীর ফিরোজশাহ কলোনিতে পাহাড় ধসে ৪ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালে কুসুমবাগ এলাকা পাহাড় ধসে এক শিশুর মৃত্যু হয়েএভঅবে দেখা যায়, প্রতিবছরই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে।

২০০৭ ও ২০১৭ সালেরপাহাড় ধসের কারণ অনুসন্ধান করতে গঠিত হয় কারিগরি কমিটি।  দুবারই এই কারিগরি কমিটির একজন সদস্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল এবং পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম। 

পাহাড় ধসের কারণ সম্পর্কে তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন,  ‘প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট দুই কারণেই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। পাহাড় ধসের প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, পাহাড়ের বালুময় মাটি ও পরিবর্তিত আবহাওয়ায় অল্প সময়ে অধিক বৃষ্টি। এই অধিক বৃষ্টির কারণ কারণে প্রচুর পানি পাহাড়ের ফাটলে প্রবেশ করে মাটিকে নরম করে ফেলে।এর পাশাপাশি গাছপালা কমে যাওয়ায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে।’

মানব সৃষ্ট কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন,পাহাড়ে গাছ কাটা, পাথর সরানো, বসত বাড়ি তৈরি করতে পাহাড় কাটা, পাহাড়ের মাটি কাটার মতো কারণগুলো রয়েছে।

পাহাড়ে এই হতাহতের পরিমান কমাতে করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, “ পাহাড়ের এই সমস্যা সামাধানে আমরা সল্প মেয়াদী, মধ্যম মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী সমাধানের প্রস্তাব করেছিলাম। সল্প মেয়াদীর মধ্যে আছে, ঝুকিপূর্ণ পাহাড় থেকে মানুষ সরিয়ে ফেলা। মধ্য মেয়াদীর মধ্যে আছে, পাহাড় কাটা বন্ধ কারা, নতুন ভাবে গাছে লাগানো ও পাহাড়ে বসবাসরত মানুষ সরিয়ে ফেলা। এবং দীর্ঘ মেয়াদী সমাধানের মধ্যে রয়েছে ‘ প্রতিটা পাহাড়ের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাহাড় ম্যানেজমেন্ট কমিটি তৈরি করা এবং এর আওতায় পাহারের রক্ষণাবেক্ষন করা’।  তবে এই প্রস্তাবনা দেয়ার পর ৩ বছর কেটে গেলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি বলেও তিনি জানান।

তবে স্থানীয়ভাবে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে কতিপয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানায় রাঙামাটি জেলা প্রশাসন।  

রাঙামাটি জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মিজানুর রহমান এ বিষয়ে দ্যা রিপোর্টকে জানান, ‘আমরা ঝুকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করছি। এর পাশাপাশি আমরা ক্যাম্পেইন , লিফলেট বিতরণ ও বিভিন্ন ভাষায় মাইকিং করছি। এছাড়াও বৃষ্টির সময়ে আমরা মানুষকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসার কাজ করছি।‘ 

পাহাড় ধসের কারণ অনুসন্ধান শেষে প্রস্তাবিত সমাধান গুলো কেন বাস্তবায়িত হচ্ছেনা, এই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. কামরুল হাসান জানান, ‘প্রস্তাবিত সমাধানগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা আমরা করছি। কিন্তু পুরোপুরি সম্ভব হচ্ছেনা কারণ পাহাড়ের মালিকানার বিষয় আছে, আদালতে মামলাসহ অনেক আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। এছাড়া পাহাড়ে বসবাসকারীদের পুনর্বাসন করাও একটি দীর্ঘমেয়াদী কাজ। মূলত এইসব কারণে প্রস্তাবিত সমাধান গুলো বাস্তবায়ন করা যাচ্ছেনা।’

এছাড়া, বর্তমানে পাহাড় ধস ও হতাহত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে আশ্রয় কেন্দ্রগুলো ঠিক রাখা, পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষদের নিরাপদে রাখার জন্য কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

Link copied!