জানুয়ারি ৩, ২০২৪, ০৪:২১ পিএম
খেলাধুলার জুতা বানানোর ক্ষেত্রে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হলো অ্যাডিডাস ও পুমা। কিন্তু জানেন কি পৃথিবীবিখ্যাত এই দুই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়েছিল আপন দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্ব থেকে।
১৯১৯ সাল। জার্মানির হের্জোগেনারক শহরে ছোট্ট ব্যবসা শুরু করে ডাসলার পরিবার। জন্ম হয় জুতো তৈরির আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে স্নিকার্সের কারখানা ‘গেব্রুইডার ডাসলার’। নেপথ্যে ছিলেন দুই ভাই— অ্যাডলফ এবং রুডলফ ডাসলার। প্রাথমিকভাবে নিজেদের পৈতৃক বাড়িতেই চলত জুতো প্রস্তুতির কাজ। বছর দশকের মধ্যেই কর্মী সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ জন। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকা চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতেই একটি বড়ো কারখানা নির্মাণ করেন ডাসলার ভ্রাতৃদ্বয়।
জুতোর বৈশিষ্ট্য দেখে তৎকালীন বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সংস্থাদের সরিয়ে অখ্যাত এই আঞ্চলিক কোম্পানির জুতোকেই বেছে নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকে। আর তারপরেই ভাগ্য খুলে যায় ডাসলার কোম্পানির। তাঁদের জুতো ব্যবহারকারী অ্যাথলেটরা নিয়ে আসেন ৭টি স্বর্ণপদক, ৫টি করে রূপো এবং ব্রোঞ্জ। শুধুমাত্র জেসি ওয়েন্সই জিতেছিলেন চারটি সোনা।
কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্বের সেরা ক্রীড়াসামগ্রী প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোর মধ্যে জায়গা করে নিল গেডা (গেব্রুইডার ডাসলার)। তবে বেশিদিন স্থায়ী হল না সেই ব্যবসা। বদলে গেল কারখানার উৎপাদিত পণ্যই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জুতোর বদলে বাধ্য হয়েই শুরু হল আগ্নেয়াস্ত্র প্রস্তুতির কাজ। অ্যাডলফ বাড়িতে থেকেই পরিচালনা করতেন কারখানা। অন্যদিকে রুডলফ থাকতেন দেশের বাইরে জার্মানির সেনানিদের কাছে অস্ত্র পৌঁছে দেওয়ার তত্ত্বাবধানে।
বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৪৫ সালে আত্মসমর্পণ করে জার্মানি। যুদ্ধক্ষেত্র থেকেই সেসময় ওয়ার ক্রিমিনাল হিসাবে গ্রেপ্তার হন রুডলফ ডাসলার। বছর খানেক বাদে মুক্তি পেয়ে আবার ফিরলেন শহরে। শুরু হল সাবেকি জুতোর ব্যবসা। তবে দুই ভাইয়ের সম্পর্কে যেন কোথাও একটা চির ধরেছিল এর পরেই। যার জেরে ১৯৪৮ সালে ভেঙে গেল জার্মানির অন্যতম সংস্থা গেডা। অ্যাডলফ ডাসলার ওরফে অ্যাডি তৈরি করলেন অ্যাডিডাস, রুডলফ বানালেন পুমা।
কিন্তু কেন ভাঙন ধরেছিল সেই সম্পর্কে তা আজও অজানা সকলের কাছে। অনেকের মতে যুদ্ধে বন্দি হওয়ার কারণ হিসেবে অ্যাডলফকেই দায়ী করেছিলেন তাঁর ভাই। অভিযোগ ছিল আমেরিকার কাছে গোপন তথ্য ফাঁস করেই তিনি ধরিয়ে দিয়েছেন তাঁকে। আবার কেউ কেউ বলে দুই ভাইয়ের স্ত্রীদের মধ্যে বিবাদ এমনই চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে পরিবার ভাগ হয়ে যায় তাতেই।
তবে শুধু যে পরিবারই ভাগ হল তেমন নয়। ভাগ হয়ে গেল গোটা শহরের মানুষরাই। যেন দেশভাগের ক্ষুদ্র সংস্করণ। একদল অ্যাডিডাসকে ব্র্যান্ড হিসেবে বেছে নিলেন। একদল রুডলফের পুমাকে। কারণ সে সময় গোটা হের্জোগেনারক শহরের প্রতি পরিবারের অন্তত একজন করেই কাজ করেন হয় অ্যাডিডাস নয়তো পুমার কারখানায়।
দুই ভাইয়ের বিবাদ এমনই পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে এক সংস্থার সামগ্রী ব্যবহারকারী অন্যদের ‘উচিত শিক্ষা’ দিতেন সাক্ষাৎ হলেই। বাড়িতেও অতিথি এলে তাঁর জুতো দেখে তবেই দেওয়া হতো। কখনো কখনো শালীনতাকেও ছাপিয়ে যেত সেসব।
১৯৭৪ ও ’৭৮ সালে যথাক্রমে রুডলফ ও অ্যাডির মৃত্যুর পর ব্যবসার দায়িত্ব নেন তাঁদের সন্তানরা। তবে প্রচলিত ‘রাইভালরি’ থেকেই যায় শহরে। আরও এক-দেড় দশক পর ১৯৯০ সালে পারিবারিক ব্যবসা থেকে পাবলিক সেক্টরে বদলে যায় দুই সংস্থাই।
ব্যবসায়িক দিক থেকে দেখতে গেলে পুমার থেকে বর্তমানে বেশ খানিকটা এগিয়েই রয়েছে অ্যাডির তৈরি কোম্পানি। বিশ্বের খেলার সামগ্রী প্রস্তুতকারকদের মধ্যে নাইকির পরেই স্থান তাঁদের। বিশ্বব্যাপী স্টক এক্সচেঞ্জে তাঁদের মূল্য ৫১ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পুমা প্রথম দশে থাকলেও তাঁদের ব্যবসায়িক মূল্য ৭ বিলিয়ন ডলার।
অ্যাডিডাস এবং পুমা— দুই ব্র্যান্ডেরই উৎপাদিত পণ্য মূলত একই গোত্রের। দুই সংস্থাই প্রস্তুত করে ক্রীড়াসামগ্রী। ফলে চূড়ান্ত ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও ৭০ বছর পেরিয়ে এসে বিশ্ববাজারে এখনও দাপট বজায় রেখেছে তাঁরা। একে অপরের সঙ্গে এই ‘রাইভালরি’-ই সামনে এনেছে একের পর এক চমকপ্রদ পণ্য। তবে ১৯৪৮ সালের সেই ভাগ না হলে পৃথিবী দেখতেই পেত না এই দুই স্পোর্টস ম্যানুফ্যাকচারার জায়ান্টকে।