মে ১৪, ২০২৫, ০৫:৫১ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফের) ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ আগামী জুন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ হাত পাবে বলে আশা করছে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আইএমএফের কিস্তিসহ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার জুনের মধ্যে হাতে পেতে পারে বাংলাদেশ।
আটকে থাকা কিস্তির অর্থ ছাড়ে নানা শর্ত নিয়ে আলোচনার পর সম্প্রতি আইএমএফের দিক থেকে সবুজ সংকেত পায় বাংলাদেশ। সেজন্য মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করতে কিছুটা ছাড় দিতে সম্মতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সে কথা তুলে ধরে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর বলেন, “ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে দেওয়ার সময় হয়েছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে। বাজারভিত্তিক করা হলেও বর্তমানে ডলারের যা দর রয়েছে, তার থেকে খুব বেশি তারতম্য ঘটবে না।”
তিনি বলেন, “গত কয়েক মাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ডলার বাজার স্থিতিশীল ছিল। আগামীতেও আশা করছি ডলার বাজারে ইন্টারভেন করার দরকার হবে না।”
আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি হিসাবে ১ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার কথা রয়েছে বাংলাদেশের। তার আগে ২৩ মে আইএমএফের বোর্ডে বিষয়টি অনুমোদন হতে হবে।
অনেক শর্তের মধ্যে এবার দুই কিস্তির অর্থ একসঙ্গে পাওয়ার ক্ষেত্রে আলোচনার বড় অংশ আটকে ছিল মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা নিয়ে। এটি পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে না দিলেও সেখানে কিছুটা ছাড় দেওয়ার বিষয়ে সবশেষে সম্মতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ নিয়ে আলোচনার পরই আইএমএফ ঋণ ছাড়ে ইতিবাচক সাড়া দেয় বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ভাষ্য।
ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা-ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করতে ‘ক্রলিং পেগ’ এ এবার কিছুটা ছাড় দিতে রাজি হয়েছে। এ নিয়ে মতবিরোধ থাকায় এতদিন ঋণ ছাড়ের কিস্তি আটকে ছিল।
“এই ক্রলিং পেগের করিডর বাড়ানো হবে। তাতে বাজারে চাহিদা-সরবরাহের ভিত্তিতে ডলার দর আগের চেয়ে কিছুটা বাড়ার সুযোগ তৈরি হবে।” খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
বর্তমানে ক্রলিং পেগের মধ্যবর্তী দর ১১৯ টাকা। এর সঙ্গে আরো আড়াই শতাংশ দাম কমতে বা বাড়তে পারে।
দুবাই সফরে থাকা গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে যোগ দিয়ে বলেন, “আইএমএফের সঙ্গে আমাদের সময় নিয়ে একরকম মতপার্থক্য ছিল। আমরা চাচ্ছিলাম সময় যখন উপোযোগী হবে, তখন ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হবে। তবে আইএমএফ এপ্রিলের শেষ সভায় জানিয়েছিল যে জুনে তাদের বোর্ড মিটিংয়ের আগেই বাজারভিত্তিক করতে।
“এখন আমরা মনে করছি অর্থনীতির অবস্থা স্থিতিশীল হয়েছে। তাই আমরা প্রস্তুত ডলার দরকে বাজারভিত্তিক করতে। সে কারণে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি আমাদের সিদ্ধান্ত সঠিক।”
তিনি বলেন, “ডলার দরে কোনো রকম অস্থিতিশীলতা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করবে। তবে আশা করছি, বাংলাদেশ ব্যাংকের তা করতে হবে না।”
এলসি নিষ্পত্তি করতে কোনো ব্যাংকের যদি কোনো রকমের চাপ তৈরি হয়, তাহলে অন্য ব্যাংক থেকে ডলার নিয়ে তা পূরণ করার পরামর্শ দেন গভর্নর।
তিনি বলেন, আগের চেয়ে আমদানির এলসি খোলা অনেক বেড়েছে। তবে বাজারে ডলারের কোনো রকম সংকট তৈরি হয়নি। বিদেশে অর্থ পরিশোধেও কোনো রকম বিধিনিষেধ দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।
“রিজার্ভ আমরা বাড়িয়েছি, সামনে আরো বাড়ানো হবে। তবে রিজার্ভ এখন যা রয়েছে তা পর্যাপ্ত।দেশের অর্থনীতি একটি ভালো অবস্থানে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে। সামনের মাসে আরো কমবে বলে আশা করছি। অগাস্টের পর থেকে রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার বিক্রি করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাস শেষে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ২৭ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতির হিসাবে ২২ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার।
‘জুনের মধ্যে ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার’
অর্থ মন্ত্রণালয় বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, আইএমএফ চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় করলে জুনের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার পেতে পারে।
তাতে বাংলাদেশের রিজার্ভ শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় আশা করছে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ অবশ্য সপ্তাহ দুয়েক আগে ওয়াশিংটন থেকে ফিরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে ‘ঘুরে দাঁড়িয়েছে’, তাতে আইএমএফের ঋণের বাকি কিস্তিগুলোর ‘খুব একটা প্রয়োজন নেই’।
ঋণের শর্ত হিসাবে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি বাংলাদেশকে যেসব পরামর্শ দিচ্ছে, তার অন্যতম ছিল এনবিআরের সংস্কার। সে অনুযায়ী এনবিআরকে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুই ভাগে আলাদা করা হয়েছে।
বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ এতদিন পেছাতে চাইলেও এখন তাতে রাজি হয়েছে ঋণের কিস্তি পাওয়ার আশায়।
অর্থমন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সার্বিক বিষয়টি তুলে ধরে বলা হয়, “বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থে সব বিষয় সতর্কতার সাথে পর্যালোচনা করে উভয় পক্ষ রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, মুদ্রা বিনিময় হারসহ অন্যান্য সংস্কার কাঠামো বিষয়ে সম্মত হয়েছে।
“চতুর্থ রিভিউ এর স্টাফ লেভেল এগ্রিমেন্ট সম্পন্ন হওয়ায় আশা করা হচ্ছে আইএমএফ চলতি বছরের জুনের মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির জন্য নির্ধারিত এক দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার একত্রে ছাড় করবে। আইএমএফের এক দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়াও বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, এআইআইবি, জাপান এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে আরও প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা জুন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ প্রত্যাশা করছে।”
এসব ঋণের ক্ষেত্রে সংস্থাগুলো বিভিন্ন শর্ত দিলেও বাংলাদেশ তার নিজস্ব বাস্তবতা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়।
মন্ত্রণালয় বলছে, “উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে এ অর্থ প্রাপ্তির ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও শক্তিশালী হবে যা মুদ্রার বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে। বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা গ্রহণের ক্ষেত্রে যেসব সংস্কার কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে, তা সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব বিবেচনায় পরিকল্পিত এবং জাতীয় স্বার্থে নেওয়া হচ্ছে। এ সব সংস্কার কর্মসূচির ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগীদের কার্যক্রম শুধুমাত্র কারিগরি সহায়তা প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ।”
আর্থিক সংকট সামাল দিতে ২০২৩ সালে আইএমএফের সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি করে বাংলাদেশ।
সে বছর ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে পাওয়া যায় দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার।
২০২৪ সালের জুনে পাওয়া গেছে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার। তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার।
সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।