বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোটা ব্যবস্থা

তানজিলা তাসনিম

জুলাই ৭, ২০২৪, ০৩:২৯ পিএম

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোটা ব্যবস্থা

অনগ্রসর গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়কে এগিয়ে নিতে ও মূলধারায় রাখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে সরকারি চাকরি ও পড়াশোনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু আসন বরাদ্দ রাখা হয়। এই ব্যবস্থাকেই বলা হচ্ছে কোটা।

বিভিন্ন দেশের কোটা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার আগে বাংলাদেশের কোটা ব্যবস্থা বাতিল, পুনর্বহাল ও সার্বিক বিষয় কেন আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে সেটা জানা জরুরি।

বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে অসন্তোষ বহু পুরনো বিষয়। বেশ কয়েকবার কোটা বাতিলের দাবিতে হওয়া আন্দোলন রণক্ষেত্রে রূপ নিয়েছে। ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর (নবম-ত্রয়োদশ গ্রেড) সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে একটি পরিপত্র জারি করে। তারপর থেকে আগের মতো বিদ্যমান ৫৬ শতাংশ কোটায় নিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। সেই কোটা আন্দোলনের অন্যতম নেতা একজন নেতাও দীর্ঘ ২৯ বছর অকার্যকর থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন।

সম্প্রতি বাংলাদেশের উচ্চ আদালত সেই ২০১৮ সালের কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। এর ফলে সরকারি চাকরিতে আগের ৫৬ শতাংশ কোটা পুনর্বহাল হবে। এই কোটা বাতিলের দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন শুরু করেছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ৪ জুলাই প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ কোটার বিষয়ে হাইকোর্টের রায় আপাতত বহাল রাখার নির্দেশ দেন। প্রধান বিচারপতি আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘কোটা নিয়ে এত কিসের আন্দোলন? রাজপথের আন্দোলন দেখে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট রায় পরিবর্তন করে না।’

আরও পড়ুন: রাস্তায় আন্দোলনের সময় আপনি কী করবেন?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭ জুলাই যুব মহিলা লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এক অনুষ্ঠানে বলেন, কোটা বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে বহাল হয়েছে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে ছেলেমেয়েরা আন্দোলন করছে। এর কোনো যৌক্তিকতা নেই।

বর্তমানে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে কোটা ব্যবস্থা। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে শুরু করে সরকারী চাকরির বাজারে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে সকলের সাথে সমান তালে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার কোটা প্রথার মতো বিশেষ একটি ব্যবস্থা চালু রেখেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১০ শতাংশ নারী কোটা, ১০ শতাংশ জেলা কোটা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটা, ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা নিয়ে মোট ৫৬ শতাংশ সরকারি চাকরি হয় কোটার মাধ্যমে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের কোটা পদ্ধতি কেমন?

ভারত

আমাদের ঠিক পাশের দেশ ভারতেই সরকারি চাকরিতে আছে কোটা ব্যবস্থার সুবিধা। ভারতে কোটা আছে মোট ৪ ধরনের। যেমন- ১. আদিবাসী বা তফসিলি কোটা, ২. অন্যান্য অনগ্রসরদের জন্য কোটা, ৩. জাতভিত্তিক কোটা, ৪. বিভিন্ন রাজ্যের সংখ্যালঘুদের কোটা।

ভারতের মোট ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ কোটার সঙ্গে সঙ্গে একটি সুষ্ঠু কোটা বণ্টন ব্যবস্থাও আছে। একটি পরিবারে শুধু একজনই এই কোটা ব্যবহার করতে পারবে ও উচ্চশিক্ষায় কোটার ব্যবহার করা হলে চাকরিতে সেই ব্যক্তি আর কোটা ব্যবহার করতে পারবে না।

পাকিস্তান

মুক্তিযোদ্ধের মধ্য দিয়ে যে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিকতা থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ সেখানেও চালু আছে কোটা পদ্ধতি।

পাকিস্তানে কোটা পদ্ধতি চালু আছে বিভিন্ন এলাকার জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে। দেশটিতে কোটা পদ্ধতির মূল কারণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সব অঞ্চলের মানুষ যেন সমানভাবে অংশ নিতে পারেন। পাকিস্তানে কেবলমাত্র ৭ দশমিক ৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে বিভিন্ন চাকুরীতে অংশগ্রহণ করে।

মালয়েশিয়া

মালয়েশিয়ার মোট জনসংখ্যার ৫০ দশমিক ১ শতাংশ মালয়। মালয়েশিয়ান উচ্চশিক্ষায় জাতিগত কোটার মোট ৫৫ শতাংশ সুবিধা ভোগ করে মালয় জনগোষ্ঠী।

চাকরি, স্বল্পমূল্যে বাসস্থানসহ সব ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ ভোগ করে মালয় আর ৪০ শতাংশ ভোগ করে অন্য সব জনগোষ্ঠী।

কানাডা

উন্নত রাষ্ট্রের একটি রোলমডেল কানাডাতেও রয়েছে কোটা ব্যবস্থা। সেখানে মূল চারটি শ্রেণির জন্য কোটা প্রযোজ্য। যথা- নারী, প্রতিবন্ধী, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু। কিন্তু এই ৪ শ্রেণির কোন কোটার জন্য কত শতাংশ সেটা সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা নেই।

নেপাল

নেপালের সরকারি চাকরিতে কোটা দুই ভাগে করা আছে। একটি সাধারণ কোটা (৫৫ শতাংশ) এবং অন্যটি সংরক্ষিত কোটা (৪৫ শতাংশ)।

সংরক্ষিত কোটার মধ্যে নারী, উপজাতি, মাদেশি, দলিত সম্প্রদায়, প্রতিবন্ধী ও প্রত্যন্ত জনগোষ্ঠীর জন্য ১৯৯৩ সাল থেকে আলাদা আলাদা ভাগ করা রয়েছে।

জাপান

অন্যান্য দেশের মতো জাপানেও আছে কোটা ব্যবস্থা। বুরাকুমিন ও কোরীয় সম্প্রদায়কে সরকারি চাকরিতে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এ ছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন কিংবা বেসরকারি কোনো পণ্য ও সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীসংখ্যা ৫ শতাধিক হলে বুরাকুমিন এনং আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য ৫ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

চীন

চীনে সরকার স্বীকৃতভাবে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অন্যদের থেকে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতার বিধান রাখা হয়েছে চীনের জনসংখ্যার ৮ শতাংশ জাতিগত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের জন্য মাসিক সরকারি বৃত্তির পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত স্বল্প শিক্ষা খরচে, এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিনা শিক্ষা খরচে পড়াশোনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

কেন কোটা ব্যবস্থা?

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কোটা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মূলত সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতের মাধ্যমে তাদের জনসংখ্যার মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে বিশেষ কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে।

একটি দেশের সার্বিক অবস্থা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ নানা কাঠামোর ওপর নির্ভর করে এই জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা ও বিশেষ সুবিধা বরাদ্দ করা হয়। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই কোটা বরাদ্দ করা হয় বিধায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওই জনগোষ্ঠীর অবস্থার উন্নতি হলে বিভিন্ন সময় এই ব্যবস্থায় সংস্কার করা হয়েছে।

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এক নির্বাহী আদেশে সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি চালু করা হয়। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ২০ শতাংশ পদ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হতো। ১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৪০ শতাংশে বাড়ানো হয়। পরে মেধায় নিয়োগের হার আরও কিছু বর্ধিত করা হয় এবং ২০১৮ সাল পর্যন্ত মেধাভিত্তিক নিয়োগ ছিল ৪৪ শতংশ।

২০১৮ সালে সারা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের গণআন্দোলনের প্রেক্ষিতে সেই বছরের ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি চাকরি (নবম-ত্রয়োদশ গ্রেড) থেকে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের ঘোষণা দিয়ে পরিপত্র জারি করে।

গত ছয় বছর ধরে সেই অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে নিয়োগ হচ্ছে ও একটি মেধাভিত্তিক দক্ষ প্রশাসন তৈরিতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রস্তুত করছে বলে দাবি করেছেন আন্দোলনকারীরা।

২০২১ সালে সেই পরিপত্রের মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান রিট করেন।

চলতি বছর ৫ জুন হাইকোর্ট সেই রিটের রায়ে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের পক্ষে ও ২০১৮ সালে জারিকৃত সরকারের পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করেছে।

এরপর থেকে আবার আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে ১ জুলাই থেকে ৪ দফা দাবিতে টানা আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা।

আন্দোলনকারীদের দাবির মধ্যে আরও রয়েছে পরবর্তী সময়ে সরকার কোটাব্যবস্থা নিয়ে কোনও পদক্ষেপ নিতে চাইলে ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল রেখে কমিশন গঠন করে দ্রুত সরকারি চাকরির সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দেওয়া; সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা; চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটাসুবিধা একাধিকবার ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করা; কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া এবং দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।

Link copied!