দক্ষিণ এশিয়ায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার উদ্বুদ্ধ করছে বড় অর্থনৈতিক শক্তিগুলো

মেহেদী আল আমিন

ডিসেম্বর ১১, ২০২৩, ০৯:২৮ পিএম

দক্ষিণ এশিয়ায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার উদ্বুদ্ধ করছে বড় অর্থনৈতিক শক্তিগুলো

ছবি: মেহেদী আল আমিন, কপ-২৮ সম্মেলন থেকে।

বড় অর্থনৈতিক শক্তিগুলো একদিকে প্রযুক্তিকে নবায়নযোগ্য শক্তিতে পরিণত করতে ব্যর্থ হচ্ছে, অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অর্থায়ন করছে। যে কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের জীবন ও জীবিকা পড়েছে ঝুঁকির মুখে। এমনটাই দাবি করেছে দক্ষিণ এশিয়ান জাস্ট ট্রানজিশন অ্যালায়েন্স (এসএজেটিএ)।

সোমবার কপ-২৮ সম্মেলনে এক সংবাদ সম্মেলনে এই আঞ্চলিক জোটটি এ দাবি জানায়।

সংবাদ সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিশ্বকে সহায়তা করার বদলে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো মিথ্যা সমাধান প্রয়োগ করে কার্বন নিঃসরণে আরও উৎসাহিত করছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের একটি ‘কাট-অফ ডেট’ ঘোষণা করে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুতের বৈশ্বিক চাহিদার অন্তত ৬০ শতাংশ পূরণের জন্য লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণের দাবি জানান তারা।

কোস্টাল লাইভলিহুড অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল অ্যাকশন নেটওয়ার্কের প্রধান নির্বাহী হাসান মেহেদী লিখিত বক্তব্যে জানান, বড় অর্থনৈতিক শক্তিগুলো জলবিদ্যুৎকে নবায়নযোগ্য ও পরিচ্ছন্ন শক্তির নামে চালিয়ে দিচ্ছে। এভাবে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো জমি, নদী ও সাধারণ জলাশয় দখল করছে। মৌলিক মানবিক, লিঙ্গ এবং পরিবেশগত অধিকারকে উপেক্ষা করছে। আদিবাসী সম্প্রদায়কে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে।

এই প্রকল্পগুলোতে জাপান, কোরিয়া এবং জার্মানির মতো বড় বড় দেশের পাশাপাশি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি), ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (ইআইবি) এবং ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশনও (আইএফসি) অর্থায়ন করছে।

এসএজেটিএ-এর প্রধান ধারণাটি তুলে ধরে মেহেদী বলেন, জাপানের মতো কিছু উন্নত দেশও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তরল হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া এবং কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ (সিসিএস) প্রযুক্তির মতো অত্যন্ত ব্যয়বহুল পদ্ধতিগুলো মেনে নিতে চাপ দিচ্ছে। বলা হচ্ছে এ প্রযুক্তিগুলো কার্বন নিঃসরণ কমাতে পারে, কিন্তু সেটি প্রমাণিত নয়। এসএজেটিএ এই মিথ্যা সমাধান প্রচার বন্ধের দাবি জানিয়েছে বলে জানান তিনি। 

হাসান মেহেদী আরও জানান, অর্থায়নের ফাঁদ তৈরি করে জাপান তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও অন্যান্য ‘মিথ্যা সমাধান’ গ্রহণ ও প্রচার করতে আমাদের বাধ্য করছে। কপ-২৮ সম্মেলনের সভাপতি হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই মিথ্যা সমাধানগুলোতে সমর্থন করা জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের প্রতি অযৌক্তিক। এটা লজ্জাকর বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার জনসংখ্যা ১.৮৭ বিলিয়ন যা বিশ্বের জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ। এই অঞ্চলটিতেই বিশ্বের প্রায় ২৯ শতাংশ দরিদ্র মানুষ বসবাস করে যারা ভয়াবহ মাত্রায় জ্বালানি দারিদ্রের শিকার। যেখানে বিশ্বব্যাপী বিদ্যুতের ব্যবহার গড়ে ৩ হাজার ২০৪ কিলোওয়াট ঘণ্টা, সেখানে এই অঞ্চলে মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহার মাত্র ৬৯৪ কিলোওয়াট ঘণ্টা।

জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিআরআই) অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে পাঁচটিই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্বের শীর্ষ ১০টি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় রয়েছে। দেশগুলো হলো- বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা।

সেক্ষেত্রে বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকেও তাদের জ্বালানি খাতকে ডিকার্বনাইজ করতে হবে।

মেহেদী আরও বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দেশ ভারত বিশ্বের সর্বোচ্চ নির্গমনকারী দেশের তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে। এছাড়াও বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম মূল্যে সৌরশক্তির উৎপাদন করছে ভারত। এর প্রতিবেশী দেশ চীন সবচেয়ে বড় ও সর্বনিম্ন মূল্যে ‘আরই-এক্সেসরিজ’ সরবরাহকারী। অথচ এ দুটি দেশই অন্যান্য দেশগুলোকে ২০৫০ সালের মধ্যে সাশ্রয়ী মূল্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সক্ষমতা অর্জনে সাহায্য করতে চুক্তিবদ্ধ। 

দক্ষিণ এশিয়ায় একটি ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত উত্তরণ নিশ্চিত করতে ভারত ও চীনসহ উন্নত পর্যায়ের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সংকীর্ণ জনতাবাদী ও জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

রূপান্তরিত জ্বালানির নামে এলএনজিতে অর্থায়ন বন্ধেরও দাবি জানিয়েছে এসএজেটিএ। এলএনজির নির্গমনের জীবনচক্র কয়লার চেয়েও ক্ষতিকর।  এটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এছাড়াও আধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত জাতীয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রতিষ্ঠান এবং উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে সাহায্য করতে বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে এসএজেটিএ।

এসএজেটিএ-এর বিবৃতিতে আরও বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়াতে ৪২-৫৬ শতাংশ বিদ্যুৎ অভ্যন্তরীণ খাতে ব্যবহার করা হয়। নবায়নযোগ্য শক্তির সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে একটি সম্প্রদায়-মালিকানাধীন বিতরণকৃত নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবস্থায় অর্থায়নের জন্য তারা দাবি জানিয়েছে। এতে করে নাগরিকদের জ্বালানি শক্তি পাওয়ার যে সার্বভৌম ক্ষমতা সেটি নিশ্চিত করা যায়। অন্যদিকে শিল্প ও পরিষেবা খাতগুলো ছাদের ওপর সোলার বা উইন্ড সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে জ্বালানি শক্তি উৎপাদন করে ব্যবহার করতে পারে।

 

মেহেদী আল আমিন
দুবাই থেকে

Link copied!